১০ মার্চ ২০২৩, শুক্রবার, ৭:১১

ছয় বছর হয়ে গেছে খবর মিলেনি

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

গুমের প্রসঙ্গ এলেই আমরা সাধারণত র‌্যাবের দিকে আঙ্গুল তুলি। গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বেশির ভাগ ক্ষেত্রে করেছে র‌্যাব। তবে পুলিশ বা অন্যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এদেশে বহু মানুষকে গুম করেছে। হত্যা তো সে হিসেবে খুবই সাধারণ ব্যাপার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে নিহত হয়েছে শত শত মানুষ। তাদের হাতে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে হাজার হাজার লোক। যারা স্বজনের লাশ পেয়েছে শত বেদনার মধ্যেও তবু তাদের শান্তনা ছিলো যে শেষ বারের মতো প্রিয়জনের মুখটি তারা দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু যারা তাও পাননি তারা এখন পর্যন্ত বুক চপড়ে হাহাকার করছেন। কখনো কখনো তাদের কান্নায় ভারি হয়ে আসছে পরিবেশ। র‌্যাবের গুম বা হত্যাকান্ড আন্তর্জাতিক ইস্যূতে পরিণত হয়েছে। কক্সবাজারের একরাম হত্যার পর তার অডিও বার্তা শুনে সারা পৃথিবী শিউরে উঠেছিলো। তেমনিভাবে র‌্যাবের হাতে অর্থের বিনিময়ে নারায়ণগঞ্জে সাত খুন তেমনি এ পৈশাচিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। সে খুন এখনও বিচারাধীন। কিন্তু একরাম হত্যার কোন বিচার হয়নি। একরামের স্ত্রী জানিয়েছেন, তাকে নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ না করার জন্য বারবার হুমকি দেয়া হয়েছে। ফলে ঘটনাটি আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে গেছে। যারা গুম হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন। তারা মাঝে মাঝে স্বজনের ছবি বুকে ধরে সমাবেশ বা মানববন্ধনে সমবেত হন। মা কাঁদেন আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন। সন্তান কাঁদে আমার পিতাকে ফিরিয়ে দাও। কিন্তু কারো হৃদয়ে তার কোন প্রভাব পরে বলে মনে হয় না। এব্যাপারে পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন দাবি তোলে যে, প্রতিটি গুমের ঘটনা তদন্ত করা হোক। সে রকম তদন্ততো হয়ইনি বরং সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, এরা ঋণের দায়ে, অভিমান করে, প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে দেশান্তরি হয়েছে। কেউ কেউ আবার ছিলো ঋণগ্রস্ত, ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্ম গোপনে চলে গেছে। এরকম সীমাহীন নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে সরকার।

গুমের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে কখনো তার জন্য মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে। কখনো মুক্তিপন পেয়েও অপহৃত ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। আর গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানতো মেলেইনি। কিন্তু বর্তমান বিশে^ মানবাধিকার এমন এক স্পর্শ কাতর ইস্যু যে গোটা গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় বারবার মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। এর নেতৃত্বে আছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তারা মানবাধিকার সমুন্নত রাখার পাশাপাশি গুমকারীদের বিচার দাবি করেছে। তা নিয়ে অগ্রপশ্চাত চিন্তা না করেই আমাদের মন্ত্রীরা অনেক হম্বিতম্বি করেছেন বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন যে সব কথা বলেছেন তা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। তিনি বলেছেন, মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঢং। তিনি কখনো বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ছয় লাখ লোক গুম হয়ে যায়। আবার কিছু দিন বলেছেন সেখানে দুই লাখ লোক গুম হয়। তাদের মুখে মানবাধিকারের কথা বা গুম বিরোধী কথা শোভাপায় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন সেগুলোও চরম দায়িত্বহীন। মন্ত্রীদের কথাবার্তায় এক পর্যায়ে মনে হয়েছিলো, বাংলাদেশ যেন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছে। এর সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে সে সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীদের সাধারণ জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আর সে কারণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ফলে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ইউক্রেন রাশিয়ার পাশে একটি কম শক্তিশালী তুলনামূলকভাবে ছোট দেশ। রাশিয়া দেশটি দখল করে নেবার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সেটি কেমন করে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হলো। বরং এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে রাশিয়া নিজেই। তাদের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ রাশিয়ার সঙ্গে কেউ বাণিজ্যে যুক্ত হলে রাশিয়া থেকে কিছু কেনাকাটা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে যুক্তরাষ্ট্র। আমরা বলে বসলাম এটা রাশিয়ার জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাই যদি হয় তাহলে পৃথিবীর যে কোন বড় দেশ তার আশ পাশের ছোট দেশগুলোকে গ্রাস করতে পারে। আমরাও সে রকম ঝুঁকির বাইরে নই। তারপরও সরকার রাশিয়ার পক্ষ নেবার জন্য এমন একটি ঘোষণা দিয়ে বসলো। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে জানিয়ে দিলো যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে মনে করে এবং এর ব্যত্যয় তারা মেনে নেবে না। রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে আনীত ভোটে প্রথমবার বাংলাদেশ রাশিয়ার পক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু মার্কিন হুঁশিয়ারির পর দ্বিতীয়বার ভোটাভুটিতে বাংলাদেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এরপর ভোটদানে বিরত থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ছয় লাখ বা দুই লাখ লোক গুম হয় এ তথ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোথায় পেলেন তা তিনি অবশ্য জানাননি। পৃথিবীর কোন মানবাধির সংস্থা এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেনি। তাহলে পরাষ্ট্রমন্ত্রীর এতো বড় অভিযোগের ভিত্তি কী। ভিত্তি কিছুই না, ভাবখানা এরকম আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে দেখিয়ে দিয়েছি।

