সিকিমে তিস্তা নদীর উপর নির্মিত বাঁধসমূহের অন্যতম সিকিম ড্যামের দৃশ্য -ওয়েবসাইট
১৯ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ১০:১৯

পানি নয় যেনতেন একটা চুক্তি দিতে চায় ভারত!

 

বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তির কোন নিশ্চয়তা ছাড়াই তিস্তা নিয়ে যেনতেন প্রকার একটি চুক্তি করতে প্রস্তুত হচ্ছে ভারত। যেমন গঙ্গার উজানে পানি প্রত্যাহার ও প্রবাহ আটকে রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি করা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না। তিস্তার ক্ষেত্রেও একই ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ অপেক্ষা করছে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত।
ভারতের অপর রাজ্য সিকিমে এযাবৎ ৮টি বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার ৬০ ভাগ পানি আটকে রাখা হয়। ফলে যথেষ্ট পরিমাণ পানি পশ্চিমবঙ্গেও এসে পৌঁছায় না। এ কারণে অবশিষ্ট পানির ভাগ তারা বাংলাদেশকে দিতে রাজি নয় বলে পশ্চিমবঙ্গের সংশ্লিষ্টরা বলে আসছে।
কল্যাণ রুদ্রের রিপোর্ট
সম্প্রতি তিস্তার পানিবণ্টনকে কেন্দ্র করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। পশ্চিমবঙ্গের নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে করা ওই রিপোর্টে তিস্তায় শুষ্ক মওসুমে পর্যাপ্ত পানি থাকে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পাঠানো ওই রিপোর্টে সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ পরিদর্শন করার জন্য ভারতের পার্লামেন্টারি কমিটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, শুষ্ক মওসুমে তিস্তার পানির ৬০ শতাংশ এ বাঁধগুলোয় আটকে যাচ্ছে। মাত্র ৪০ শতাংশ পানি পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে এসে পৌঁছায়। এতে বলা হয়, শুষ্ক মওসুমে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ কিউবিক মিটার পানি থাকে তিস্তায়। সে সময় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সেচের পানির চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন প্রতি সেকেন্ডে ১ হাজার ৬০০ কিউবিক মিটার। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সেচ অধিদফতরের দাবি, তিস্তার পানি কমে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের সেচের চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করা যাচ্ছে না। এর থেকে বাংলাদেশকে পানির ভাগ দিতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে সেচের পানি মিলবে না। সেচ ছাড়াও তিস্তা থেকে উত্তরবঙ্গে দৈনিক পাঁচ কোটি লিটার পানীয় পানি সরবরাহ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সেচ দফতরের অভিযোগ, সিকিমে তিস্তার ওপর যে আটটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সে বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে কিছু জানানোই হয়নি। উল্লেখ, এ মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। সফরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার আশা করা গেলেও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে তিস্তার পানির প্রবাহ যাচাই করতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নদীবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে একটি দল এ রিপোর্ট তৈরি করেন। এর আগেও কল্যাণ রুদ্র তিস্তা নিয়ে একই ধরনের রিপোর্ট করেছিলেন। প্রসঙ্গত, তিব্বতের হিমবাহ থেকে সৃষ্টি হওয়া তিস্তা ভারতের সিকিম হয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে প্রবেশ করেছে। এরপর নদীটি প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। এই দীর্ঘ পথের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সিকিমে তিস্তার ওপর আটটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বাঁধের মধ্যে রয়েছে, চুঙ্গাথান ড্যাম, টিনটেক ড্যাম, শেরওয়ানি ড্যাম, রিয়াং ড্যাম, কালিঝোরা ড্যাম, ভিমকং ড্যাম, লানছেন ড্যাম ও বপ ড্যাম। এগুলো থেকে সিকিম সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। আবার পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে পানি আটকে তা তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খাল দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে।
শুধুই চুক্তিতে কী লাভ?
বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ তিস্তার পানি পাচ্ছে না- এটাই সত্য। এজন্য সিকিম দায়ী না পশ্চিমবঙ্গ দায়ী সেটা বাংলাদেশের ধর্তব্য নয়। ভারত নদীর উজানে পানি আটকে রেখে আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে- এটাই এখন বাস্তবতা। এখন সিকিমের বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখা আর পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবায় বাঁধ ও লিংক ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহারের পর বাংলাদেশ কিভাবে পানি পাবে- সে প্রশ্নের সমাধান ভারতকেই করতে হবে। পানি আটকে রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে মিছামিছি একটা চুক্তিতে কোন লাভ হবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ভারতের সংশ্লিষ্ট মহল বাংলাদেশকে সান্ত¡না দেয়ার লক্ষ্যে কোনরকম একটা ‘চুক্তি’ উপঢৌকন দিতে তৎপর বলে জানা গেছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন কিভাবে হবে- সেটা বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। এর আগে গঙ্গার পানি নিয়ে চুক্তির ক্ষেত্রেও একই রকম ‘ফাঁকি’র ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উজানে গঙ্গায় অসংখ্য বাঁধ, ব্যারেজ ও ক্যানেল তৈরি করে ভাটির দিকে পানি আসতে বাধা দেয়া হচ্ছে। এর ফলে ফারাক্কা পয়েন্ট পর্যন্ত যথেষ্ট পানি পৌঁছাতে পারছে না। সে কারণে বাংলাদেশও স্বাভাবিক প্রবাহ দূরে থাকুক- শুষ্ক মওসুমে চুক্তির অংশটুকুও পাচ্ছে না।
তিনমাসে গঙ্গার চিত্র
তিন মাসের হিসেবে দেখা যায়, গঙ্গাচুক্তি অনুযায়ী এই সময়ে পানি পাওয়ার কথা ছিল ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৩১৯ কিউসেক। চুক্তির ইন্ডিকেটিভ শিডিউল অনুযায়ী এ পরিমাণ পানিই নিশ্চিত করার কথা ভারতকে। কিন্তু দেশটি ফারাক্কা পয়েন্টে চুক্তির সংলগ্নি-১-এর বণ্টন ফর্মুলা অনুয়ায়ী বাংলাদেশকে দিয়েছে তিন লাখ ৮১ হাজার ৫৮২ কিউসেক পানি, অর্থাৎ ৫৬ হাজার ৭৩৭ কিউসেক পানি কম। অর্থাৎ প্রায় পুরো তিন মাসে বাংলাদেশ ফারাক্কা পয়েন্টে পানি কম পেয়েছে এবং এটা চলছেই। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফারাক্কা পয়েন্টে পুরো জানুয়ারিতেও পানি কম পেয়েছে বাংলাদেশ। জানুয়ারির পুরো মাসে তিন কিস্তিতে ২৮ হাজার ২৮৭ কিউসেক পানি কম পেয়েছে বাংলাদেশ। সামনের শুষ্ক সময়গুলোতে এই পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তিস্তার উপরে ৩৫ প্রকল্প
ভারত আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার উপরে আরো বহুসংখ্যক পানি-বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পের জন্য বিশাল বিশাল বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করা হচ্ছে পানি সংক্ষণের জন্য। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় পানির বৃহৎ বৃহৎ রিজার্ভার গড়ে তোলা হবে এবং এগুলোর শক্তিশালী প্রবাহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। তিস্তা নদীর উপরে ভারতের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো হলো, ভাসমি, বিমকং, চাকুং, চুজাচেন, ডিক চু, জোরথাং লোপ, লাচিন, লিংজা, পানান, রালাং, রামমাম-১, রামমাম-৪, রণজিৎ-২, রনজিৎ-৪, রাংইয়ং, রাতিচু-বাকচা চু, রিংপি, রংনি, রুকেল, সাদা মাংদের, সুনতালি তার, তালিম, তাশিডিং, তিস্তা-১, তিস্তা-২, তিস্তা-৩, তিস্তা-৪, তিস্তা-৬, থাংচি, টিং টিং প্রভৃতি। এছাড়াও বর্তমানে চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, লোয়ার লাগিয়াপ, রামমাম-২, রণজিৎ-৩, তিস্তা-৫ এবং রঙ্গিচু। এগুলো সবই পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।
বিশেষজ্ঞ মতামত
এবিষয়ে বিশিষ্ট নদী গবেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ড. ফখরুল ইসলাম বলেন, সিকিম বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তিস্তার উপরে যে প্রকল্প করেছে তার ছেড়ে দেয়া পানি নিশ্চয়ই কোন না কোন কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এই পানি আটকে থাকার কথা নয়। হয়তো আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে অন্যদিকে প্রত্যাহার করা নেয়া হচ্ছে। এই বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণসহ সার্ভে হওয়া প্রয়োজন। আর ভারত রাজি হলে তিস্তার বাড়তি পানি আরেকটি সংযোগ খাল খনন করে বাংলাদেশের তিস্তায় প্রবাহিত করার সুযোগ রয়েছে। এব্যাপারে এডিবিকে যৌথ প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে। এজন্য সদিচ্ছাসহ যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য রাজনৈতিকভাবে একমত হতে হবে। ড. ফখরুল মনে করেন, রাজ্য পর্যায়ে ঠেলাঠেলির মধ্যে বাংলাদেশের প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। সময় ক্ষেপণের চেয়ে বিকল্পের দিকে অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে তিনি মনে করেন।

 

http://www.dailysangram.com/post/280307-