১১ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১০:৪৮

রমযান আসার আগেই নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি

-সাধারণ মানুষ দিশেহারা

রমযান আসার আগেই রাজধানীর বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি -সংগ্রাম

ইবরাহীম খলিল : পবিত্র রমযান মাস আসতে আর কয়দিন বাকি। এরই মধ্যে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত নিত্যপণ্যের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়েই যত চিন্তা দরিদ্র ও নি¤œবিত্ত মানুষের। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বাজারগুলোতে বাড়তি দামে বেশ কয়েকটি পণ্য বিক্রি হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়তি দামে কিনতে হবে সেই দুঃচিন্তা মানুষের মধ্যে। সীমিত আয়ের মানুষগুলো কিভাবে সামনের দিনগুলো সামাল দিবে সেটাই ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। বিশেষ করে রমযান মাসে মানুষের মধ্যে যে বাড়তি কিছু চাহিদা সৃষ্টি হয় সেসব পণ্যের দাম বেশি বাড়বে বলে শঙ্কা মুসলমানদের মধ্যে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পবিত্র রমযান এলে ইফতারি তৈরিতে সাধারণত ছোলা, অ্যাংকর ডাল, বেসনের বেশি ব্যবহার হয়। গত কয়েকদিনে এসব পণ্যের দাম হু হু করে বেড়েছে। এমনকি শরবত তৈরির জন্য যে ট্যাং লাগে বাজারে সেটার এখন রীতিমতো সংকট।

যেসব দোকানে পাওয়া যাচ্ছে, তারাও বিক্রি করছেন গত রমযানের থেকে কেজিপ্রতি প্রায় ২০০ টাকা বাড়তি দামে। বর্তমান বাজারে ট্যাং ১৪০০-১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

এদিকে বাজারে গত এক মাসে ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। মাসখানেক আগে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা দরে, যা এখন ৯৫-১০০ টাকা। আগে থেকে বাড়তি চিনি, তেল, আটা-ময়দার দাম কমেনি। ছোলার সঙ্গে ছোলাবুটের দামও বেড়েছে ৫-১০ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি ছোলাবুট বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। এছাড়া অ্যাংকর ডাল কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়ে ৭০-৮০ টাকা এবং একইভাবে বেসনের দাম বেড়ে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

গত কয়েক মাস ধরেই বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে তেল-চিনি মিলছে না। বেঁধে দেয়া দামে প্রতি লিটার খোলা পাম তেল ১১৭ টাকায় বিক্রির কথা থাকলেও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। একইভাবে সরকার নির্ধারিত প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকার পরিবর্তে বিক্রি হচ্ছে ১৭২ থেকে ১৭৫ টাকায়। খোলা চিনির ক্ষেত্রে নির্ধারিত দাম ১০৭ টাকা হলেও এখনো খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লাল চিনি (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দামে। মসলার বাজারে আদা-রসুনের বাড়তি দাম কমেনি। উল্টো পেঁয়াজের দাম সপ্তাহ ব্যবধানে ৫ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে মাছ-মাংস এখন অনেকটাই স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মুরগির বাজার এক-দেড় মাস ধরেই অস্থির। দফায় দফায় বেড়ে ব্রয়লারের কেজি এখন ২৫০-২৫৫ টাকা। সোনালি জাতের মুরগির কেজি ৩৪০-৩৫০ টাকা। মাসের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম প্রায় ৫০ টাকা বেড়ে এখন প্রতি কেজি ৭৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে মানভেদে রুই-কাতলার কেজি হয়েছে ৩৫০-৪০০ টাকা। চাষের তেলাপিয়া পাঙাশও ২০০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না।

রোজা শুরুর আগেই সবজির বাজারে বেড়ে গেছে লেবুর দাম। এক হালি লেবু আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৮০ টাকা পর্যন্ত। একই কারণে বাড়ছে বেগুনের দামও। গোল বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকা দরে। তবে লম্বা বেগুন ৫০-৭০ টাকা, যা সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ২০ টাকা বেড়েছে।

রমযানের আগেই দাম বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে নি¤œ ও নি¤œমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। প্রতিবারই রমযান এলে সরকারের সংশ্লিষ্টরা সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করেন। বলা হয়, রমযানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোরভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করা হবে। বলা হয়, রমযানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে। কিন্তু বাস্তবতা তথৈবচ। আদতে হয় না এসবের কোনোকিছুই। ঘটে না আশ্বাসের প্রতিফলন। ফলে উদ্বেগ বাড়ছে নি¤œআয়ের মানুষের। প্রতিদিনের ডাল-ভাতের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে চুপচাপ বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
মালিবাগ বাজারে কথা হয় বেসরকারী চাকরিজীবী বদিউল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিদিনই বউ (স্ত্রী) বলে রোজার জন্য চিনি-ছোলা-ডাল কিনে রাখতে। প্রতিদিনই ভাবি নেবো। কিন্তু কোনোদিনই প্রয়োজনের সব বাজার করে ঘরে ফিরতে পারি না। বাড়তি কেনা তো অনেক দূর।

রাজধানীর রামপুরা বাজারের ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেনের অভিয্গো, রমযান ঘনিয়ে আসছে। তাই বেগুন-লেবুর চাহিদাও বেড়েছে। অনেকে রমযানের আগেই বেশি পরিমাণে কিনে ঘরে মজুত রাখছেন। এ কারণে বাজারে চাহিদা বাড়ায় দামও বেড়েছে।
অদৃশ্য এসএমএসে বাড়ে মুরগির দাম !

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, 'ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৬৭ টাকা হলেও তা ২৫০ টাকা কেজি কেন? এই মুরগির দাম বাড়ার কারণ সিন্ডিকেট, করপোরেট গ্রুপ ও অদৃশ্য এসএমএস। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সমগ্র দেশে অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে বাজার অস্থিতিশীল করছে। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়াতে হবে। আমরা তা খতিয়ে দেখব। পাইকারি ও খুচরা পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারে অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। কাজী ফার্মের প্রতি কেজি মুরগির পেছনে খরচ হয় ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। তারা পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করছে ১৯০ থেকে ২০৭ টাকায়। এত বেশি লাভ করায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘এটাই কি তাদের আসল উৎপাদন খরচ না আরও কম, তা খতিয়ে দেখা হবে। তারপর সবার সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘দোকানে অবশ্যই মূল্যতালিকা থাকতে হবে, ক্রয়-বিক্রয় রশিদ থাকতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে বাজার কমিটিকে দায়ী করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে ব্যবসা করতে হবে। যাতে বাজার অস্থিতিশীল না হয়।’

তিনি পোল্ট্রি মুরগির মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার বিষয় খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে অনুরোধ করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনকে পোল্ট্রি মুরগির কেজি ২৫০ টাকা বিশ্লেষণ করার জন্য অনুরোধ জানান।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে এবং কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থিতিশীল না করার অনুরোধ জানান। তা ছাড়া, সকলে সম্মিলিতভাবে কাজ করে ভোক্তাদের সঠিক দামে সঠিক পণ্য পাওয়ার ব্যবস্থা করতেও তিনি অনুরোধ জানান। অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের আইন মেনে যৌক্তিক মূল্যে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে।

সভায় পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার অভিযোগ করেন, ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয় এক অদৃশ্য এসএমএসের মাধ্যমে। তারা করপোরেট কোম্পানিকে রাতেই দাম জানিয়ে একটি এসএমএস করেন। পরে সকালে করপোরেট কোম্পানিগুলো মুরগি ও ডিমের মূল্য দিয়ে দেশের বিভিন্ন বাজারে এসএমএস মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন।

https://dailysangram.com/post/518920