৯ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:০৬

আহাজারিতে ভারী হাসপাতালের পরিবেশ

হঠাৎ পাল্টে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ। একের পর এক সাইরেনের শব্দ। দ্রুতগতিতে এম্বুলেন্স ছুটছে। পেছন পেছন ছুটছেন স্বজনরা। আহাজারিতে ভারী হচ্ছে পরিবেশ। গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতদের নিয়ে আসা হচ্ছিলো ঢামেকের জরুরি বিভাগে। খবর পেয়ে আহতদের স্বজনরা দ্রুত হাসপাতালে আসেন। জরুরি বিভাগে খুঁজতে থাকেন স্বজনদের। বাবা সন্তানকে খুঁজছেন আবার সন্তান খুঁজছেন বাবাকে। আপন ভাই, স্বামী কিংবা বন্ধুর খোঁজও করেছেন অনেকে।

তাদের সবার চোখ টলমল। কেউ কেউ হাউমাউ করে কান্না করছেন। চাপা কান্নায় হতভম্ব অনেক স্বজন। সন্ধ্যার পর যতই অন্ধকার বাড়ছিল স্বজনদের চিৎকার, কান্না, উৎকণ্ঠা আর আহাজারিতে ততই ভারী হচ্ছিলো হাসপাতালের পরিবেশ। মর্গের সামনে থেকেও ভেসে আসছিলো স্বজনদের চিৎকার।

মঙ্গলবার বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে সিদ্দিক বাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এরপরই হতাহতদের দ্রুত ঢামেকে আনা হয়। জরুরি বিভাগের সামনে এম্বুলেন্স আনার পরই উৎকণ্ঠা বেড়ে যায় স্বজনদের। খোঁজার চেষ্টা করেন নিজ পরিবারের কেউ এসেছেন কিনা। আহত নাকি লাশ আনা হয়েছে সেই উৎকণ্ঠায়ও ছিলেন তারা। যারা একনজর দেখে স্বজনদের চিনতে পারছেন তাদের মধ্যে কান্নার রোল আরও বেড়ে যায়। অন্যরা ফের চেয়ে থাকেন আরেকটি এম্বুলেন্সের অপেক্ষায়। এভাবেই চলতে থাকে তাদের আহাজারি। ঢামেকে থাকা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় ব্যবসায়ী, দোকান কর্মী, পথচারী ও বাসের যাত্রীরাও হতাহত হন। বিস্ফোরণের আশেপাশের দোকানে কর্মরত অনেকেই দুর্ঘটনায় পড়েছেন। তাদের খোঁজ না পেয়েই হাসপাতালে এসেছেন স্বজনরা। এরমধ্যে অনেকেই হাসপাতালে এসে স্বজনের মৃতদেহ দেখে ভেঙে পড়েছেন।

মায়ের জন্য ইফতার কেনা হলো না সুমনের: মা পবিত্র শবেবরাতের রোজা রেখেছিলেন। এজন্য ছেলে সুমন ইফতারি কিনতে বাইরে যান। কিন্তু হঠাৎই সবকিছু থমকে যায়। মায়ের জন্য ইফতারি কেনা হয়নি সুমনের। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঢামেকে ছুটে আসেন স্বজনরা। সুমনের প্রতিবেশী বিলকিস জানান, সুমন কাতার প্রবাসী। বিয়ের জন্য ১০-১২ দিন হয় ঢাকা এসেছেন। গত সোমবার তার জন্য পাত্রীও দেখা হয়েছে। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার প্রক্রিয়াও চলছিলো। কিন্তু হঠাৎই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় বিস্ফোরণের ঘটনায়।

স্বজনরা জানান, সুমনের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলায়। মা, দুই বোন আর এক ভাইকে নিয়ে বংশালের সুরিটোলায় থাকতেন। পরিবারে চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। তার বাবা ফুটপাথে জুতা বিক্রি করেন। ধার-দেনা করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন।

