৯ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:০৩

মুহূর্তেই হাসপাতাল চত্বরে বুকফাটা আর্তনাদ

 
অ্যাম্বুলেন্সের তীক্ষ্ণ সাইরেনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ। কারও বাবা, কারও সন্তান, কারও ভাই, কারও স্ত্রী হাসপাতাল মর্গে পড়ে আছে। কেউ আবার বেডে কাতরাচ্ছেন।

হাসপাতাল চত্বরের মর্গ ঘিরে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন স্বজনরা। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ছিলেন বুকফাটা কান্নায়। এ দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন যারা তারা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে রাজধানীর গুলিস্তান সিদ্দিকবাজারের একটি মার্কেট ভবনে বিস্ফোরণে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে প্রথমে ১৭টি লাশ আনা হয়। বুধবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২০ জন দাঁড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

ঢামেক হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গুরুতর আহত ২৩ জনসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অর্ধশত ব্যক্তি চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঢামেকের জরুরি বিভাগের অর্থোপেডিস কক্ষে চিকিৎসা চলছিল আরও ছয়জনের। এদিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আরও ১০ জন ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন লাইফ সাপোর্টে, তিনজন আইসিইউতে, দুজন এইচডিইউতে আর তিনজন সাধারণ বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সবার শ্বাসনালি ও শরীর পুড়েছে। কেউই শঙ্কামুক্ত নন। তাদের অনেকের হাত ও পাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ভেঙে আছে। কোনো কোনো অঙ্গ আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কারও কারও মাথার খুলি, পাঁজরের হাড় ভেঙে শরীরের ভেতরে ঢুকে আছে।

এদিকে জীবন ফিরে পাওয়া মানুষগুলোর পিছু ছাড়ছে না আতঙ্ক। ক্ষণে ক্ষণেই চিৎকার দিয়ে উঠছে চিকিৎসাধীন অনেকেই।
ঢামেক হাসপাতাল চত্বরের মর্গের পাশে আর্তনাদ করতে করতে জ্ঞান হারাচ্ছিলেন জোছনা নামের এক নারী। আলভী নামের এক যুবক মর্গের গ্রিলে মাথা ঠুকিয়ে বাবা, বাবা বলে ডাকছিলেন। সে কোরআনে হাফেজ। কান্নার সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াতও করছিলেন। জোছনা জানান, তার ভাই ইসমাইল হোসেনের (৪২) লাশ মর্গে। আলভী সেই ভাইয়ের চার ছেলের মধ্যে সবার ছোট। সে বাবাকে হারিয়েছে, আমি ভাইকে। ভাই জীবিত ছিল, হাসপাতালে এসে মারা গেছে। ইসমাইলের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। ভবনটিতে তিনি গিয়েছিলেন পাওনা টাকা আনতে। আকুতি বেগমের (৬০) জন্য কান্না করছিলেন ভাইপো স্বপন মিয়া। স্বপন জানান, সোমবার গাজীপুর থেকে বড় ভাইয়ের ছেলের বাসায় তার ফুপু বেড়াতে এসেছিলেন। গাজীপুরে ফিরতে তিনি গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে যাচ্ছিলেন। স্বপন আরও বলেন, স্বামী-সন্তানহীন ফুপু আত্মীয়-স্বজনদের আগলে রাখতেন। সেই ফুপুর নাড়িভুঁড়ি ছিটকে আছে। একই মর্গে স্বামী-স্ত্রীর লাশ পড়ে ছিল। রক্তের সঙ্গে মিশে ছিল বিচ্ছিন্ন হওয়া শরীরের বিভিন্ন অংশ। ওই অবস্থায় তাদের শনাক্ত করে চাচা জয়নাল আবেদীন জানান, তারা পুরান ঢাকার চকবাজার ইসলামবাগে থাকতেন। মমিনুল স্ত্রী নদীকে নিয়ে মার্কেটে গিয়েছিলেন বাসার জন্য পছন্দের স্যানিটারি পণ্য কিনতে।

সুমনের নিথর দেহ পড়ে আছে মর্গে। বোন সোমা আক্তার বারবার ভাইয়ের লাশের ওপর লুটিয়ে পড়ছিলেন। মুখে মুখ লাগিয়ে বলছিল, ‘ভাই-ভাইরে কথা বল, তুই চোখ খুল, তুই না একটু আগে কথা কইলি। আল্লাহ, তুমি আমার ভাইকে ফিরিয়ে দাও, আমাকে নিয়ে যাও।’ এমন শত বিলাপে স্তব্ধ হয়ে পড়ে আশপাশ। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে সবাই। বিলাপ করে সোমা বলছিলেন, মা (তাজু বেগম) রোজা রেখেছিলেন। মায়ের জন্য ইফতার কিনতে গিয়েছিল সুমন। যাওয়ার সময় বলেছিল, ‘আপা তুই ঠান্ডা পানি দিয়ে শরবত করিস। আমি ইফতারি নিয়ে আসছি।’ কাতার প্রবাসী সুমন চার মাস আগে ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। মা, দুই বোন আর এক ভাইকে নিয়ে বংশালের সুরিটোলায় তিনি থাকতেন।

ওবায়দুল হাসান বাবুলের (৫৫) লাশ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মর্গে আসে। প্রায় ২ ঘণ্টা পর তার লাশ শনাক্ত করা হয়। ছেলে মাওলানা মেহেদী হাসান বাবা বাবা বলে ডাকছিলেন। দুহাত তুলে সে বলছিল, ‘আল্লাহ আপনি কী করলেন, আমার বাবাকে কেন নিয়ে গেলেন। আমার বাবার কী দোষ ছিল?’ এমন বিলাপের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল শত বিলাপ। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না। স্বজনরা জানান, ওই মার্কেটে বন্ধু বাশার মিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন বাবুল। তার বাড়ি মানিকগঞ্জ সদরে। স্ত্রী, এক ছেলে-দুই মেয়ে রয়েছে তার।

