১০ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৩৩

আগুন, বিস্ফোরণ

মামলা হয়, সাজা হয় না

ভবন ধস, অগ্নিকাণ্ড, ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেই চলছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়, বছরের পর বছর তদন্ত হয়। চার্জশিট হয়। সাক্ষ্য শুরু হলেও আর শেষ হয় না। এমনকি এসব ঘটনা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটও হয়। পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একটি, আশুলিয়ার তাজরীন পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড নিয়ে দুটি, গাজীপুরের ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় অগ্নিকাণ্ড নিয়ে একটি, চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড নিয়ে ৪টি এবং নারায়ণগঞ্জ শহরের তল্লা এলাকায় মসজিদে বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় একটিসহ মোট ৯টি রিট হয়। রিটের ফলে হাইকোর্ট বিভিন্ন ঘটনায় বহু নির্দেশনা দেন। কিন্তু নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয় না। এসব ঘটনার এখনো বিচার শেষ হয়নি। এ ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট এডভোকেট মনজিল মোরসেদ মানবজমিনকে বলেন, আগুন, বিস্ফোরণ, ভবন ধসের ঘটনায় মামলা হয়।

কোনো মামলায় দ্রুত চার্জশিট হয়। আবার কোনো মামলার চার্জশিটে লাগে বছরের পর বছর। এতকিছুর পরও বিভিন্ন ব্যক্তিদের অবহেলাজনিত কারণ উল্লেখ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। কিন্তু নানা কারণে দায়ীদের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষী দিতে না আসায় রায় হয় না। সাজার নজিরও দেখা যায় না। আর এ কারণে দেশে অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, কোনো একটি দুর্ঘটনা ঘটলেই শুধু ভবন মালিক ও দোকান মালিকদের দায় দেয়া হয়। কিন্তু সরকারের যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই নেগলিজেন্স দেখার দায়িত্বে ছিল তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা কমে যাবে।

আইন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকার বাণিজ্যিক ভবন শিরিন ম্যানশনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের আগে একাধিকবার আগুনের ঘটনা ঘটেছে। ভবনের পশ্চিম পাশ লাগোয়া স্যুয়ারেজের লাইনে মাঝেমধ্যে আগুন লাগলেও সেটিকে গুরুত্ব দেননি ভবন মালিক। নেয়া হয়নি সংস্কারের উদ্যোগও। ফলে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বছরের পর বছর ধরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলে আসছিল ভবনটিতে। ভবনটির উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে স্যুয়ারেজের প্রধান লাইন গেছে। ওই স্যুয়ারেজের লাইনের সঙ্গেই ভবনটির ৩ তলার ৩টি টয়লেটের লাইনের সংযোগ দেয়া হয়েছে। ওই সংযোগ থেকে অনেকবার আগুন লেগেছে। বালু ও পানি দিয়ে আগুন নেভানো হয়েছে। বিচারহীনতার কারণে ভবন মালিক বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। যদি আগের দুর্ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো তাহলে মালিক এসব ত্রুটি দ্রুত সমাধান করতেন।

রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান ১১৩৬ জন: ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ৮ তলা রানা প্লাজা ধসে নিহত হন ১ হাজার ১৩৫ জন। প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় আরও হাজার খানেক গার্মেন্ট শ্রমিককে। বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে যাওয়া সেই ঘটনার দিনই সাভার থানায় দুটি মামলা হয়। প্রথমটিতে হতাহতের ঘটনা উল্লেখ করে ভবন ও কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন সাভার মডেল থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ। ‘অবহেলা ও অবহেলাজনিত হত্যার’ অভিযোগে মামলা দায়েরের ২ বছর পর ২০১৫ সালের ২৬শে এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে। ২০১৬ সালের ১৮ই জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এ মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুল মানবজমিনকে বলেন, রানার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের মামলায় সাক্ষীরা থাকে ভাসমান। তাদেরকে আদালতের ধার্য তারিখে পাওয়া যায় না। সাক্ষী না আসলে তো আদালতের তেমন কিছু বরার থাকে না। যথাসময়ে যাতে আদালতে সাক্ষী হাজির করা যায় সেই ব্যবস্থা ও দায়িতরতদেরকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।

