১১ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১১:০০

দায় নিরূপণ হয় না ক্ষতিপূরণও মেলে না



বিস্ফোরণের ঘটনায় কে বা কারা দায়ী বা কোনো সংস্থার অবহেলা আছে কি না, তা ঠিকভাবে নিরূপণ করা না হলে এবং মামলা নিষ্পত্তি না হলে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমনকি মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়াও বাধাগ্রস্ত হয়।

রাজধানীর মগবাজারে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনার দুই বছর হতে চললেও ওই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। ওই বিস্ফোরণে ১২ জন নিহত এবং দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এ মামলার তদন্ত করছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেদিন এশার নামাজ পড়তে গিয়ে বিস্ফোরণে ৩৭ জন দগ্ধ হন, তাঁদের মধ্যে ৩১ জন মারা যান। তিতাসের গ্যাস পাইপলাইনের লিকেজ থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মসজিদে গ্যাস জমে ওই বিস্ফোরণ ঘটে বলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স প্রাথমিকভাবে জানালেও বিস্ফোরণের কারণ ও দায় এখনো নিরূপণ করা হয়নি।

এই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মার-ই-য়াম খন্দকার জনস্বার্থে রিট আবেদন করলে হতাহত ৩৭ জনের পরিবারকে জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায় পাঁচ লাখ টাকা করে দিতে হাইকোর্ট তিতাস গ্যাস কম্পানিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ওডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেড এবং সরকারের আবেদনে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সেই আদেশ স্থগিত করেন। এই রিটে দায় ও ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে জারি করা রুল এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন।

ওই হতাহতের ঘটনায় করা মামলা তদন্ত করে সিআইডি। তারা ২৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে তিতাস গ্যাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি গুলশানের একটি বহুতল আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর এক দিনের ব্যবধানে রাজধানীর দুটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। প্রথমে সায়েন্সল্যাব এলাকায় এবং সর্বশেষ বিস্ফোরণ হয় পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে। সিদ্দিকবাজারে ভবনে বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ২২ ব্যক্তির মৃত্যুর কথা জানিয়েছে পুলিশ। সায়েন্সল্যাবের একটি বাণিজ্যিক ভবনের তৃতীয় তলায় বিস্ফোরণে নিহত হন তিনজন।

মগবাজার ও সায়েন্সল্যাব এলাকার বিস্ফোরণের পর অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে পুলিশ মামলা করেছে। তবে এসব বিস্ফোরণে কে বা কারা দায়ী, কোনো সংস্থার অবহেলা আছে কি না, তা এখনো নিরূপণ করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা। বিস্ফোরণের দায় ও হতাহতদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকার ও আইনগত সহায়তাকারী বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ যা-ই বলি না কেন, এর দায় শেষ পর্যন্ত সরকার এড়াতে পারে না। কারণ ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি-বিচ্যুতি, অবহেলার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটে।’
জেড আই খান পান্না বলেন, সমন্বিতভাবে ব্যবস্থাপনাগত উন্নতি না হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তবে এখন এসব ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলার সুযোগ থাকছে না। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কাউকে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি-বিচ্যুতি-অবহেলার কারণে অহরহ দুর্ঘটনা, বিপর্যয় ঘটছে। এতে মানুষ জীবন হারাচ্ছে, ব্যক্তি ও পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এসবের দায় কেউ নিচ্ছে না। এমনকি দায় নিরূপণও করা হচ্ছে না।

ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ক্ষতিগ্রস্তরা অবশ্যই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবি রাখে। সর্বোচ্চ দায় থেকে সরকারের উচিত ক্ষতিপূরণ দেওয়া। সরকার দেয় না বলেই উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। তিনি আরো বলেন, ক্ষতিপূরণের চেয়ে বড় হলো, দায় নিরূপণ করে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা।

