১১ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১০:৪৯

এত দুর্ঘটনা তবু কারো টনক নড়ে না

সারা দেশে এত দুর্ঘটনা! তবু কারো টনক নড়ে না। সব দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কিছুদিন নানা পক্ষ থেকে হইচই হয়ে থাকে। সেমিনার হয়, সিম্পোজিয়াম হয়। সরকারি পক্ষ থেকে একগাদা পরিকল্পনা পেশ করতে শোনা যায়। কিন্তু এরপর আর এ ব্যাপারে সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। পরে আবারো দুর্ঘটনা ঘটে, আবারো প্রাণহানি ঘটে, আবারো আলোচনা ও সমালোচনা হয় এবং এক সময় নীরব হয়ে যায় সবাই। ফলে দুর্ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত ও সমস্যাগুলোর সমাধান হয় না। এ যেন বাংলাদেশের মানুষের নিয়তি।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো: এমদাদুল ইসলাম এ ব্যাপারে নয়া দিগন্তকে বলেন, রাজধানী ঢাকাতেই দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে এবং প্রাণহানিও বেশি হচ্ছে। আবাসিক অথবা বাণিজ্যিক দু’ ধরনের ভবনেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এত দুর্ঘটনার পরও ঢাকা অথবা প্রধান প্রধান শহরের ভবনগুলোর কোনো ডাটাবেস নেই উন্নয়ন-নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর কাছে। তিনি এ ব্যাপারে বলেন, ঢাকার ইমারত নির্মাণে এবং উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত রাজউকের কাছেই তাদের দেয়া প্ল্যানগুলো ডাটাবেসে সংরক্ষিত নেই। ফলে কোনো ভবনে দুর্ঘটনা ঘটলে সে ভবন সম্পর্কে রাউজক তাৎক্ষণিক কোনো তথ্য দিতে পারে না। যেমন রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে দুর্ঘটনাকবলিত ভবনটি সম্বন্ধে এখনো রাজউক থেকে তথ্য দিতে পারেনি যে, ভবনটির অনুমোদিত তলা কয়টি। একটি কম্পিউটার ড্যাটাবেস থাকলে যেকোনো ভবন সম্বন্ধে সবাই জানতে পারতো এবং পরিদর্শনে ঝুঁকিপূর্ণ প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া যেত।

তিনি বলেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অধিকাংশ ভবনই অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয় না। রাজউকের সাবেক এই প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ঢাকার ভবনগুলোর বেশির ভাগ ভবনেরই অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (বসবাসযোগ্য হলে অনুমতিপত্র) নেই। কারণ বেশির ভাগ ভবনই অনুমোদিত নকশায় নির্মাণ করা হয় না। অনুমোদিত নকশায় ভবন নির্মাণ না করে মালিকের ইচ্ছায় নির্মাণ করায় ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। আবাসিক ভবন নির্মাণ করলেও পরে তা বাণিজ্যিক হয়ে যাচ্ছে। আবার সিটি করপোরেশনও আবাসিক ভবনেই বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্সও দিয়ে দিচ্ছে। পুরান অথবা নতুন ঢাকার সর্বত্রই একই অবস্থা। ফলে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণই থেকে যায়। মো: এমদাদুল ইসলাম বলেন, ঢাকা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। যেকোনো মুহূর্তে এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। এখানে যেভাবে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে, একটি বড় ভূমিকম্প হলে আগুনেই পুড়ে যাবে দুর্ঘটনাকবলিত মানুষগুলো। সময় এসেছে, ভবনের সার্বিক নিরাপত্তা ও অগ্নিনিরাপত্তা রোধে ব্যবস্থা নেয়ার। মো: এমদাদুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় কিভাবে এবং কোথা থেকে আগুন লাগছে ও বিস্ফোরণ হচ্ছে, তা বরাবরই রহস্যাবৃত থেকে যাচ্ছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না বললেই চলে। ফায়ার সার্ভিস মাঝে মধ্যে ঘটনা বিশ্লেষণ করে বলে থাকে যে, শর্টসার্কিট, গ্যাস লিকেজ, স্যুয়ারেজ লাইনে জমাকৃত গ্যাস থেকে আগুন বা বিস্ফোরণ হয়েছে। তবে যে সূত্র থেকেই আগুন লাগুক, আগুন লাগার অন্যতম কারণ ত্রুটিপূর্ণ ইমারত এবং ইমারতে বিভিন্ন দাহ্য যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই আগুনটি লাগছে। ইঞ্জিনিয়ার এমদাদুল ইসলাম বলেন, যে ভবনে দাহ্য পদার্থ রয়েছে সেখানে সে যন্ত্রপাতিগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না। বিশেষজ্ঞ দিয়ে অথবা দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের লোকদের নিয়ে দাহ্য পদার্থগুলো পরীক্ষা করিয়ে নিলেই দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। এ ব্যাপারে সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বই বেশি।

