৯ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:৫২

নিহত ২০॥ আহত দুই শতাধিক

সায়েন্সল্যাবে বিস্ফোরণের একদিন পর রাজধানীতে আবারও একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এবার সিদ্দিক বাজার এলাকায় ‘ক্যাফে কুইন্স’ নামে একটি ৭ তলা ভবনে বিস্ফোরণে ২০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। ৪০ জনকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরমধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিহত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের বিপরীতে সিদ্দিক বাজার এলাকায় এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, র‌্যাব, পুলিশ ও সিআইডিসহ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। বিস্ফোরণের কারণ জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। কারণ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস ও মেনটেইনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত ৪ সদস্যের এই কমিটিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। র‌্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান মেজর মশিউর রহমান বলেছেন, এটা স্বাভাবিক কোনো বিস্ফোরণ নয়। ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেছেন, বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা না দুর্ঘটনা, বিশেষজ্ঞরা তা তদন্ত করে দেখছেন। এ ঘটনায় ভবনের মালিক ওয়াহিদুর রহমানসহ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডবি) ।

এদিকে গতকাল বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে আরও দুজনের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এ নিয়ে এ বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হলো। ঘটনার দিন রাত পর্যন্ত ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল উদ্ধার হওয়া দুজনের মধ্যে একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি মমিনুদ্দিন সুমন। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক আকতারুজ্জামান বলেন, দুজনের লাশ ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। লাশ দুটি উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে একজনের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আকতারুজ্জামান আরও বলেন, র‌্যাবের ডগ স্কোয়াডের মাধ্যমে লাশ দুটির সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ভবনের বেজমেন্টের একটা জায়গায় অনেক মাছি ছিল। সেখানে লাশ থাকতে পারে, এটা ভেবে আমরা র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড কাজে লাগাই। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় লাশ দুটি উদ্ধার করা হয়। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমরা শুধু লক কাটার ব্যবহার করেছি। গতকাল বিকেল থেকে উদ্ধার কাজের অংশ হিসেবে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের বেজমেন্টে জমে থাকা পানি অপসারণ কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। বেলা পৌনে চারটার দিকে এ কাজ শুরু হয়। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, সাততলা ভবনটির পানির ট্যাংক ও সেপটিক ট্যাংক ফেটে ভবনটির বেজমেন্টে পানি জমে যায়। ঘটনাস্থল থেকে দেখা গেছে, পাম্প দিয়ে সেচে পানি অপসারণের কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। পাশাপাশি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সাত তলা ভবনটির নিচতলায়, যে অংশ দিয়ে বেজমেন্টে যেতে হয়, সেখানে পড়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ হাত দিয়ে সরানোর কাজ করছেন তারা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে জেলা প্রশাসনের সহায়তাকেন্দ্র ও নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এ টি এম হেদায়েতুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, স্বজনেরা তাদের কাছে পাঁচজন নিখোঁজ থাকার তথ্য জানিয়েছিলেন। এর মধ্যে দুজনের খোঁজ পাওয়া গেছে। তিনজনের ব্যাপারে এখনো কিছু জানা যায়নি। অন্যদিকে গতকাল আবারও উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ঢাকা জেলা প্রশাসন অর্থসহায়তা দেবে বলেও উল্লেখ করেন এ টি এম হেদায়েতুল। তিনি বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ৫০ হাজার, গুরুতর আহত ব্যক্তিদের ২৫ হাজার এবং সাধারণ আহত ব্যক্তিদের ১৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার বিকালে নর্থ সাউথ রোডের ১৮০/১ হোল্ডিংয়ের সাত তলা ‘ক্যাফে কুইন্স’ ভবনে বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। ভবনে থাকা বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীদের পাশাপাশি সামনে রাস্তায় থাকা যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীরাও ছুটোছুটি শুরু করেন। বিস্ফোরণের পর থেকে দুই শতাধিক মানুষকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আরও অন্তত শতাধিক মানুষ চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। বিস্ফোরণে ‘ক্যাফে কুইন্স’ ভবনের প্রথম দুটি তলার ছাদ ধসে বেজমেন্টে পড়ে। সে কারণে ভেতরে আরও কেউ আটকা পড়ে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হলেও তাদের সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না উদ্ধারকর্মীরা। কীভাবে সেখানে এত বড় বিস্ফোরণ ঘটল, সে বিষয়েও কিছু জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিসসহ ঘটনাস্থলে আসা কোনো সংস্থা। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সিদ্দিক বাজারের ওই ভবনে বিস্ফোরণের খবর পান বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে। প্রথমে ছয়টি ইউনিট সেখানে গেলেও পরে তা বেড়ে হয় ১১টি। ডিএমপির কাউন্টারিজম ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট এবং সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশের একটি দলও পরে তল্লাশিতে যোগ দেয়। সাত তলা যে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার নিচের দুটো তলায় স্যানিটারি সামগ্রী আর গৃহস্থালি সামগ্রীর বেশ কয়েকটি দোকান ছিল। তার উপরে ছিল ক্যাফে কুইন নামের একটি খাবার হোটেল। সে কারণে ওই নামেই ভবনটি স্থানীয়রা চেনে। বিস্ফোরণে দেয়াল ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি ভেতরের জিনিসপত্র ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসে। ভবনের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সাভার পরিবহনের একটি বাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিস্ফোরণের ধাক্কায়।

ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আকতার বলেন, অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জীবনহানি অনেক ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের বিস্ফোরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। পাশের সাকি প্লাজা নামের পাঁচতলা ভবনের ওপরে চারটি ফ্লোরে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলিস্তান শাখা এবং ব্র্যাক ব্যাংকের এসএমই সার্ভিস সেন্টার। বিস্ফোরণের ধাক্কায় কাঁচ ভেঙে ব্যাংকের অফিস কক্ষগুলোর পর্দা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ভবনে বিস্ফোরণের পর নিরাপত্তার কথা ভেবে পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজার, নয়াবাজার, নর্থ সাউথ রোড় এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিস্ফোরণের পর নর্থ সাউথ রোড ও আশেপাশের সড়কে স্থানীয়রা ভিড় করলে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। এতে উদ্ধার কাজেও বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ বেশ কয়েকটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এর প্রভাব পড়ে পুরান ঢাকাকে যুক্ত করে এমন সব সড়কে। তাতে গুলিস্তান, মতিঝিলসহ রমনা পর্যন্ত সড়কেও যানজট দেখা দেয়। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন রাত ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ভবনের নিচের কলামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানে তারা যেতে পারছেন না। সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা এসেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিস্ফোরণ যখন ঘটে মার্কেট তখন খোলা ছিল; ক্রেতা, বিক্রেতা, কর্মচারীরা ছিলেন। কতজন ভেতরে আটকা পড়ে আছে তা তাদের জানা নেই।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা: স্থানীয় দোকানদার মোহাম্মদ বিজয় বলেন, আসরের নামাযের সময় সবাই যখন জামাতে দাঁড়াইছে, তখনই বিস্ফোরণের শব্দ পাই। প্রথমে ভাবছি বোমা বোধহয়। কয়েক মিনিট ধোঁয়ায় পুরা এলাকা ঢাকা ছিল। যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার কাছেই বি আরটিসির বাস কাউন্টার। ব্যস্ত ওই সড়কে যানবাহনের পাশাপাশি প্রচুর পথচারী ছিল সে সময়। বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে গেছেন ভবনের নিচতলার বাদশা ট্রেডিংয়ের শ্রমিক আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, দোকানের ম্যানেজার কোথায় চা আনতে বাইরে গিয়েছিলেন। হঠাৎ বিস্ফোরণে বিকট আওয়াজে তিনি চেতনা হারান। বিস্ফোরণে আগে দোকানের ভেতরে অন্তত তিনজন ছিলেন এবং দোকানের বাইরে ছিলেন স্যানিটারি দোকানের ৭-৮ জন শ্রমিক। বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত কামাল আহমেদ বলেন, ‘আমি ফুটপাতে বেল কিনছিলাম। এমন সময় হঠাৎ বিকট একটা আওয়াজ হলো। শব্দে শুনে আমি পড়ে গেলাম। আমার হাতে বাজারের ব্যাগ ছিল। সেখানে বাসার বাজার ছিল। সব পড়ে গেছে। দেখি পুরো এলাকায় ধোঁয়া। কোনো ভবন দেখা যাচ্ছে না। সব মানুষ খালি দৌড়াচ্ছে। আমিও ব্যাগটা কোনোরকমে নিয়া আস্তে আস্তে চলে আসছি।’ আহত কামাল আহমেদ রাজধানীর একটি বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করেন। বিকেলে বাবুবাজারে তার অফিস থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্তানে পৌঁছানের পর ভবন বিস্ফোরণে আহত হন তিনি। চা দোকানদার সোহরাব হাসানের ভাষ্য- ঘটনার সময় সড়কে যানজট ছিল না। সদরঘাটের দিক থেকে গুলিস্তানগামী যানবাহনগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই দুটি বাসের যাত্রী ছিলেন। আহত ব্যক্তিরা তখন শুধু বাঁচার জন্য সহায়তা চেয়ে আর্তনাত করছিলেন।

