১০ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৩০

‘বিস্ফোরণ-দুর্ঘটনার বড় কারণ অব্যবস্থাপনা’

নগরে একের পর এক দুর্ঘটনা। ভারী হচ্ছে মানুষের মৃত্যুর মিছিল। বাড়ছে স্বজনদের আহাজারি। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণে ফের আলোচনায় নগর ব্যবস্থাপনা। কেন নগরে এসব দুর্ঘটনা হচ্ছে। এতে দায়ই বা কার? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগর অব্যবস্থাপনাই এসব দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। শহরে আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠছে বাণিজ্যিক ভবন। আবার একই ভবনের মিশ্র ব্যবহার হচ্ছে। এক ভবন থেকে অন্য ভবন কিংবা রাস্তার যে দূরত্ব থাকার কথা তাও মানা হচ্ছে না। এতেও দুর্ঘটনার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এছাড়া সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকির অভাবেও এই দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন তারা।
সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ১৯৯২ সালে একতলা নির্মিত হয়। সেখানে কুইন ক্যাফে নামে একটি রেস্তরাঁ ছিল। এর রান্নাঘর ছিল ভবনের বেইজমেন্টে। রান্নাঘরে ছিল কমার্শিয়াল গ্যাসের বড় লাইন; যা পরবর্তীতে লিখিত আকারে তিতাসের কাছে সমর্পণ করা হয়। বিস্ফোরণের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যবেক্ষণ বলছে, ওই ভবনের আগের রান্নাঘরের গ্যাসের লাইনটি সারেন্ডার করলেও পুরো ভবনে ছিল আবাসিক গ্যাস লাইন। বেইজমেন্টে পার্কিংয়ের কথা থাকলেও সেখানে বাংলাদেশ স্যানিটারি নামে একটি কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠান ছিল। প্রায় ১৮০০ স্কয়ার ফিটের এ আন্ডারগ্রাউন্ডটি পুরোটাই কাঁচে ঘেরা। সেখানে কোনো ভ্যান্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না। বড় দু’টি এসির মাধ্যমে ঠাণ্ডা রাখা হতো দোকানটি।

সম্প্রতি যে ভবনগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটেছে তার সবগুলোই বাণিজ্যিক ভবন। তবে এসব ভবনে মিশ্র ব্যবহার বেশি দেখা গেছে। একই ভবনের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যবহার, খাবার রেস্টুরেন্ট, বসতবাড়ি; সবমিলে পরস্পরবিরোধী কিছু ব্যবহার একসঙ্গে থাকে তখন তার দুর্বলতা বেড়ে যায়। মগবাজার, গুলিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান।

তিনি বলেন, আমাদের নগর পরিকল্পনার ডিসিপ্লিনটাই মূলত তৈরি হয়েছিল এ ধরনের (বিস্ফোরণ) বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে। এক্ষেত্রে ডেজিগনেটেড ইউজ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ব্যবহারগুলো থাকবে। এবং যেটা একে অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না। তাহলে এ ধরনের বিপদ অনেকাংশে কমে আসবে। একটা আবাসিক এলাকায় হঠাৎ করে যদি কারখানা হয়ে যায় বা কোনো একটা ভবনে যদি কারখানা হয়ে যায় কিংবা রাসায়নিক গুদাম হয়ে যায়, তখন নগরে আমাদের জীবনযাপনে হুমকি বেড়ে যায়। এটা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঝুঁকিটা বাড়তেই থাকবে।

ঢাকায় গত এক দশকের নগরায়নের প্রক্রিয়ায় এই ধরনের মিশ্র ভূমির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশে যেহেতু নিয়ন্ত্রণটা দুর্বল তাই এই মিশ্র ভূমি ব্যবহার অতি বিপদজ্জনক। আমাদের পরামর্শ থাকবে এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারগুলোকে সব সময় আলাদা করে ফেলতে হবে। কারখানা, রাসায়নিক গুদামগুলো আলাদা আলাদা জোনে নিয়ে যেতে হবে এবং সেখানে অন্যকিছু করা যাবে না। এগুলো পরিকল্পনার বেসিক ধারণা। এতে আবার ফেরত যেতে হবে। মিশ্র ব্যবহার করারও কিছু নিয়মকানুন আছে। সেগুলো মেনে তারপর মিশ্র ব্যবহার করতে হবে।

আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, পরিকল্পনার আরেকটা মূল স্ট্যান্ডার্ড উঁচুতল ভবন বানানোর ক্ষেত্রে তার সঙ্গে রাস্তার দূরত্ব, পার্শ্ববর্তী ভবনের দূরত্ব এগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব না মানার কারণে যে ভবনে বিস্ফোরণ হচ্ছে তা দ্রুত পাশের ভবন কিংবা রাস্তায় চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের সেবা সংস্থার যতগুলো সেবা আছে তার নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন। গ্যাসের লিকেজ, সুয়ারেজ লাইনের লিকেজ কিংবা এসির রক্ষণাবেক্ষণ না থাকে তাহলে ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এসব তদারকির জন্য শুধু ভবন মালিকের দায় দিয়ে হবে না। তদারকির জন্য আমাদের যে কর্তৃপক্ষ আছে তাদের নজর রাখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের প্রফেসর ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সায়েন্সল্যাবের ঘটনায় আবাসিক এলাকায় কীভাবে এই ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়া হয়। এই দায়িত্ব কে নেবে। এই দায়িত্ব অবশ্যই রাজউক বা অন্যান্য সংস্থা যারা এগুলোকে মনিটরিং করে তাদের। সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে, বেইজমেন্টের কলাম পর্যন্ত ভেঙে গেছে। তিতাস গ্যাস বলছেÑ এখানে লিক থেকে নির্গত গ্যাস জমা হয়ে এই ধরনের বিস্ফোরণ হতে পারে না, এসি থেকেও এই ভয়াবহ বিস্ফোরণ হতে পারে না। তিনি বলেন, সিদ্দিক বাজারের ওই ভবনের বেইজমেন্টে ফাঁকা থাকবে। কিন্তু সেখানে দোকান দেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে রাজউক এই দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যেতে পারে না। দুর্ঘটনার পরে যে অপারেশন হলো সেখানে বিস্ফোরণে উদ্ধারকর্মীদের হতাহতের ভয়ে রাত ৮টার পর উদ্ধার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। পরদিন সকাল ৮টায় অভিযান চালানোর কথা। রাজউকের একজন ইঞ্জিনিয়ার এসে ক্লিয়ারেন্স না দেয়ার কারণে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল তিন ঘণ্টা বৃথা দাঁড়িয়ে থাকে। এই সব উদ্ধারকাজে যারা জড়িত আছে তাদের মধ্যে উদ্ধার ও যোগাযোগে কতোটা অভাব তা এতে লক্ষ্য করা যায়।

মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, সবকিছু মিলিয়ে আমরা দেখতে পাই ব্যবস্থাপনার ত্রুটি আছে। দাহ্য পদার্থের মজুত, রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের নিয়োজিত না করা। এসব মনিটর না করার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া যারা এসব মনিটর করবে তাদের কতোটুকু জনবল রয়েছে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। এখন তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। কিন্তু আমাদের দেশে যেসব এডভান্স ডিটেকটিং মেকানিজম ডিভাইস দরকার সেগুলো নেই। আর থাকলেও তা ব্যবহারের প্রশিক্ষিত টিম আমরা তৈরি করতে পারিনি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ রহমান মানবজমিনকে বলেন, কর্তৃপক্ষ থেকে প্ল্যান পাস এপ্রুভাল নিয়ে সে অনুযায়ী বিল্ডিং করার পর সেটার মেইনটেইন্স ও বাকি সব দায়িত্ব যে বিল্ডিং ব্যবহার করে তার উপরে। অন্য কারও দেখা কতোটুকু সম্ভব। ভবনের তদারকির দায়িত্ব তো সেই মালিকের উপরেই। এখন ১০ বছর পরে সেই ভবনের কোথায় কি হয়েছে। সেটার লাইনের কি অবস্থাÑ এটা তো বাসায় যারা কাজ করছেন তাদের তদারকি ছাড়া সম্ভব নয়। তাই যে বিল্ডিং ব্যবহার করেছে তার তদারকির প্রয়োজন আছে। ঢাকায় যে পরিমাণ বিল্ডিং আছে তা কি অবস্থায় আছেÑ কোনো কর্তৃপক্ষের কাছেই এটি দেখা সম্ভব না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সিদ্দিক বাজারের ঘটনাটি তিতাসের গ্যাস লাইনের লিক, এলপিজি গ্যাস লিক কিংবা স্যুয়ারেজ থেকেও হতে পারে। তবে বেশির ভাগ বিস্ফোরণ এই স্যুয়ারেজের জমে থাকা বায়োগ্যাস থেকেই হচ্ছে। আমরা সবাই একটা বোমের উপর বসে আছি। স্যুয়ারেজের সেপটিক ট্যাংকের গ্যাস বের হওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে সেটা জমতে থাকে। এটাকে আমরা বায়োগ্যাস বলি। এটা প্রতিনিয়ত তৈরি হয়। এটা যদি কোনো রুমের মধ্যে জমা হতে থাকে তখন একটা পর্যায়ে সেখানে ছোট একটা স্পার্ক পেলে বিস্ফোরণ হয়। এসব বিষয় আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এগুলো তদন্ত করলে বের করা যায়।

তিনি বলেন, ভবনের যারা পারমিশন দেয় তারা স্যুয়ারেজের এই বিষয়টা দেখতে হবে। এটি যাতে ভ্যান্টিলেটেড থাকে এবং ওটার গ্যাস যেন কোনো অবস্থায় বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করতে না পারে। এখন আমাদের পুরো ঢাকা শহর ইন্সপেকশন করতে হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=46043