র‌্যাবের গুম-খুন সম্পর্কে অনেক আগেই বিশে^র মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও পশ্চিমা দেশসমূহ প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলো কিন্তু তাতে ঘটনা থেমে থাকেনি। শেষমেষ ২০২১ সালে র‌্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে র‌্যাব বাহিনীর কোন সদস্য এবং ঐ সাত কর্মকর্তা কোনভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। সেখানে যদি তাদের বা তাদের পোষ্যদের কোন সম্পত্তি থেকে থাকে সেটাও বাজেয়াপ্ত করা হবে। এদের আত্মীয়স্বজদের সঙ্গে কোন ব্যবসাবাণিজ্য করবে না যুক্তরাষ্ট্র বরং তা রোধ করবে।

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে আমরা মন্ত্রীদের মুখে অনেক বড় বড় কথা শুনেছি। কিন্তু অর্থনীতি যখন ভঙ্গুর ডলার সংকটে যখন এলসি খোলা যাচ্ছে না। ছাত্ররা বিদেশে পড়তে যেতে পারছে না, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না তখন এসব কথার ফানুস মুহূর্তে ধূষর হয়ে গেছে। এর মধ্যে মিথ্যার বেশাতিতো চলছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু সরকার বলে তিনি সে রকম কোন উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। ফলে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তরফ থেকে প্রেস রিলিজ দিয়ে জানানো হয়, কমিশনের চেয়ারম্যান গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

এবার পুলিশের একটি গুমের কাহিনী। ছয় বছর আগে নরসংদীর রায়পুরা থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিলো আওয়ামী লীগের চারজন নেতাকর্মীকে। তাদের পরিবারের সদস্যরা এই ছয় বছর ধরেই দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু কারো কাছে কোন স্বদোত্তর পায়নি। এখন তারা শুধু জানতে চান তাদের স্বজনরা জীবিত আছেন তো। ২০১৭ সালের ২৬ মে দুপুর আড়াইটার দিকে রায়পুরা থানার একটি পুলিশ দল তাদেরকে তুলে থানায় নিয়ে যায়। কমপক্ষে ১৩ জন এই দৃশ্য দেখেছিলো।