বিস্ফোরণের পর থেকে ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক উৎসুক জনতা ভিড় করছিলেন। তাদের সরাতে হিমশিম খেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশকে। সরিয়ে দেওয়া হলেও তারা আবার ঘটনাস্থলের আশপাশে এসে ভিড় করছিলেন। উৎসুক জনতার কারণে আহত কাউকে উদ্ধার করার পর তাদের হাসপাতালে পাঠাতেও বেগ পেতে হচ্ছিল। ভবনের বেজমেন্ট, নিচতলা ও দ্বিতীয় তলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস বেজমেন্ট ছাড়া পুরো ভবনেই তল্লাশি চালিয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, সাততলা ভবনটির নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার সামনের অংশ ভেঙে মূল সড়কে এসে পড়েছে। সাততলা ভবনটির উত্তর পাশে ১৮০ নম্বর ভবন। এ ভবন পাঁচতলা। ভবনের নিচতলার একটি দোকান পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ ভবনেরও প্রতি তলার জানালার কাঁচ ভেঙে পড়েছে। বিস্ফোরণ স্থলের ভবন লাগোয়া দক্ষিণ পাশের সাততলা আরও একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই ভবনের নিচতলার সিঁড়ির অংশ পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। রাত ১২টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবন থেকে ১৮ জনের লাশ এবং ৪০ জনকে জীবিত উদ্ধার করেন বলে সংস্থাটির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইনউদ্দিন জানিয়েছেন। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, এ বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত ১৮ জনের লাশ এ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

১৬ জনের লাশ হস্তান্তর: বিস্ফোরণে নিহত ১৮ জনের মধ্যে ১৬ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ২টা পর্যন্ত ঢাকার জেলা প্রশাসন মরদেহগুলো হস্তান্তর করে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার সুবীর কুমার দাশ বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৭টি লাশ ছিল। পরিবারের সদস্যদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬টি হস্তান্তর করা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে একটি লাশ স্বজনরা জোর করে নিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। যে ১৬ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে তারা হলেন-মুনসুর, আলামিন, আবু বক্কর সিদ্দিক, নাজমুল হোসেন, রাহাত, ওবায়দুল হাসান, নুরুল ইসলাম, হৃদয়, মাইনুদ্দিন, মমিনুল, নদী, আকুতি বেগম, ইসমাইল হোসেন, ইছহাক মৃধা, সুমন ও আব্দুল হাকিম।

আহত ১০ জন শঙ্কামুক্ত নন : শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ১০ জনের কেউই শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। বার্ন ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান তিনি। ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, দুর্ঘটনায় আমাদের এখানে ১১ জন রোগী ছিল। তার মধ্যে একজনকে ঢাকা মেডিকেলে ট্রান্সফার করা হয়েছে। কারণ তার শরীরে আগুন লাগেনি। এছাড়া ভর্তি ১০ জনের মধ্যে তিনজন আইসিইউতে, দুইজন লাইফ সাপোর্টে আছে। আর বাকিরা আছেন এসডিইউতে। সামন্ত লাল সেন আরও বলেন, যারা আছেন তাদের কেউই শঙ্কামুক্ত নয়। কারও শরীরের ৮০ শতাংশ, কারও ৯০ শতাংশ, কারো ৫০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। সবারই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। আমরা কাউকেই শঙ্কামুক্ত বলতে পারব না। আহত অবস্থায় মো. হাসান ও জাহান আইসিইউতে ভর্তি। হাসান আইসিইউ এর ১১ নম্বর বেডে ও জাহান ৯ নম্বর বেডে আছেন। মো. মুসা এসডিইউ এর ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ নম্বর বেডে আছেন। ওলিল শিকদার, খলিল শিকদার, ইয়াসিন আলী, মো. বাবলু, আল-আমীন, বাচ্চু মিয়া পোস্ট ওপারেটিভে ভর্তি আছেন। এ ছাড়া আজম ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডের এক নম্বর বেডে ভর্তি আছেন এবং মোস্তফা নামে একজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বার্ন ইউনিট থেকে ঢাকা মেডিকেলে হস্তান্তর করা হয়েছে। মো. হাসানের ১২ শতাংশ, জাহানের ৫০ শতাংশ, মো. মুসার ৯৮ শতাংশ, ওলিল শিকদারের ২০ শতাংশ, খলিল শিকদারের ৮ শতাংশ, ইয়াসিন আলীর ৫৫ শতাংশ, মো. বাবলুর ১৮ শতাংশ, আল-

