১১ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১০:৫৮

মধ্যবিত্তের বোবা কান্না

অস্থির ব্রয়লার মুরগি আর শুকনো মরিচের বাজার। শুধু যে ব্রয়লার আর শুকনো মরিচের বাজারে দাম বেড়েছে তা নয়, প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। নিত্যপণ্যের এমন দামের ঝাঁজের সঙ্গে মিলছে না আয়ের হিসাব। পণ্যমূল্যের সঙ্গে পকেটের অবস্থা মিলাতে না পেরে মধ্যবিত্ত হচ্ছে নিম্নবিত্ত, নিম্নবিত্ত হয়ে পড়ছে হতদরিদ্র। দামের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের নাভিশ্বাস। কক্সবাজারের রামু উপজেলার কলঘর বাজারের মুরগির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন সদরের খরুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নজিবুল আলম। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ও মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীরা তেলের দাম বৃদ্ধি করে লুটে নিচ্ছে অর্থনৈতিক ফায়দা। ফলে বাড়ছে নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষদের দৈনন্দিন চাহিদা মিটাতে না পারার হাহাকার। নিত্যপণ্যের এমন আগুন দামে সাধারণ মানুষের বোবা কান্না দেখার কি কেউ নেই? কক্সবাজার শহরের বড় বাজার, বাহারছড়া বাজারসহ সদরের কয়েকটি বাজার ঘুরে জানা গেছে, রমজান মাস আসতে এখনো বাকি ১২ থেকে ১৩ দিন। কিন্তু এই রমজানকে সামনে রেখে এখনই উত্তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে জেলার বাজারগুলো।

অস্বাভাবিক হারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোয় শুধু নিম্নবিত্ত নয়, দুর্বিষহ হয়ে উঠছে মধ্যবিত্তের জীবনও। চাল, ডাল, চিনি, ডিম, তেল সবকিছুরই দাম বাড়ছে লাগামহীন গতিতে। ক্রেতাদের শঙ্কা, রমজানের আগে নিত্যপণ্যের দাম এমন অস্বাভাবিক হলে, রোজার মধ্যে পণ্য কেনা কঠিন হয়ে পড়বে। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, সাগরের মাছ, মুরগি কিংবা গরু বা খাসির মাংস এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কাছে সোনার হরিণের মতোই। যে ডিম, চাষের মাছ আর বয়লার মুরগি ছিল তাদের ভরসা সেখানেও দাম বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ডিম ও বয়লার মুরগি কিনতেও দশবার ভাবতে হচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষের। কক্সবাজারের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে কী পরিমাণ কষ্ট আর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে তাদের মাঝে সে কথা উঠে এসেছে অনেকের চোখের কোণে জমে ওঠা নোনা পানিতে। গত বুধবার কক্সবাজার বাহারছড়া বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের অতিরিক্ত দাম শুনে হতবাক হয়ে পড়েন ক্রেতারা। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবারো বেড়েছে সবজি, গরুর মাংস, ব্রয়লার মুরগি, সয়াবিন তেল ও খেজুরের দাম।

জানা গেছে, সবধরনের মাংসের দাম কেজিতে ৪০-৬০ টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৪০০-৫০০ টাকার নিচে নেই কোনো ভালো মাছ, ২৬০ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগি, ৭৫০ টাকা কেজি গরুর মাংস, ১০০০ টাকা কেজি খাসির মাংস, ভরা মৌসুম থাকলেও চড়া সবজির বাজার। মোটা চালের কেজি ৫৫ টাকা, সয়াবিন তেল ১৭৫-১৮৫ টাকা। অন্য নিত্যপণ্যের দামও বাড়ন্ত। বাজারের এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা অসহায় নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ। কিছু দাম কমানোর আশায় এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরে ঘুরে হয়রান তারা। বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৬০ টাকায়। সোনালি মুরগির কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা। দেশি মুরগি ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে গরুর মাংসের দাম। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকায়। গত দুই সপ্তাহে হালিতে ডিমের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা। এ ছাড়া শীতের সবজির ভালো ফলন থাকলেও পুরো মৌসুমজুড়েই ছিল সবজির চড়া দাম। দুই-একটি ছাড়া বেশির ভাগ সবজির কেজি ৪০ টাকার ওপরে। কোনোটির দাম ১০০ টাকাও ছুঁয়েছে। শুকনো মরিচ এক লাফে ৬০০ ছুঁয়েছে। টমেটো ৩০ টাকা, গোল বেগুন ৫০ টাকা, লম্বা বেগুন ৩০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, শিম ৫০-৬০ টাকা, শসা ৩৫ টাকা, বরবটি ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০, কাঁচামরিচ ১০০ টাকা, রসুন ১১০-১২০ টাকা, গোল আলু ২০ টাকা, দেশি আদা ৮০-১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়াও লাউ ৯০-১০০ টাকা, ব্রুকলি, ফুলকপি, পাতা কপি ৪০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে।

শহরের বড় বাজার এলাকার মুদি দোকানের মালিক ছৈয়দ সওদাগর বলেন, প্রতিনিয়ত ঝগড়া করতে হয় ক্রেতাদের সঙ্গে। দাম কেন এত বাড়লো- এই উত্তর দিতে দিতে আর ভালো লাগে না। খেজুর বিক্রেতা জনু বলেন, রমজানে খেজুরের চাহিদা বেড়ে যায়। এখন আরও চিন্তা বাড়ছে খেজুরের দাম যদি এখনই এত বেশি হয়, রমজান শুরু হলে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে মাছ বাজারও কিছুটা চড়া। বড় বাজারের আব্দু শুক্কুর নামে এক মাছ বিক্রেতা বলেন, বাজারে পর্যাপ্ত মাছের সরবরাহ থাকার পরও খাবারের দাম ও জ্বালানি খরচ বেশি হওয়ায় বাজারে এর প্রভাব পড়ছে। ক্রেতারা এখন বড় মাছ কিনে না। শুধুমাত্র হোটেলগুলোতেই বড় মাছ বিক্রি হচ্ছে। খুব কমসংখ্যক সাধারণ মানুষই বড় মাছ কিনছে।

জাফর আলম নামে এক ক্রেতা বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। সংসার চালানো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ছে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা হিমশিম খাচ্ছি। সবকিছুর দাম এভাবে বাড়তে থাকলে চলার উপায় থাকবে না। কিছুটা কম দামে জিনিস কেনার আশায় বড় বাজারের পাইকারি দোকানে এসেছিলাম। এখানেও দেখি একই অবস্থা। পাইকারি খুচরা সবখানেই প্রায় একই দাম। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, রমজান মাস শুরুর আগেই যদি নিত্যপণ্যের বাজারের এমন অবস্থা হয় তাহলে রমজান মাসে কী পরিস্থিতি হবে! নিত্যপণ্যের বাজার ক্রমশই লাগামহীন হয়ে পড়ায় বাজারে আসা ক্রেতারা ক্ষুব্ধ।


https://mzamin.com/news.php?news=46142