সিয়ামকে হারিয়ে গলা জড়িয়ে কেঁদেছেন ছয় বন্ধু: বাল্যকালের সাত বন্ধু। সবসময় একসঙ্গে ছিলেন। মঙ্গলবার শবেবরাতে একসঙ্গে নামাজ পড়তে যাবেন বলে কথা ছিল তাদের। তাই কাজ শেষ করে আব্দুল হালিম সিয়ামকে দ্রুত চলে আসতে বলেছিলেন বন্ধুরা। কিন্তু সিয়াম বন্ধুদের কাছে আর ফিরলেন না। সিয়ামের দুর্ঘটনার খবর গেল বন্ধুদের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে যান সবাই। এদিক-ওদিক খোঁজেন বন্ধুকে। ছুটে গিয়ে দেখেন বন্ধু মারা গেছে। মুহূর্তে কান্নায় ফেটে পড়েন তারা। বন্ধুর এভাবে চলে যাওয়া নিজেদের মানাতে পারছিলেন না।

সিয়ামের বন্ধু পলাশ জানান, সিয়াম থাকেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কবুতর পাড়ায়। তার বাবা মো. দুলাল মিয়া একজন দিনমজুর। সংসারে তাদের টানাপড়েন ছিল। তাই সংসারের হাল ধরতে পড়লেখা ছেড়ে একটি স্যানিটারি দোকানে কাজ নিয়েছিলেন। তারা সাত বন্ধু একই এলাকার বাসিন্দা। সিয়াম ওই ভবনটির একটি স্যানিটারি পণ্যের দোকানে কাজ করতো। ওইদিন সন্ধ্যায় এলাকায় এসে একসঙ্গে নামাজে যাওয়ার কথা ছিল। সিয়ামের আরেক বন্ধু বলেন, রক্তের প্রয়োজন শুনে তা জোগাড়ও করেছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাগ রক্ত দেয়ার সময় সিয়াম মারা যায় বলে হাসপাতাল থেকে আমাদের জানানো হয়।

একসঙ্গে প্রাণ গেল স্বামী-স্ত্রীর: সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় এক দম্পতির মৃত্যু হয়। তারা হলেন- মোমিনুল ইসলাম ও তার স্ত্রী নদী বেগম। মোমিনুলের মামা রফিক বলেন, লালবাগে তাদের নিজেদের বাড়ি। গলির ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এই ঘটনা ঘটে। যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে কথা বলে গেছে। পাঁচ মিনিটও হয়নি এরমধ্যে বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ শুনে তাদের দু’জনের মোবাইলে কল দিয়ে আর পাওয়া যায়নি। দুই ঘণ্টা ধরে কল দিতে থাকি। পরে সন্দেহমূলকভাবে হাসপাতালে চলে আসি। তাদের দুইটি সন্তান রয়েছে। মর্গে গিয়ে দেখি তাদের দু’জনের মরদেহ পড়ে আছে। ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, মমিনুল ইসলাম ও তার স্ত্রী নদী বেগমের লাশ শনাক্ত করেছেন তাদের চাচা জয়নাল আবেদীন। মমিনুল ইসলামের বাবার নাম আবুল হাসেম। তাদের বাসা চকবাজার থানার ইসলামবাগ এলাকায়।

সন্তানের ছবি নিয়ে ছুটেছিলেন বাবা: সাভার যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়েছে আব্দুল মালেক (১২)। গুলিস্তানে নেমে এরপর অন্য গাড়িতে তার সাভারের হেমায়েতপুর যাওয়ার কথা। মালেকের বাবা রতন মিয়া বলেন, আমার ছেলে একটি ইটের ভাটায় কাজ করে। বিস্ফোরণের ঘটনা শোনার পর মালিককে ফোন দিই। কিন্তু ছেলে সেখানে যায়নি। এরপর আত্মীয়-স্বজন যারা ছিল তাদের কাছেও খবর নিয়ে খোঁজ মেলেনি। এরপর সিদ্দিক বাজারে ছুটে আসি। সেখান থেকে খবর না পেয়ে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে আসি সেখানেও পাইনি। এরপর ঢাকা মেডিকেলে ছুটে আসি এখানেও নেই। তার কাছে কোনো ফোন ছিল না। আমার তিন ছেলে দুই মেয়ে। এই ছেলে দ্বিতীয়। আমি ছেলেকে কোথায় খুঁজে পাবো। ঢাকা মেডিকেলে এসে ছেলের ছবি দেখিয়েছি। পাগলের মতো হাসপাতালে হাসপাতালে খুঁজছি। আমি রিকশা চালাই। কাল থেকে কোনো কাজে মন বসাতে পারছি না। প্রতিদিনই সে এই রাস্তা হয়ে বাসে যাতায়াত করে যেতো। ঘটনার দিন বাসা থেকে সকাল ৯টায় বেরিয়েছিলো।