কারণ জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: গুলিস্তানের ভবনে বিস্ফোরণের কারণ জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ভবনটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতে পরিণত হয়েছে। এখানে মূল দায়িত্ব পালন করছে ফায়ার সার্ভিস। তাদের সহায়তা করছে পুলিশ ও র‌্যাব। তিনি বলেন, বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে পারবো কেন এই বিস্ফোরণ ঘটেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র না নিয়ে কিংবা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে কেউ যেন এ ধরনের ভবন নির্মাণ না করেন। সবকিছু মেনে ভবন নির্মাণ করলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমে যেত।

বিস্ফোরণ স্বাভাবিক নয়, র‌্যাব: গুলিস্তানের বিস্ফোরণ স্বাভাবিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন র‌্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান মেজর মশিউর রহমান। গতকাল দুপুরে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান। তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে ধারনা করছি ভবনের বিস্ফোরণ বেজমেন্ট থেকে হয়েছে। এটি স্বাভাবিক কোনো বিস্ফোরণ নয়। গ্যাস জমে কিংবা অন্য কোনোভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এ ঘটনা এসি থেকে ঘটেনি, এটা নিশ্চিত হয়েছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে উদ্ধার কার্যক্রমের অগ্রগতি নিয়ে র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড এবং বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট এখানে উপস্থিত আছে। তারা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এবং রাজউকের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে।

ভবনের ভেতর এখনো মানুষ আটকে থাকতে পারে: এখনো ভবনের ভেতরে মানুষ থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইনউদ্দিন। তিনি বলেন, ভবনের নিচতলা ও ভিত্তির অনেক ক্ষতি হয়েছে। কলামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে আমরা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারছি না। মঙ্গলবার রাত ৯টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ৪টা ৫মিনিটে ভবনটিতে বিস্ফোরণ হয়। বেজমেন্ট এবং গ্রাউন্ড ফ্লোরটা অনেকটুকু ধসে গেছে। ভবনের কলামগুলো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত যার কারণে আমরা এখন ভবনে ঢুকতে পারছি না। আমরা রাজউক সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছি। এ অবস্থায় ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। যেহেতু ঝুঁকিপূর্ণ সেহেতু আমরা এ মুহূর্তে ঢুকতে পারছি না। সেনাবাহিনীর থেকে আমি সহযোগিতা নিচ্ছি। এটাকে আমরা ফ্লোরিং করে আমরা একটু স্টেবল করে উদ্ধার অভিযান করবো। আশপাশে এবং ওপরের দিকে আমরা অভিযানটা পরিচালনা করছি। দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারা বলেছেন ভবনের নিচে কোনো গ্যাসের লাইন ছিল না। তবে পানির লাইন ছিল এবং পানির রিজার্ভার ছিল। তাই এখনো আমরা বলতে পারছি না কারণটা কী। সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল এসেছে। অন্য কোনো কিছু আছে কি না আমরা এখন এটা তদন্ত করবো। তদন্ত করে আমরা আপনাদের জানাবো, একটু সময় লাগবে। ভেতরে নিখোঁজ রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মার্কেটটি চালু ছিল যখন বিস্ফোরণটা হয়।