ঢাকায় ইদানীং ইমারতে বিস্ফোরণ একটি নতুন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। তার সাথে নগরীর সর্বত্র রয়েছে লক্ষাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত ও স্থাপনা। কয়েক বছর আগে পুরান ঢাকার নিমতলী ও চুড়িহাট্টায়, মগবাজারে আগুন লেগে প্রাণহানি ঘটেছে তা এখনো মানুষের স্মৃতিতে রয়েছে। সায়েন্স ল্যাবের পাশের গলিতে এবং দু’দিন আগে ফুলবাড়িয়ার সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে আগুন লেগে অনেকগুলো মানুষ নিহত-আহত হওয়াসহ অনেকে চিরতরে পঙ্গুও হয়ে গেছেন। এসব দুর্ঘটনার পর তদন্ত হয়েছে, কিন্তু তদন্তের কোনো প্রতিবেদন আজ অবধি আর জনসম্মুখে আসেনি। প্রতিটা দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে দায় এড়ানোর প্রবণতা রয়েছে।

সাম্প্রতিককালে এসব দুর্ঘটনার বেশির ভাগই পুরান ঢাকায় ঘটেছে যেখানে রয়েছে অনেক পুরনো ভবন। কোনোটা এক শ’ বছরের পুরনো। ঢাকার সর্বত্র ঢাকা ওয়াসার পানি ও পয়ঃপ্রণালী, তিতাস গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো একটি সংস্থার কাছেও এসব সার্ভিসেসের ‘এজ বিল্ডিং’ ড্রয়িং নেই। আবার অনেক বাসার নিচে রয়েছে পুরনো বা পরিত্যক্ত সেপটিক ট্যাংকও। অতঃপর কখনো কোনো সংস্থার নিকট থেকে এসব লাইনের সংস্কারের কথাও শোনা যায় না, বরং অনেক জায়গায় এসব লাইনের ওপর বা আশপাশে এমনকি পরিত্যক্ত সেপটিক ট্যাংকের ওপর নতুন নতুন ইমারত নির্মিত হয়েছে এবং আবার অবৈধভাবে এগুলোর সম্প্রসারণও হয়েছে। কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জে তিতাসের এ রকম একটি পরিত্যক্ত লাইনের ওপর নির্মিত মসজিদে গ্যাসের বিস্ফোরণে অনেক মুসল্লি নিহত ও আহত হয়েছেন। নিমতলী এবং চুড়িহাট্টায় আকস্মিক বিস্ফোরণে দুই শতাধিক মানুষ মারা গেলেও সেখানকার অলিগলিতেও এখনো কেমিক্যাল ব্যবসা ও গোডাউন রয়েই গেছে।

ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবগুলো দুর্ঘটনার তদন্তের সুপারিশ এখনই বাস্তবায়ন করা উচিত বলে দাবি করেছেন ইঞ্জিনিয়ার মো: এমদাদুল ইসলাম।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/733401