৯ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:৪৬

গ্রামীণ মধ্যবিত্তের অবস্থা ভয়াবহ

-শওকত এয়াকুব

সমাজের উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মাঝামাঝি স্তরে যাদের অবস্থান তাদের মধ্যবিত্ত বলা হয়। তবে মধ্যবিত্তের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। বাংলা অভিধানে মধ্যবিত্ত শব্দ বলতে বোঝায় ধনী-দরিদ্রের মধ্যবর্তী অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। বিশেষ ধনী বা নিতান্ত দরিদ্র নয় এমন। মধ্যবিত্তের জীবনটা কত যে কষ্টের তা ভুক্তভোগী ব্যতীত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। বর্তমানে মধ্যবিত্ত অনেকটাই বিভ্রান্ত। তারা টিকে থাকার জন্য সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছে না। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেই ভয় তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রের অবস্থান রয়েছে। আমাদের গ্রামগুলোতে উচ্চবিত্তের বাস নেয়, গ্রামের সব মানুষ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র। বর্তমান গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাদের ইচ্ছে পূরণের জায়গাগুলো ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নিত্যপণ্য, জ্বালানি তেল, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব। নানা সমস্যা সংকটে তাদের মৌলিক চাহিদা ও স্বপ্ন প্রতিনিয়ত মাঠে মারা যাচ্ছে। তারা হয়ে পড়ছে হতাশাগ্রস্ত দিশেহারা। ছোট হয়ে যাচ্ছে তাদের মন-মানসিকতা। কেবল অর্থনৈতিক কারণে অনেক পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। শারীরিক নির্যাতন, হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। যার সরল কথা হচ্ছে গরিবের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা এখন ভর করেছে মধ্যবিত্তের ওপর। মধ্যবিত্তের জীবন এখন হতাশার কাফনে মোড়া। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। মধ্যবিত্তের সংকট সমস্যা টানাপড়েন যেভাবেই বলি বা ব্যাখ্যা দিই না কেন, যতই বলি এই সংকট আর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক। তবে মূল সংকট হচ্ছে অর্থনৈতিক।

গ্রামীণ মধ্যবিত্ত এমন একটি শ্রেণি-যারা সীমিত আয়ের মানুষ। অথচ জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ সবকিছু দাম ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্তের অবস্থা বড়ই করুণ। গ্রামীণ মধ্যবিত্তের খরচের দুটি দিক বেশ ব্যয়বহুল। খাদ্য ও শিক্ষা। যারা প্রান্তিক গ্রামে থাকেন তাদের কথা বাদদিলে যেসব মধ্যবিত্ত পরিবার উপজেলায় বা পৌরসভায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। তাদের আরও একটি খরচ হলো বাসা ভাড়া। কোনো রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রতি বছর বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়। শিক্ষার পরিস্থিতিও একই। যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালান তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক মানসিকতা অত্যন্ত প্রকট। তারা নানা অজুহাতে অভিভাবকদের গলাকাটছে। আর খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণেও গ্রামীণ মধ্যবিত্তের দিশেহারা অবস্থা। নিত্যপণ্যের বাজারে চাল-আটা, চিনি, মাছ-গোশত, ডিম-মুরগি, শাকসবজি সবকিছুর দামই এখন ঊর্ধ্বমুখী।

বর্তমান বাজারে সবধরনের চালের দাম অনেক বেশি। অতীব গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপণ্য বেশি সময় ধরে উচ্চমূল্য ধারণ করেছে। গ্রামের প্রায় সব খুচরা ও পাইকারি বাজারে বেড়েই চলেছে সবজির দাম। এক কেজি কাঁচা মরিচের মূল্য ১০০ টাকা, মুলা ৪০ টাকা, টমেটো ২০ টাকা, লাউ ৪০-৫০ টাকা। জেলাশহরগুলোতে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত টিসিবির ট্রাকের পেছনে দৌড়াতে পারলেও গ্রামের মধ্যবিত্ত ও মিম্নবিত্ত দৌড়াতে পারে না। কারণ গ্রামের টিসিবির ট্রাক আসে না। কালেভদ্রে একবার আসলেও পৌরসভা এসে চলে যায়। প্রান্তিক জনপদের মানুষ এসব জানেও না। ওয়ার্ডভিত্তিক কোন রিলিফ দিলে তা পায় দরিদ্র ও দলীয় লোকেরা। এতেও মধ্যবিত্তের কোন অংশ নেই। মধ্যবিত্তরা পড়ে বিপাকে, পেটে খাবার না থাকলেও লজ্জায় কারো কাছে না পারে বলতে, না পারে খাবার জোগাড় করতে। তারা জীবনের সাধ-আহ্লাদ ত্যাগ করে, মাসিক বাজারের তালিকা ছোট করেও সংসারের খরচ মেটাতে পারছে না। একসময় নিম্নবিত্ত ও দরিদ্ররা সরকারি হাসপাতালের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিত। এখন মধ্যবিত্তরা দেড় মিনিটের সেবা নেয়ার জন্য সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। দ্রব্যমূল অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এরা না পারছে সইতে, না পারছে কাউকে কিছু বলতে। শুধু ভাগ্যকে দোষ দিয়ে একেকটি দিন পার করছে। মধ্যবিত্তরা সর্বত্র নিপীড়নের শিকার। চাকরি বলুন আর ব্যবসায় বলুন, কোনো জায়গাতেই তাদের ঠাঁই নাই। সব জায়গাতে তারা ঠকে। বেতন বাড়ে না। অফিসে বেতন বাড়ানোর কথা বললে পুঁজিবাদী স্টাইলে বলা হয়, না পোষালে চাকরি ছেড়ে চলে যান। অথচ বড় কর্তাব্যক্তিদের বছর ঘুরলেই বেতন বাড়ে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের বেতন কচ্ছপ গতিতেও বাড়ে না। এটি কি বৈষম্য নয়! বাড়িভাড়া বাড়লে চোখে সর্ষেফুল দেখে। কিন্তু কথা বলতে পারে না। অনেকে তো গরুর গোশত খাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন। যেখানে ডিম খাওয়ার সামর্থ্য নেই, সেখানে ৮৫০-৯০০ টাকা দিয়ে এক কেজি গরুর গোশত খাবেন কি করে? ছাগলের গোশত খাওয়ার কথা মধ্যবিত্ত কল্পনাও করে না।

মাছের রাজা ইলিশ খেতে কার না ইচ্ছে করে বলুন? কিন্তু মধ্যবিত্ত ইলিশ কিনতে গিয়ে এক পা সামনে দিয়ে একটু উঁকি মেরে দু’পা পেছনে চলে আসে। কারণ একটিই- পকেটের বাজেটে ইলিশ কেনা সম্ভব নয়। একজন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় করলেও মাসিক বাজার করতে গিয়ে মাস শেষে ঋণ করে সংসারের চাহিদা মেটাতে হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের বোবাকান্না হাওয়ায় ভাসছে। কারণ ছাড়াই পণ্যের দাম বাড়ছে। যে যার মতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে পকেট ভারী করছে। এতে সীমিত আয়ের মানুষ ও চাকরিজীবীরা চাপে পড়েছেন। চিকিৎসা কিংবা অন্য কোনো বিপদ এলে তারা ব্যয় সঙ্কোচন নীতি অবলম্বন করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্ষুধার্ত ও মজলুম মানুষের আহাজারি আল্লাহতায়ালার আরশ নাড়ায়।

 

https://dailysangram.com/post/518658