ইসহাক মৃধার (৩৫) লাশ পেতে পুলিশের কাছে আর্তি জানাচ্ছিলেন স্বজনরা। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের কাজীরহাটের চরসন্তশপুর গ্রামে। কাপড়ের ব্যবসা করতেন ইসহাক। স্বজন মিজান জানান, দুর্ঘটনার খানিকটা আগে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। তার দুটি সন্তান রয়েছে। ২৩ বছর বয়সি রাহাতকে হারিয়ে বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন টানা বিলাপ করছিলেন। মর্গের পাশে বারবার লুটিয়ে পড়ছিলেন তিনি। জাহাঙ্গীর জানান, তার ছেলে মার্কেটটিতে মালামাল কিনতে গিয়েছিল।

লাশের ওপর পড়ে ভাই ভাই বলে কাঁদছিলেন নাজমুল হোসেন। মোবাইল ফোনে বলছিল, ‘মাগো, হৃদয় ভাই নেই। তোমরা তাড়াতাড়ি আস।’ স্বজনরা কাঁদছে। নাজমুল জানান, তার ভাই হৃদয় মার্কেটে স্যানিটারি দোকানের বিক্রয়কর্মী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে। বাবা হাসেন মিয়া গ্রামে পান-সিগারেট বিক্রি করেন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে হৃদয় সবার বড় ছিলেন।

ইদ্রিস মীরের (৪০) লাশের পাশে বসে ছিলেন ভাই আলী মীর। শরীর থেকে বের হওয়া মাংস তিনি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিলেন। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল ভাইয়ের দেহে। আলী মীর জানান, তাদের পরিবার খুবই দরিদ্র। ভাই ওই মার্কেট ঘিরেই ভ্যান চালাত। ১৫ বছর ও চার বছরের দুটি ছেলে তার। ইদ্রিস গাজীবাগে ভাড়া থাকতেন। মুনসুর হোসেন (৪০) মশারির ব্যবসা করতেন। বিস্ফোরণের মাত্র ৫ মিনিট আগে বকেয়া টাকা তুলতে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন খালাতো ভাই আল-আমিন (২৩)। বিস্ফোরণে দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ৭টার দিকে দুজনেরই লাশ শনাক্ত হয়।

মুনসুরের ভাই হাবিব বলেন, ৯ বছরের সন্তান রয়েছে মুনসুরের। আর আল আমিন বিয়ে করেননি। এমন মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। চাপা ক্ষোভ আর কান্নায় তিনি বলেন, ‘দেশে কি মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। কেন এমন মৃত্যুর মিছিল।’
নূরুল ইসলাম ভূঁইয়ার (৫৫) স্যানিটারি দোকান। থাকতেন যাত্রাবাড়ী এলাকায়। রোজা রেখেছিলেন। বাড়িতে গিয়ে ইফতার করার কথা ছিল। কিন্তু বিস্ফোরণ তার প্রাণ কেড়ে নেয়। ছোট ভাই তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাবা নেই, এখন বাবার মতো বড় ভাইকেও হারালাম। কোথাও কি মানুষের নিরাপত্তা নেই।’ বাবা মাঈন উদ্দিনের (৫০) লাশ ধরে আর্তনাদ করছিলেন ছেলে মাহমুদুল হাসান। তিনি শুধু বলছিলেন, ‘আমার বাবাকে এনে দাও, আমার বাবার কোনো দোষ নেই। বাবাকে কে মারল।’

ঢামেক হাসপাতাল আবাসিক সার্জন ক্যাজুয়ালটি ব্লকের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আলাউদ্দিন যুগান্তরকে জানান, ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ভর্তি রয়েছে ২০ জন। তাদের মধ্যে একজন আইসিইউতে। তার অবস্থা সংকটাপন্ন। গুরুতর আহত ১২ জনের হাড় ভাঙা। আমরা সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিচ্ছি। অতিরিক্ত চিকিৎসক, নার্স, স্টাফ দিন-রাত কাজ করছেন। এদিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১০ জন ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন লাইফসাপোর্টে, তিনজন আইসিইউতে, দুজন এইচডিইউতে আর তিনজন সাধারণ বেডে রয়েছে। সবার শ্বাসনালি ও শরীর পুড়েছে। কেউই শঙ্কামুক্ত নন।

বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বুধবার রাত ৮টায় যুগান্তরকে জানান, ১০ জনের কেউই শঙ্কামুক্ত নন। কারও ৯০, কারও ৩০ শতাংশ শরীর পুড়ে গেছে। পুড়ে গেছে শ্বাসনালিও।

মৃতরা হলেন-মোমিনুল ইসলাম (৩৮), নদী আক্তার (৩০), সুমন (২১), মুনসুর (৪০), ইসছাক মৃধা (৩৫), ইসমাইল হোসেন (৪২), মোহাম্মদ রাহাত (১৮), আলামিন (২৩), হৃদয় (১৮), ইদ্রিস মীর (৫০), আবু জাফর সিদ্দিক (৩৪), নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া (৫৫), নাজমুল হোসেন (২০), আকুতি বেগম (৬০), ওবায়দুল হাসান (৫৫), মাইনুদ্দিন (৫০), মোহাম্মদ সিয়াম (১৮), মমিন উদ্দিন (৪৫), রবিন হোসেন শান্ত (২০) ও সম্রাট (৩৪)।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/652564