১১ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১০:৫০

দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটছে সিন্ডিকেট

সরকার নির্ধারিত দামে কোথাও ভোজ্যতেল মিলছে না

চট্টগ্রামে ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা কাটেনি। দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে দফায় দফায় বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। এখানে ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর যেন মহোৎসব চলছে। স্বাভাবিক হয়নি চিনির দামও। সরকার নির্ধারিত দামে কোথাও ভোজ্যতেল মিলছে না। একই সঙ্গে লাগামহীনভাবে দাম বাড়ছে চালের।

মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি আড়ত ও খুচরা বাজারে চালের মজুত পর্যাপ্ত। থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বস্তা। তবুও কয়েক মাস ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম।

সপ্তাহের ব্যবধানে আটা-ময়দা, মুরগি ও গরুর মাংস এবং ডিমের দাম আরেক দফা বেড়েছে। মাছ ও মাংসের দাম বাড়ায় ক্রেতারা এখন ঝুঁকছেন সবজির দিকে। ফলে সবজির দামও এখন লাগামহীন। এমন পরিস্থিতিতে গরিব ও নিম্নআয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কয়েকটি সিন্ডিকেট রমজানকেন্দ্রিক ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। তারা (অসাধু ব্যবসায়ীরা) রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সংকটের অজুহাত দেখিয়ে ভোগ্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াচ্ছে। রমজাননির্ভর বিভিন্ন পণ্যের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। রমজান শুরু হওয়া পর্যন্ত দাম আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন ভোক্তারা।

ডলার সংকটের কারণে আমদানি-পরবর্তী কিছু ভোগ্যপণ্যের খালাস নিয়ে জটিলতা তৈরি হলেও এখন সরকারি নানা সিদ্ধান্তের কারণে তা কেটে গেছে। বড় আমদানিকারকরাও নতুন করে এলসি (ঋণপত্র) খুলে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল, চিনি ও ছোলা আমদানি করছেন। রোজায় এসব পণ্যের সংকট হবে না বলে আশা করছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।

চিনির দাম এখনো স্বাভাবিক হয়নি। আমদানিকারকদের দাবির মুখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটন অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে তিন হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনিতে ছয় হাজার টাকা আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু চিনির বাজারে এসবের কোনো প্রভাব নেই। অতিরিক্ত দামেই বিক্রি হচ্ছে চিনি। এখনো খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি খোলা চিনি ১১৫ থেকে ১২০ এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২ থেকে ১২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লাল চিনি (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দামে। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে চিনির দাম প্রায় ৪৯ শতাংশ বেড়েছে।

ভোজ্যতেলের বাজার প্রায় দশ মাস ধরে অস্থির। সরকার বারবার এই পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। সরকার নির্ধারিত দামে মিলছে না ভোজ্যতেল। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পাইকারি বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দর দুই-এক টাকা করে বাড়ছে। খুচরা বাজারেও এর প্রভাব দেখা গেছে। সরকার প্রতি লিটার খোলা পাম অয়েলের দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করলেও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। একইভাবে সরকার নির্ধারিত ১৬৭ টাকার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭২ থেকে ১৭৫ টাকা। তবে বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটার নির্ধারিত ১৮৭ টাকায় বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

রমজানে ইফতারি তৈরিতে সাধারণত ছোলা, ডাল ও বেসন বেশি ব্যবহার হয়। রোজার দুই সপ্তাহ বাকি থাকলেও এরই মধ্যে বেড়ে গেছে এসব পণ্যের দাম। গত এক মাসে ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। সপ্তাহখানেক আগে ছোলার কেজি ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। মানভেদে এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। ছোলার সঙ্গে ছোলাবুটের দরও বেড়েছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এ মানের বুট কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। প্রতিকেজি ছোলাবুট বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা দরে। পিছিয়ে নেই ডালও। একই সময়ে এ ডাল কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এছাড়া বেসনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা।

গত বছর পাকিস্তানি ডাল বিক্রি হয়েছিল ১৪০ থেকে ১৬০ কেজিদরে। এবার বিক্রেতারা এ মানের কাবলি ডাল কেজি হাঁকছেন ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। সে হিসাবে গত বছরের চেয়ে এবার প্রতিকেজি কাবলি বুট কিনতে ক্রেতাকে অতিরিক্ত খরচ করতে হবে ৯০ থেকে ১০০ টাকা।

স্বস্তি নেই চালের বাজারেও। সরকার বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করলেও বাজারে এর প্রভাব নেই। এক সপ্তাহে বেড়েছে চালের দাম। প্রতি বস্তা মোটা সিদ্ধ চালের দাম ছিল ২ হাজার ২০০ টাকা। চলতি সপ্তাহে তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩০০ টাকা। সিদ্ধ মিনিকেটের দাম আগে ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা। এ সপ্তাহে তা ২ হাজার ৯০০ টাকা। গুটি স্বর্ণার দাম ছিল ২ হাজার ২০০ টাকা, এখন ২ হাজার ৩০০ টাকা। ইন্ডিয়ার স্বর্ণার দাম ২ হাজার ৩০০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ৪০০ টাকায় উঠে গেছে। এছাড়া গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে পারি সিদ্ধ জাতের চালের দাম ২ হাজার ৪৫০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৫০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী কামরুল হাসান বাপ্পি যুগান্তরকে বলেন, রমজান মাসে যেসব ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেশি থাকে সেসব পণ্যের দাম আমদানিকারকরা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে আড়তদার বা পাইকারদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে রমজানে পণ্যের সংকট হবে না। পর্যাপ্ত ভোগ্যপণ্যের মজুত রয়েছে।

বাজারদর : চট্টগ্রামে মাংসের পাশাপাশি বেড়েছে সবজির দামও। ব্রয়লার মুরগির দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এখন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। সোনালি মুরগি ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা, দেশি মুরগি ৫৩০ থেকে ৫৫০ টাকা, হাড়ছাড়া গরুর মাংস ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা, হাড়সহ গরুর মাংস ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা ও খাসির মাংস ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডজন ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা। মাছের বাজারে আকারভেদে রুই ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা, কাতলা ২৩০ থেকে ৩২০ টাকা, তেলাপিয়া ১৬০ থেকে ২৫০ টাকা, রূপচাঁদা ৫৫০ থেকে ৭৫০ টাকা, পোয়া মাছ ১৯০ থেকে ২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নগরীর কাঁচাবাজারগুলোতে আলু বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ২০-২২ টাকা, ফুলকপি ২৫-৩০ টাকা, বাঁধাকপি ১৫-২০ টাকা, বেগুন ২৫-৩৫ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৩০-৩৫ টাকা, টমেটো ২০-২৫ টাকা, পেঁপে ২৫-৩০ টাকা, শসা ২৫-৩৫ টাকা, শিম ৩৫-৪৫ টাকা, গাজর ২০-২৫ টাকা, মুলা ১৫-১৮ টাকা, লাউ কেজি ২৫-৩০ টাকা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/653212