নিমতলীতে মারা যান ১২৪ জন: ২০১০ সালের ৩রা জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ১২৪ জন প্রাণ হারান। কয়েকশ’ ব্যক্তি আহত হন। অনেকে তাদের প্রিয়জনকে হারান, আবার অনেককে করে দেয় সহায়-সম্বলহীন। এ ঘটনা সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পরও কোনো মামলা হয়নি। দোষী করা হয়নি কাউকে। ২০২১ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। শুধু ঘটনার কথা উল্লেখ করে বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল। নিয়ম হচ্ছে, কোনো ঘটনায় জিডি হলে পুলিশকে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হয়। কিন্তু এত বছর পরও প্রতিবেদন দেয়নি পুলিশ। উল্টো জিডির নথিপত্রও এখন থানায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এ ঘটনায় ঢাকা শহরে অগ্নিকাণ্ড রোধে পর্যাপ্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা নিয়ে ওই বছরের ১০ই জুন উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ১০ই জুন হাইকোর্ট রুল দিয়ে ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল করাসহ কয়েক দফা নির্দেশনা দেন। প্রতিবেদনে ১৭টি সুপারিশ করা হয়। এরমধ্যে ছিল জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা রাসায়নিকের কারখানা সরিয়ে নেয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া ও আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুতকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু আজও সেই নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয়নি।

চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুন, নিহত ৭১: নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে পুড়ে মারা যান ৭১ জন। আহত হন আরও অনেকে। এ ঘটনায় মামলা হয়। ওই ঘটনার পর পৃথক ৪টি রিটও হয়। আদালতের কাছে রাসায়নিকের উৎপাদন, ব্যবহার, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণে আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চাওয়া হয় রিটে। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুল দেন। শুনানিকালে আদালত বলেছিলেন, নিমতলীর ঘটনায় ২০১০ সালে কমিটি সুপারিশ করলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি। ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়, সুপারিশ হয়। তবে সুপারিশ আলোর মুখ দেখে না। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন ও মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় দরকার। সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে ৮০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। চুড়িহাট্টার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিল্পকারখানার জন্য সেফজোন গড়তে নীতি প্রণয়নে নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না রিট করেন। ঢাকা থেকে কেমিক্যাল কারাখানা, গুদাম ও সিলিন্ডার অন্যত্র সরানোর নির্দেশনা চেয়ে অপর একটি রিট করেন সেখানকার বাসিন্দা জাবেদ মিয়া। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। ২০২২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ এই আগুনের ঘটনায় করা মামলায় ভবনের মালিক দুই ভাই মোহাম্মদ হাসান সুলতান ও হোসেন সুলতানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ।

তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন নিহত: ২০১২ সালের ২৪শে নভেম্বর রাতে রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ১১২ জন নিহত হন। আহত হন ১৪১ শ্রমিক। এ ঘটনায় মামলা হয়। মামলায় ১০৪ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০১৫ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির এমডিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। তবে সাক্ষী হাজির না করতে পেরে বারবার সময় নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয়- তাজরীনের এমডি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম। আদালত ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তবে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় শেষ হচ্ছে না বিচার। এ ঘটনার পর আসক, ব্লাস্ট, নিজেরা করি ও ব্র্যাক জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা চেয়ে তখনই হাইকোর্টে রিট করে। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একইসঙ্গে সারা দেশের পোশাক কারাখানার তালিকা, আইন ও বিধি মেনে কারাখানাগুলো চলছে কিনা এবং অগ্নিকাণ্ড থেকে শ্রমিকদের সুরক্ষায় কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এসব জানিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। তাজরীন ট্র্যাজিডির ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে কারখানা মালিক দেলোয়ারসহ কয়েকজন কারখানা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় ২টি আলাদা মামলা করেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে পুলিশ কারখানা মালিক দেলোয়ারসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলা ২টি বর্তমানে ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত ১-এ চলমান রয়েছে। লাগাতার শ্রমিক নেতাদের দাবির মুখে এখন পর্যন্ত মামলায় ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। মামলার আসামিরা সবাই জামিনে মুক্ত আছেন। মামলার অগ্রগতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা।

https://mzamin.com/news.php?news=46037