কারো অন্যায় বা অবহেলার কারণে অন্য কারো আইনগত অধিকার লঙ্ঘিত হলে প্রচলিত টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণের মামলা করা যায়। বিভিন্ন আইনে ক্ষতিপূরণের বিধান থাকলেও টর্ট আইন ছাড়া ক্ষতিপূরণের সুনির্দিষ্ট আইন নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণের বেশির ভাগ মামলা করা হয়েছে জনস্বার্থ বিবেচনায় রিট মামলা। জনস্বার্থ বিবেচনা করে রিট এখতিয়ারে হাইকোর্টের অনেক বেঞ্চ বিভিন্ন সময় ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ দিয়েছেন। আবার অনেক বেঞ্চ দেননি; কিন্তু ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে হলে সংশ্লিষ্ট অধস্তন আদালতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তকে মামলা করতে হবে। তবে হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণের আদেশ বা রায় নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, কোনো একটা ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে কেউ এসে চাইলেই ক্ষতিপূরণের আদেশ দিয়ে দেওয়াটা যথাযথ নয়। ক্ষতিপূরণের কারণ, দায় এবং ক্ষতির ব্যাপ্তি বা পরিমাণ নিরূপণ না করে আদেশ বা রায় দেওয়ায় হাইকোর্টের অনেক আদেশ, রায় আপিল বিভাগে গিয়ে স্থগিত হয়ে আছে।

টর্ট আইনের বিধান নিয়ে এই আইনজীবী বলেন, টর্ট আইনের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া। এই আর্থিক ক্ষতিপূরণ আবার অনির্দিষ্ট। অর্থাৎ ক্ষতির প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও যুক্তিসংগত কারণ বিবেচনা করে আদালত টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেন। ভবন বিস্ফোরণের কারণে হতাহতরা বা তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ চাইতে হবে। তার আগে বিস্ফোরণের কারণ ও দায় নিরূপণ করা জরুরি।

টর্ট আইন ছাড়াও বিভিন্ন আইনে ক্ষতিপূরণের বিধান আছে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ ও শ্রম আইন, ২০০৬-এর উদাহরণ টেনে মনজিল মোরসেদ বলেন, পরিবেশ আইনে তো ক্ষতিপূরণের কথা বলা আছে; কিন্তু ক্ষতিপূরণের জন্য এসব আইনে যেসব কারণের কথা বলা আছে তার বাইরে কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ নেই।

২০২০ সালে ২৭ মে ইউনাইটেড হাসপাতালের মূল ভবনের বাইরে করোনা আইসোলেশন ইউনিটে আগুন লেগে লাইফ সাপোর্টে থাকা পাঁচ রোগীর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনা চেয়ে নিহত রিয়াজুলের স্ত্রী ফৌজিয়া আক্তার, নিহত খোদেজার ছেলে মো. আলমগীর ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নিয়াজ মোহাম্মদ মাহাবুব হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুল দিয়ে নিহত চার ব্যক্তির পরিবারকে ১৫ দিনের মধ্যে ৩০ লাখ টাকা করে দিতে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আবেদন নিষ্পত্তি করে দিয়ে ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল আপিল বিভাগ নিহত চার ব্যক্তির পরিবারকে ২৫ লাখ টাকা করে দিতে নির্দেশ দেন। ৩০ দিনের মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ওই অর্থ দিতে বলা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিহত চার ব্যক্তির পরিবারকে ২৫ লাখ টাকা করে মোট এক কোটি টাকা দেয়। আর সমঝোতার মাধ্যমে নিহত অন্য এক ব্যক্তির পরিবারকে দেয় ২০ লাখ টাকা।

ওই মামলায় রিটকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অনীক আর হক। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ভবন বিস্ফোরণের ঘটনায় জনস্বার্থে ক্ষতিপূরণের মামলা করার সুযোগ আছে। তবে মামলায় এসব বিস্ফোরণের জন্য সরকারি বা রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের দায় নিশ্চিত করতে হয়। তাই এসব বিস্ফোরণের কারণ ও দায় নিরূপণ করাটা সরকারের দায়িত্ব। সরকার তা না করলে জনস্বার্থ বিবেচনায় যে কেউ মামলা করতে পারবে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্তের পরিবারের কেউ মামলাটা করলেই ভালো হয়।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/11/1259830