৯ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:১১

তিন দিনে প্রাণঘাতী দুই বিস্ফোরণ

সিদ্দিকবাজারে ২১ জন নিহত, আহত শতাধিক

বিস্ফোরণে হতাহতদের স্বজনদের আহাজারি। মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ছবি : কালের কণ্ঠ
বিধ্বস্ত ভবনের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল প্রথম শ্রেণিতে পড়া শামীন। একটু পর পর স্বজনদের জিজ্ঞেস করছিল, ‘বলো না, বাবা কখন বের হবে?’ স্বজনরা চোখের জল মুছতে মুছতে শুধু সান্ত্বনা দিয়ে বলছিল, ‘একটু পরই বেরোবে।’ এভাবে দুই দিন ধরে ভবনের সামনে অপেক্ষার পর বিকেল ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন একজনের মরদেহ বের করে আনেন, তখন স্বজনদের সঙ্গে শিশুটিও দৌড়ে যায় সেখানে। গিয়ে দেখে মরদেহটি তার বাবা মমিনউদ্দিনের। তখন স্বজনদের সঙ্গে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে শিশুটিও।

মমিনউদ্দিনের বাসা পুরান ঢাকার বংশালের মালিটোলায়। তিনি মঙ্গলবার বিকেলে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ ঘটা সাততলা ভবনে থাকা আনিকা এন্টারপ্রাইজের মালিক ছিলেন। শুধু মমিনউদ্দিনই নন, এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ২১ জন নিহত হয়েছেন। আহত শতাধিক।

এর আগে গত রবিবার সকালে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় বিস্ফোরণে তিনজন মারা যান। এ নিয়ে রাজধানী ঢাকায় গত তিন দিনে দুটি বহুতল ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এখন পর্যন্ত কোনো বিস্ফোরণের কারণ জানা যায়নি। আর সপ্তাহের শুরুতে গত শনিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণে সাতজন মারা যান। আজ ওই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা।

সিদ্দিকবাজারে ওই ভবনের বেইসমেন্টে ঢোকার জন্য গতকাল বুধবার সকাল ৯টা থেকে অপেক্ষা করছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। কিন্তু ভবনটি নড়বড়ে হয়ে পড়ায় জাতীয় সমন্বয় কমিটির অনুমোদন ছাড়া তাঁরা অনুসন্ধান শুরু করতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় বিকেল ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লক্ষ করেন, বেইসমেন্টের একটি জায়গা থেকে মাছি উড়ছে। র‌্যাবের ডগ স্কোয়াডের কুকুরও ইঙ্গিত করছিল সেদিকেই। তখন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঝুঁকি নিয়েই নেমে যান উদ্ধারে। ভারী যন্ত্র না নিয়ে শুধু কাটার দিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনেন দুজনের লাশ।

জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া উইংয়ের অফিসার শাহজাহান শিকদার বলেন, রাজউকের অনুমোদন নিয়ে বিকেল থেকে বেইসমেন্টে উদ্ধার অভিযান চালানো হয়।

মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে গুলিস্তানের কাছে সিদ্দিকবাজারের নর্থ সাউথ রোডে ১৮০/১ নম্বরের ক্যাফে কুইন নামের সাততলা ভবনটিতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। ভবনটি কুইন স্যানিটারি মার্কেট নামেও পরিচিত। ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে কি না, এ বিষয়ে আজ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাশের ক্ষতিগ্রস্ত ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা করেছে বংশাল থানার পুলিশ।

বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ঘটনাটি নাশকতা কি না, তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। সেনা, পুলিশ ও র‌্যাবের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি।

মঙ্গলবার রাত ১২টায় ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার তৎপরতা বন্ধ করে। গতকাল সকাল থেকে উদ্ধার তৎপরতা আবার শুরু করার জন্য ভবনের সামনের রাস্তাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকাল ৯টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে ভবনের সামনে অবস্থান নিতে দেখা যায়। তবে বেইসমেন্টে অভিযান না চালালেও তাঁদের ধ্বংসস্তূপ সরাতে দেখা যায়।