আইসিইউ’র সামনে বড় ভাইয়ের অপেক্ষা: স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন করতেন আল আমিন সিকদার। হাসপাতাল থেকে ওইদিন বিকালে টিউশনি করাতে যাচ্ছিলেন তিনি। তখনই বিস্ফোরণের কবলে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আহত হওয়ার পর বড় ভাই মনির সঙ্গে কথাও হয় তার। তখন আল আমিন তাকে হাসপাতালে আসতে বলেন। এরপরেই বড় ভাই দ্রুত ছুটে আসেন। গতকাল দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউ’র সামনে অপেক্ষায় ছিলেন মনির। তিনি বলেন, ডাক্তার বলেছে আল আমিনের শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। আমরা আশা করছি সে দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। মনির জানান, আল আমিন একজন ইন্টার্ন ডাক্তার। এক বছর ধরে ইন্টার্ন করছেন।

বিয়ে হলো সাতদিন, স্বামীকে বাঁচানোর আকুতি স্ত্রীর: আক্রান্ত ভবনের একটি দোকানে কাজ করতেন রাজন। তিনি ঢামেকের জরুরি বিভাগের আইসিইউতে ভর্তি। প্রেম করে সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর হাত থেকে এখনো মুছেনি মেহেদির রং। আইসিইউ’র সামনে নির্বাক তাকিয়ে আছেন নববধূ মাহি। মাহি জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। বর্তমানে ঢাকার মুগদায় থাকেন। বিয়ে হয়েছে এক সপ্তাহ হলো। তিনি বলেন, ঘটনার সময় তার স্বামী মালামাল নামাচ্ছিলেন। বিস্ফোরণের ঘটনার পর দোকানের মালিক স্বামীর মোবাইলে কল দেয়। এ সময় একজন নার্স ফোন রিসিভ করে জানায় সে হাসপাতালে ভর্তি আছে। তখন আমরা সবাই বিস্ফোরণের কথা জানতে পারি। তারা দুই ভাই এক বোন। আমার শ্বশুর বাসের চালক। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। রাজনের অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখন সে আইসিইউতে ভর্তি আছে। শ্বশুর অসুস্থ হওয়ায় আমার স্বামী ও তার ভাইয়ের আয় দিয়ে সংসার চলে। বড় ভাইও ওইখানে কাজ করে। তবে সে ওইদিন কাজে যায়নি। দুই ভাই সংসারটি আগলে ধরেছিল। আমাদের ভাগ্য খারাপ। এই শুক্রবার তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। আমার স্বামীর কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচবো কি করে। আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে কি বুঝাবো। তার বুকে আর মুখে আঘাত লেগেছে বেশি। দাঁতগুলো ভেঙে গেছে। বুকের মাঝে কেটেছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।

মনে হয়েছিল দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে: আহত অবস্থায় ঢামেকের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন সুমন চক্রবর্তী। পাশে বসে আছেন তার স্ত্রী। সুমন বলেন, বুঝতেই পারিনি কি হয়ে গেল। আমি যে ফিরে এসেছি ভাবতে পারিনি। মনে হয়েছিল দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। এভাবে ভবনের গ্লাসগুলো ভেঙে পড়ছিলো। এমন বিকট শব্দে চারিদিকে ১ সেকেন্ডের মধ্যে সব তছনছ হয়ে যায়। আমি দৌড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে সামনে একটি ভারী বস্তু এসে পড়ে। পরের ঘটনা আর কিছু মনে করতে পারছি না। সুমনের স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা বলেন, এখনো ভালো করে কিছু বলতে পারছি না। সে কুরিয়ার সার্ভিসে মাল ডেলিভারি করতে গিয়েছিল। ঘটনার সময় ওই ভবনের পাশে ছিল লাইনে দাঁড়িয়ে। মাথায় এবং পায়ে সমস্যা হয়েছে।

https://mzamin.com/news.php?news=45893