৯ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:০১

ঘরে-বাইরে ‘বোমা’র সঙ্গে বসবাস করছে মানুষ।

বারবার কেন বিস্ফোরণ

 শয়নকক্ষে লাগানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটিও পরিণত হচ্ছে দানবে।

চলন্ত বোমা যেন গাড়িতে বসানো সিএনজি সিলিন্ডার। কারখানার বয়লার কিংবা রাসায়নিকের গুদাম একেকটি মারণাস্ত্র।
বারবার এগুলোর ভয়ংকর রূপ দেখা যাচ্ছে। বিস্ফোরণে ঝরছে তাজা প্রাণ। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক। কিন্তু কেন এই বিস্ফোরণ? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সর্বদা সঙ্গে থাকা এই ভয়ংকর ‘বোমা’র রক্ষণাবেক্ষণে খুব বেশি সচেতন নয় মানুষ। অবহেলা ও অসতর্কতার অনিবার্য পরিণতি এমন বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা।

এতে এক বছরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহস্রাধিক মানুষ হতাহত হয়েছেন। বিশেষ করে গত চার দিনের ব্যবধানে ঢাকা-চট্টগ্রামে এমন ভয়াবহ তিনটি বিস্ফোরণের ঘটনা দেশবাসীকে শঙ্কায় ফেলেছে। উঠেছে নানা প্রশ্ন।

গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অনাত এই প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষতি এড়াতে সবার সচেতনতা ও সতর্কতা জরুরি। তৎপরতা বাড়াতে হবে তদারকি সংস্থাগুলোকে। বিশেষ করে সেপটিক ট্যাংক, এসি, গ্যাসের লাইন, গাড়ি ও বাসার সিএনজি সিলিন্ডার, কারখানার বয়লার ও রাসয়নিক গুদাম রক্ষণাবেক্ষণে মানুষকে আরও মনোযোগী হতে হবে। একমুহূর্তের অসতর্কতায় এগুলো থেকে ঘটে যেতে পারে এমন ভয়ংকর আরও বিস্ফোরণ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান তার গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনাটি অন্যগুলোর থেকে আলাদা। এটি শিল্পকারখানায় সংঘটিত দুর্ঘটনা, যেখানে প্রচণ্ড চাপ উৎপন্ন হয়ে অক্সিজেন ট্যাংক ও সেপারেশন ইউনিট বিস্ফোরিত হয়েছে এবং বিস্ফোরণ-পরবর্তী অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি আলাদা হলেও ঢাকার সায়েন্সল্যাবের কাছের ভবন, সিদ্দিকবাজারের ভবন এবং ২০২১ সালে মগবাজারের দুর্ঘটনাগুলো একই প্রকৃতির। যেখানে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনাকে বলা হয় কনফাইন্ড স্পেস এক্সপ্লোশন। বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমে বাতাসের সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ মিক্সার তৈরি করলে এ ধরনের বিস্ফোরণ হতে পারে। তবে ঢাকার সায়েন্সল্যাবের কাছের ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছিল ভবনের তিনতলায়। ফলে চাপে দেওয়াল ভেঙে সহজে প্রশমিত হয়েছে। সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল ভবনের বেজমেন্টে হওয়ায় নিচে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যাতে ভবনের সিঁড়িঘর, বেজমেন্ট, ছাদ ভেঙে উড়ে এসে পাশের দেওয়াল এবং ওপরতলার কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ভবনের কলামগুলো বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে পুরো ভবন ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়মিত বিরতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণজনিত ঘটনা ঘটছে। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ভয়াবহ তিনটি বড় বিস্ফোরণের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘটেছে প্রাণহানির ঘটনা। প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গু হয়েছেন অনেকেই। এ তিনটি ঘটনার কোনোটির সঙ্গেই নাশকতা কিংবা পরিকল্পিতভাবে বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহারের আলামত পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তদন্ত শেষে বিস্ফোরণগুলোর পেছনে ভবনগুলোর অভ্যন্তরে সৃষ্ট সমস্যাকেই দায়ী করেছেন।

জানতে চাইলে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিটের প্রধান এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘নানা কারণে যখন একটি আবব্ধ ভবনে বিপুল পরিমাণ গ্যাস জমে, তখন ভবনের কক্ষগুলো একটি গ্যাস চেম্বার হিসাবে কাজ করতে পারে। এর ধারাবাহিকতায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা লাইটার ইগনিশন থেকে যে কোনো সময় স্পার্কিং ভবন বিস্ফোরিত করার জন্য যথেষ্ট। আর এ ধরনের বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা এড়াতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সচেতনতা ও সতর্কতা। বিশেষ করে ভবনের মাটির নিচে অবস্থিত পানির ট্যাংক, সেপটিক ট্যাংক, গ্যাসলাইন বা সংযোগ ও পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেকটাই রোধ করা যাবে।’

শনিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় ‘সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেড’ নামের প্ল্যান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। এতে ৬ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৩২ জন। সিলিন্ডার থেকেই ওই বিস্ফোরণের সূত্রপাত বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তাদের ধারণা, হয়তো কোনো সিলিন্ডারের ব্লাস্টিং ক্যাপাসিটি কম ছিল। এ কারণে বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। পরে অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন, সিলিন্ডারে নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার বিস্ফোরণেই সেখানে প্রাণহানি এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয়। মুহূর্তের দানবীয় বিস্ফোরণে প্ল্যান্টের চারপাশে আধা বর্গকিলোমিটার এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। শুধু এই একটি কারখানাই নয়, আশপাশের আরও কয়েকটি কারখানা ও প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে গত বছরের ৫ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিক থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, অক্সিজেন, রাসায়নিক, বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় মানুষের বিপদ বাড়ছে। যারা বিভিন্ন রাসায়নিক আমদানি করেন, তারা ভোক্তা পর্যায়ে পাঠানোর আগে সতর্কতা অবলম্বন করেন না। আবার দাহ্য পদার্থ ব্যবহারেও সঠিক জ্ঞান নেই অনেকের। নেই কোনো ট্রেনিংও। এসব কেমিক্যাল ব্যবহারের মৌলিক ধারণাও অনেকের মধ্যে নেই। যে কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা বেশি ঘটে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চার দিনের ব্যবধানে রাজধানীর গুলিস্তান, সায়েন্স ল্যাবরেটরি এবং চট্টগ্রামে বড় ধরনের বিস্ফোরণসহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মানুষকে শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ভাবনায় পড়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারক মহল ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তবে প্রতিটি ঘটনার তদন্ত শেষে দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, কোনো ঘটনায়ই নাশকতা কিংবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়নি। কেন নাশকতা বা সন্ত্রাসী ঘটনার শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন, এর কারণ হিসাবে তারা বলেছেন, ঘটনাস্থলে কোনো বিস্ফোরক বা কোনো ধরনের টুকরো, আইইডি সার্কিটের পাশাপাশি দুর্গন্ধযুক্ত বা কালো দাগের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ধোঁয়ার সময় কোনো রঙিন বা কালো ধোঁয়া পাওয়া যায়নি, যা একটি অবিস্ফোরক বিস্ফোরণ নির্দেশ করে। তাছাড়া ভেতর থেকে উদ্ধার করা মৃতদেহ ঝাঁজরার কোনো চিহ্ন নেই, যা গ্যাসীয় বিস্ফোরণকে নির্দেশ করে। আর গুলিস্তানে হতাহতদের কোমর স্তরের ওপরে বার্ন ইনজুরি ইঙ্গিত করে যে গ্যাস সিলিন্ডারটি ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় বিদ্যমান ছিল। এক্ষেত্রে মিথেন গ্যাস বিস্ফোরণেরও নির্দেশ করে।

এমন বড় বিস্ফোরণ ছাড়াও মাঝেমধ্যেই বাসা-বাড়িতে বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের খবর পাওয়া যায়। এসব ঘটনায়ও হতাহত হয়েছে। এক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের বেশির ভাগই ঘটনাই এসিতে জমাটবদ্ধ গ্যাস কিংবা লাইন ও সিলিন্ডার লিকেজের কারণে আবদ্ধ ঘরে গ্যাসের কূপে পরিণত হওয়া থেকে।

গবেষকদের মতে, গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনে জড়িত প্রতিষ্ঠান বা এসব গ্যাসের লাইন তদারকি যাদের দায়িত্বে, তাদের অবশ্যই এখানে করণীয় আছে। প্রথমত, গ্যাসের লাইনগুলো অনেক পুরোনো। আবার ওয়াসার সুয়ারেজ লাইনও বেশ পুরোনো। অনেক ক্ষেত্রে এই লাইনগুলো ক্ষয় হয়েছে। এ লাইনে লিকেজের ঘটনা ঘটে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও মেরামতের মাধ্যমে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। যে এলাকা বা লাইনগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, সেই স্থানগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত মেরামত অথবা পুনঃস্থাপন করতে হবে। রাজধানীর পয়ঃনিষ্কাশন ও গ্যাসের লাইন যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। গ্যাস বিক্রয় ও ডিস্ট্রিবিউশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ভবনে গ্যাসজাতীয় দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন: পুরোনো গ্যাসলাইনগুলো শনাক্ত, মেরামত বা প্রতিস্থাপন করা, গ্যাস রাইজার লিকেজ নিয়মিত পরীক্ষা করা। গ্যাসে গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মিশ্রিত করা, যাতে লিকেজ হলে সহজে শনাক্ত করা যায়। ভবনবাসীর জন্য পুরোনো পাইপলাইন মেরামত ও নিয়মিত লিকেজ পরীক্ষা করা, বদ্ধ জায়গায় গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্তে গ্যাস সেন্সর ও অ্যালার্মের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

এদিকে বিপুলসংখ্যক গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার হচ্ছে যানবাহনে। প্রতিটি সিলিন্ডার যেন চলন্ত বোমা। অনেক ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহারে যাত্রীদের ঝুঁকি বাড়ায়। বেসরকারি একটি সিএনজি কনভার্সন সেন্টারের ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজি সিলিন্ডার পাঁচ বছর পর পর রিটেস্টের নিয়ম থাকলেও অনেকেই তা করেন না। বিশেষ করে ভারী যানবাহনের বেশির ভাগ সিলিন্ডার লাগানোর পর তারা রিটেস্ট করাতে চান না। এক্ষেত্রে তাদের ঝুঁকি বেশি। যানবাহন দুর্ঘটনায় পতিত হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি বেশি থাকে। বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা এড়াতে নিয়ম মেনে সবাইকে যানবাহনের সিএনজি সিলিন্ডার রিটেস্ট করানোর পরামর্শ দেন তিনি।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা কারখানার বয়লার বিস্ফোরণের পেছনে দুটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন। এর একটি হলো প্ল্যান্টে ব্যবহৃত বয়লারটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে তা বিস্ফোরণের শঙ্কা থাকে বেশি। আবার বয়লারে জমে থাকা ‘আইস’ বা বরফের কারণেও বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তাই নিয়মিত বয়লার রক্ষণাবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনসচেতনতার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্তে তদারকি সংস্থাগুলোকে আরও তৎপর হতে হবে। একই সঙ্গে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অবৈধ রাসায়নিকের মজুত বন্ধ এবং অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করা গেলে বিস্ফোরণ ও অগ্নিঝুঁকি কমবে।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/652560