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে পারছি না। শুধু কাটার নিয়ে আমরা দুজনের লাশ উদ্ধার করেছি। উদ্ধার অভিযানে আনসারেরও একটি বিশেষ ইউনিট মোতায়েন করা হয়েছে।’

এর আগে লালবাগ বিভাগের পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) মো. জাফর হোসেন বলেন, ‘বিশেষজ্ঞরা আমাদের জানিয়েছেন, ভবনটির কলাম ৪৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বেইসমেন্টে ঢোকার অনুমোদন দেবেন। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে। তারাই সিদ্ধান্ত জানাবে।’

নিহত যারা : ২১ জনের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন লালবাগের ইসলামবাগের মমিনুল ইসলাম (৩৮) ও তাঁর স্ত্রী নদী আক্তার (৩৬), কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার নলচড় গ্রামের মো. মমিনের ছেলে সুমন (২১), যাত্রাবাড়ীর শেখদী পশ্চিম পাড়ার মোশাররফ হোসাইনের ছেলে মুনসুর হোসাইন (৪০), বরিশাল কাজীরহাট চর সন্তোষপুর গ্রামের দুলাল মৃধার ছেলে ইসহাক মৃধা (৩৫), বংশাল আলুবাজারের হোসেন আলীর ছেলে ইসমাইল হোসেন (৪২), কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ চুনকুটিয়া মাস্টারবাড়ীর জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে মো. রাহাদ (১৮), চাঁদপুর মতলব উপজেলার পশ্চিম লালপুর গ্রামের বিল্লাল হোসেনের ছেলে আল আমিন (২৩), মুন্সীগঞ্জ গজারিয়ার মোজাম্মেল হকের ছেলে আবু জাফর সিদ্দিক (৩৪), ঢাকার বংশালের ইউনুস হোসেনের ছেলে নাজমুল হোসেন (২৫), মানিকগঞ্জ সদরের শেখ সাহেব আলীর ছেলে ওবায়দুল হাসান বাবুল (৫৫), ঢাকার যাত্রাবাড়ীর আলী মোহাম্মদ ভুঁইয়ার ছেলে নুরুল ইসলাম ভুঁইয়া (৫৫), পুরান ঢাকার চকবাজার সিদ্দিক গলির হৃদয় (২০), মুন্সীগঞ্জ সদরের ছমির উদ্দিন আকনের ছেলে মাইনুদ্দিন (৫০), পুরান ঢাকার বংশালের আনোয়ারুল ইসলামের মেয়ে আকুতি বেগম (৭০), ভবনটির দোকানকর্মী শরীয়তপুর গোসাইরহাটের রবিন হোসেন (২০), ভবনের নিচতলার ব্যবসায়ী মমিন উদ্দিন সুমন, মো. সম্রাট (২২), যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগের কালাচান মীরের ছেলে মো. ইদ্রিস (৬০), সিয়াম (২০) ও মো. মুসা (৪৫)। সর্বশেষ রাত পৌনে ১১টার দিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মো. মুসার মৃত্যু হয়।

যেভাবে ঘটনা : প্রতিদিনের মতোই ভবনটিতে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চলছিল। এসেছিল ক্রেতারা। হানিফ উড়ালসেতু থেকে বংশালের দিকে কিছুটা যেতেই ভবনটির অবস্থান। বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে হঠাৎ বিকট শব্দ। মুহূর্তেই ভবনের নিচ ও দ্বিতীয় তলা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। চারতলা থেকে সাততলা পর্যন্ত থাকা বাসার লোকজন দ্রুত নেমে আসে রাস্তায়। বাঁ দিকের পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত থাকা ব্র্যাক ব্যাংকও ক্ষতিস্ত হয়। ব্যাংকের সাতজন আহত হয়েছেন।

যা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান : গতকাল দুপুরের দিকে ঘটনাস্থলে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে পারব কেন এই বিস্ফোরণ ঘটেছে।’