তাদের আটকের পর মুক্তির দাবিতে এলাকায় বিক্ষোভ করে সাধারণ মানুষ। তার ফলে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংঘর্ষ হয়। এতে একজনের মৃত্যু হয় এবং বেশ কয়েজন আহত হয়। বিকালের দিকে প্রত্যক্ষদর্শীদের দুইজন দেখতে পায় তৎকালীন রায়পুরা থানার ওসি আজাহারুল ইসলাম সরকার ঐ চারজনকে একটি পুলিশ পিক-আপে করে সায়দাবাদ ফেরিঘাটে নিয়ে যায়। ঐ চারজনকে সর্বশেষ তখনই দেখা যায়। আজাহারুল ইসলাম এখন টাঙ্গাইলের ঘাটাইল পুলিশ স্টেশনের ওসি। তিনি ঐ চারজনের ব্যাপারে কোন কথা বলতে অস্বীকার করেন। সংঘর্ষের পর পুলিশ বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রুপ মিয়াকে ক্রিমিনাল চার্জে আটক করে। তবে পুলিশ কখনো স্বীকার করেনি যে, নিখোঁজ তিনজন হাবিবুর রহমান, জাকির হোসেন ও আজিজুল ইসলামকে কখনো আটক করেনি। তারা প্রত্যেকে অভিযুক্ত ছিলো তাদের প্রতিপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলো। নিখোঁজ ঐ লোকদের পরিবারের সদস্যরা পুলিশ সদর দফতর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রালয় এবং সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের স্বজদের ফিরে পাওয়ার আবেদন জানান। এখন সবাই অপেক্ষা করছে এই সংবাদ জানার জন্য যে, তারা আদৌ বেঁচে আছে কিনা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা পুলিশ যখন তাদের হটিয়ে ফেরিঘাটে নিচ্ছিল তখন পুলিশকে অনুরোধ জানায় যেন তাদের মুক্তি দেয়া হয়। এতে পুলিশ কোন কর্ণপাত না করলে আটক সাহেদের সমর্থকরা পুলিশকে থামিয়ে দিয়ে নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। তখন পুলিশ গুলী চালায় এবং এতে মোস্তফা নামের একজন গুরুতর আহত হয়। কিন্তু সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ১২ জন প্রত্যক্ষদর্শী প্রত্যেকে একই কথা বলেন। তাদের একজন ছিলেন রায়পুরা ভূমি অফিসের কর্মচারী। এই কর্মচারী বলেন, তিনি ওসি আজাহারকে একই গাড়িতে করে আসামীদের সায়দাবাদ ফেরিঘাটের দিকে নিয়ে যেতে দেখেন। ঐ কর্মচারী একটি মাইক্রোবাসে ছিলেন। তাদের গাড়ি পাগলা নদী পার হয়ে গেলেও পুলিশের গাড়ি তখনও ফেরিঘাটেই ছিলো। তিনি চারজনকে স্পষ্ট করে চিনেন। একজন পুলিশ সদস্য তাদের বলেন, ঐ চারজনকে নাকি রাজনগর এলাকার একটি নৌকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে যখন অন্ধকার ঘন হয়ে আসে তখন আটককৃত লোকদের হেলমেট ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরানো হয়। ২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি স্থায়ীন সংসদ সদস্য রাজু উদ্দিন রাজু বলেন, রুপ মিয়ার মতো কোথায় বড় আওয়ামী লীগ নেতারা। পুলিশ জানে কী করে তাদের গিলে ফেলা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাস করা হয়েছিলো ঐ চারজনের কী হয়েছে। জবাবে তিনি বলেছিলেন, রুপ মিয়া এবং অন্যরা প্রথমে পুলিশের ওপর ক্রিজ নিয়ে হামলা চালায়, আমি জানি না তারপর কী ঘটেছে। তিনি বলেন, তিনি আটককৃতদের পরিবারকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাদের কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কিন্তু রুপ মিয়ার স্ত্রী নাসিমা বেগম এবং আজিজুলের বড় ভাই হারুন মিয়া বলেছেন, প্রত্যেক পরিবারের সদস্যরা রাজু এমপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার সহযোগিতা চেয়েছিলেন।

একদিন পর পুলিশের সাবইন্সপেক্টর রাজিউল আলম ২৩ জনের নাম ও দুই তিনশ’জন অজ্ঞাত নামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, পুলিশ যখন রুপ মিয়াকে লাশ গাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তার সমর্থকরা আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র ও দেশি বোমা দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায় এবং রুপ মিয়াকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় । পুলিশ দুইজন আসামীর পায়ে গুলীও করে। তারপর তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। কেউ কি কোথাও আছেন যিনি পুলিশের হাতে নিখোঁজ বা গুম এই চার আওয়ামী লীগারের সংবাদ দিতে পারেন?

 

 

 

https://dailysangram.com/post/518751