প্রাণের সন্ধানে ডগ স্কোয়াড: ভবনে এখনো কেউ আটকা পড়ে আছেন কিনা তা খুঁজতে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এর ডগ স্কোয়াড আনা হয়েছে। গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বিধস্ত ভবনের পাশে একটি গলিতে ডগ স্কোয়াড নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন র‌্যাব সদস্য বলেন, আমরা অনেকগুলো কুকুর নিয়ে এসেছি। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন যখন চাইবে তখন এগুলো নিয়ে উদ্ধার কাজে যাওয়া হবে। তিনি বলেন, এগুলো মূলত ভবনের ভেতরে কেউ চাপা পড়ে আছে কিনা, কেউ বেঁচে আছে কিনা সেগুলো শনাক্ত করবে। লাশ থাকলেও শনাক্ত করবে। এর বাইরে যদি বিস্ফোরক জাতীয় কিছু থাকে তাও চিহ্নিত করার জন্য ডগ স্কোয়াড আনা হয়েছে। দুপুর ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেইন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা লাইট রেসকিউ (হালকা যন্ত্রপাতি দিয়ে) অভিযান করছি। ডেড বডি লোকেট (শনাক্ত) করার জন্য ডগ স্কোয়াড আনা হয়েছে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী, সিটি করপোরেশন, রাজউকের ইঞ্জিনিয়ারদের সমন্বয়ে একটি কমিটি হয়েছে। বিল্ডিংটা ঝুঁকিপূর্ণ; এটাকে সাপোর্ট দিতে হবে। তারপর হেভি রেসকিউ একটিভিটিজ চালানো হবে।

গ্যাসের কারণে বিস্ফোরণ হয়নি, তিতাস: ঢাকা শহরে পাইপলাইনে সরবরাহ করা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের গ্যাসের কারণে সিদ্দিক বাজারের বিস্ফোরণ হয়নি বলে মত দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পর এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিস্ফোরণের পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘটনাস্থলে গেছেন। সেখান থেকে দুপুরে তিতাসের পরিচালক (অপারেসন্স) ইঞ্জিনিয়ার সেলিম মিয়া বলেন, সংবাদ পাওয়ার পরই আমরা তদন্ত শুরু করেছি। বিস্ফোরণের শিকার ভবন দুটিতে তিতাসের সরবরাহ করা গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে সেলিম মিয়া বলেন, ‘ডিটেক্টর দিয়ে আমরা কোনো গ্যাসের উপস্থিতি পাইনি। একটি রাইজার পাওয়া গেছে, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এখন পর্যন্ত গ্যাসের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।’ তিনি বলেন, যদি গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হতো, তাহলে এখানে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটত।

ভবনের মালিক ডিবি হেফাজতে: সিদ্দিক বাজারে বিস্ফোরিত সাততলা ভবনের মালিক ওয়াহিদুর রহমানকে হেফাজতে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি। গতকাল বিকালে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে, মঙ্গলবার রাতে ওই ভবনের ‘বাংলাদেশ স্যানিটারি’ দোকানের মালিক আবদুল মোতালেব মিন্টুকে হেফাজতে নেয় ডিবির লালবাগ বিভাগ। পরে ভবনের মালিক ওয়াহিদুর রহমানকে হেফাজতে নেয় ডিবি। এ ছাড়াও আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।

গুলিস্তানে বিস্ফোরণ হওয়া ভবনটির মালিক ছিলেন রেজাউর রহমান নামে এক ব্যক্তি। তিনি মারা যাওয়ার পর তার তিন ছেলে ওয়াহিদুর রহমান, মশিউর রহমান ও মতিউর রহমান ভবনটির মালিক হন। এর মধ্যে বড় ভাই ওয়াহিদুর রহমান ও ছোট ভাই মতিউর রহমান ভবনটি পরিচালনা করতেন। আর মেজো ভাই মশিউর রহমান দেশের বাইরে লন্ডনে বসবাস করেন। এর মধ্যে ওয়াহিদুর রহমানকে হেফাজতে নিয়েছে ডিবি পুলিশ। এর আগে সকালে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা বাড়ির মালিক, দোকান মালিকদের ডেকেছি। বাণিজ্যিকের নিয়ম মতো বেজমেন্টে দোকান দেওয়ার কথা না। এ ছাড়া স্যুয়ারেজ লাইন, সেপটিক ট্যাংক, ওয়াটার রিজার্ভার-এগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো কি না, এসব বিষয়ে আমরা তাদের কাছে জানতে চাইবো। কার অবহেলায় এই হতাহতের ঘটনা ঘটল, তা জানতে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। এ ছাড়া বাহির থেকে কেউ এটা ঘটিয়েছে কিনা বা এমন সুযোগ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখছি।

 

https://dailysangram.com/post/518691