গত কয়েক দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব বিশেষজ্ঞরা আছেন ঘটনার কারণ উদঘাটনের জন্য। যদি তাঁরা ব্যর্থ হন, আমরা বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসতে পারি। কিন্তু সেটার প্রয়োজন হবে না, তাঁরাই যথেষ্ট।’ তিনি আরো বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র না নিয়ে কিংবা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে কেউ যেন ভবন নির্মাণ না করেন। সব কিছু মেনে ভবন নির্মাণ করলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমে যেত।

দুপুরে ঘটনাস্থলে আসেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এটি কোনো স্বাভাবিক কেমিক্যাল বিস্ফোরণের ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড, সেটা তদন্তের প্রয়োজন আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এটা কিসের ইঙ্গিত, সেটা ভালো করে বোঝার দরকার রয়েছে। সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’

র‌্যাবের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান মেজর মশিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, বিস্ফোরণ বেইসমেন্ট থেকে হয়েছে। এসি থেকে ঘটেনি, এটা নিশ্চিত হয়েছি। গ্যাস জমে কিংবা অন্য কোনোভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছে। আমরা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছি।’

বিস্ফোরণের পাঁচ কারণ : কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বম্ব নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী জানান, তাঁরা পাঁচটি সম্ভাব্য কারণ সামনে রেখে তদন্ত করছেন। এর মধ্যে রয়েছে ভবনের বেইসমেন্টের বন্ধ কোনো কক্ষে হয়তো গ্যাস জমে ছিল। এ ছাড়া দুটি ভবনের মাঝখানে সেপটিক ট্যাংক ছিল, সেখান থেকেও গ্যাস নির্গত হতে পারে। বিচ্ছিন্ন হওয়া কোনো গ্যাসলাইন থেকে গ্যাস জমতে পারে বা মিথেন গ্যাস জমতে পারে। পয়োনিষ্কাশন লাইনের পাইপ লিকেজ হয়ে গ্যাস জমতে পারে। ভবনে থাকা বড় জেনারেটর থেকেও কোনোভাবে গ্যাস জমতে পারে।

ভবনটি যেমন ছিল : ভবনটির নিচতলায় আট থেকে ৯টি স্যানিটারির দোকান ছিল। বিস্ফোরণে সব দোকানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় এসব দোকানের গোডাউন ছিল। চতুর্থ তলা থেকে শুরু করে সাততলা পর্যন্ত ছিল বাসা। তবে ভবনটিতে কতটি পরিবার কিংবা কত মানুষ ছিল, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান জানান, পরিবারগুলো এখন আর ওই ভবনে নেই।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ভবনটিতে তিতাস গ্যাসের লাইন রয়েছে। তবে তিতাস গ্যাসের এক কর্মকর্তা গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের জানান, তিতাস গ্যাসের কারণে এই ঘটনা ঘটেনি।

তদন্ত কমিটি : ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য।

নিখোঁজ যারা : গতকাল সকাল থেকে ভবনটির সামনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের কান্না করতে দেখা যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ স্যানিটারির ম্যানেজার মেহেদী হাসান স্বপন, আনিকা স্যানিটারির মালিক মমিনউদ্দিন সুমন, কর্মচারী রবিন হোসেন শান্তর স্বজনরা খুঁজতে আসে। বিকেলে মমিনউদ্দিন সুমন ও রবিন হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। মেহেদী হাসান স্বপনের মামা শ্বশুর আব্দুল মান্নান দুই লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে ছুটে যান দেখতে। সেখানে স্বপনের লাশ না পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন তিনি।
ব্যস্ত সড়কে হঠাৎ রক্তাক্ত মানুষ : ‘বিকেলে কিছু কাজ হাতে নিয়ে আমি ভবনের সামনে বসে ছিলাম। হঠাৎ বিস্ফোরণে চমকে যাই। মনে হলো বোমা ফুটেছে। দৌড় দিই। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান হারাই। পরে যখন সুস্থ হই তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে আমি।’ এ কথা বলছিলেন জয়নাল।

মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে ফের ঘটনাস্থলে আসেন তিনি। এরপর তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘আমি একজন ভ্যানচালক। ভবনের টাইলসের মালপত্র টানি। ঘটনার সময় ভবনের সামনে ভ্যানে বসে ছিলাম। এরপর বিকট শব্দ। ওপর থেকে কাচের টুকরা এসে হাতের ওপর পড়ে রক্ত ঝরা শুরু হয়। আমি দৌড়ানোর চেষ্টা করি। বহু মানুষকে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখি। অনেকেই বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়ে যাই।’

মঙ্গলবার রাতে তিনি যখন কালের কণ্ঠকে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন গুলিস্তান সিদ্দিকবাজারের নর্থ সাউথ সড়কের সাততলা ভবনের সামনে ঘিরে ছিল শত শত উত্সুক মানুষ। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র‌্যাব, সেনাসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের নিচতলার কলাপসিবল গেট বিচ্ছিন্ন হয়ে সড়কে পড়ে ছিল। তার পাশেই পড়ে ছিল বিধ্বস্ত একাধিক মোটরসাইকেল, রিকশা-ভ্যান, কাচ, ইট, বালুসহ নানা সরঞ্জাম। এ সময় চোখে পড়ে ভবনটির সামনের সড়কে ‘সাভার পরিবহন লিমিটেড’ নামের একটি বাস। তবে সেটির জানালার প্রায় সব গ্লাস ভেঙে গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী সুজন বলেন, তিনি এলাকা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পান। এর পরই সড়কে অনেকের লাশ পড়ে ছিল। এ সময় ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির ছিন্নভিন্ন লাশ ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যায় লোকজন। আহত অনেককে রক্তাক্ত অবস্থায় ভ্যানে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

চায়ের দোকানদার আরমান সেখ বলেন, ‘ঘটনার কথা কইতে গেলে পরানডা কাঁইপা ওঠে। আহতদের মধ্যে অনেকেই দুটি বাসের যাত্রী ছিলেন। আহতরা বাঁচার জন্য সহায়তা চেয়ে আর্তনাদ করছিলেন।’
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মঙ্গলবার রাত ১১টা পর্যন্ত তাঁরা ভবন থেকে ১৭ জনের লাশ এবং ৪০ জনকে জীবিত উদ্ধার করেন। একজন হাসপাতালে মারা যান।

ভবন মালিকসহ দুজন ডিবি হেফাজতে : ভবনটির মালিকপক্ষের দুজন ওয়াহিদুর রহমান ও আব্দুল মোতালেব মিন্টুকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রধান হারুন অর রশীদ। জানা গেছে, ভবনটির মালিক রেজাউর রহমান মারা যাওয়ার পর তাঁর তিন ছেলে ওয়াহিদুর রহমান, মশিউর রহমান ও মতিউর রহমান বর্তমানে ভবনটির মালিক হন। মশিউর রহমান লন্ডনপ্রবাসী।

হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমরা কাউকে আটক করিনি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা বাড়ির মালিক, দোকান মালিকদের ডেকেছি। যারা আহত হয়েছে তাদের সঙ্গেও কথা বলছি। বেইসমেন্টে দোকান দেওয়ার তো কথা নয়। স্যুয়ারেজ লাইন, সেপটিক ট্যাংক, ওয়াটার রিজার্ভার—এগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হতো কি না তা জানতে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। এ ছাড়া বাহির থেকে কেউ এটা ঘটিয়েছে কি না বা এসব ঘটানোর সুযোগ আছে কি না, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।’

ভবনটি ৪৫ বছর আগের : ভবনটির ৪৫ বছর আগে অনুমোদন নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (জোন-৫) হামিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অপমৃত্যুর মামলা : ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন জানান, পুলিশ একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছে। এর আগে এ ঘটনায় জিডি করা হয়েছিল। তিনি বলেন, সার্বিক বিষয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফায়ার সার্ভিস ও ডিএমপির সিটিটিসি তদন্ত করছে। তারা যদি এমন কোনো কিছু পায়, যাতে মনে হয় নাশকতা বা বিস্ফোরক, তাহলে অন্য মামলা হবে। আপাতত অপমৃত্যুর মামলার আলোকে থানা-পুলিশ ঘটনার তদন্ত করবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/09/1259203