১৯ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ১০:১৫

খুলনাঞ্চলে ভাইরাস ফ্রি উন্নতমানের চিংড়ি পোনায় ব্যাপক মড়ক

খুলনাঞ্চলে ভাইরাস ফ্রি উন্নতমানের চিংড়ি পোনায় ব্যাপকভাবে মড়ক দেখা দিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির চিংড়ি মরে গেছে। আধা নিবিড় পদ্ধতিতে এ চিংড়ির চাষ করেন চাষিরা। কিন্তু মড়কের কারণে চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভাইরাস আক্রমণে চিংড়ি পোনার মড়ক অব্যাহত রয়েছে। ভাইরাস ফ্রি উন্নতমানের পোনা ব্যবহার করা সত্ত্বেও মড়ক কিছুতেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। পোনার মড়ক অব্যাহত থাকায় চিংড়ি চাষিরা বর্তমানে চরম হতাশায় ভুগছেন।
সূত্র জানায়, গত তিন দশক ধরে খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা, কয়রা, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর এলাকায় চিংড়ি চাষ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে অনেকে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ২০০২ সাল থেকে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে (স্বল্প জমিতে অধিক উৎপাদন) বাগদা চিংড়ির চাষ শুরু করেন। বর্তমানে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ির চাষ চলছে। কিন্তু ভাইরাসের কারণে চাষিরা বিকল্প চাষের কথা ভাবছেন।
খুলনার কয়রা উপজেলার আমাদী এলাকার আয়শা আমির অ্যাকোয়া কালচার লিমিটেড’র স্বত্বাধিকারী আমীর আলী জানান, তার পাঁচটি পুকুরের মধ্যে সাড়ে সাত বিঘা জমির তিনটি পুকুরেই ভাইরাস আক্রমণ করেছে। এতে প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ মরে গেছে। সময়মত প্রবায়োটিক এবং মিনারেলস সরবরাহ না পাওয়ায় এ ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ ব্যাপারে কয়রা উপজেলা মৎস্য অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মো. আলাউদ্দিন বলেন, ভাইরাস ফ্রি উন্নতমানের চিংড়ি পোনায় ভাইরাসের আক্রমন রোধে চিংড়ি চাষিদের নিয়ে সেমিনার করে করণীয় দিক নিদের্শনা দেয়া হচ্ছে।
এদিকে খুলনা জেলার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা কপিলমুনিতে ৮০’র দশকে শুরু হয় চিংড়ি চাষ। শুরুর দিকে চিংড়ি চাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় কপিলমুনিসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এ চাষ ব্যবস্থা। ৯০ দশকের মাঝামাঝিতে দেখা দেয় ভাইরাসসহ নানা রোগ বালাই। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে চিংড়ি শিল্পকে এগিয়ে নিতে থাকেন এ শিল্প সংশ্লিষ্টরা। ফলে চড়া মূল্যে হারির টাকা দিয়ে ঘের করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা, এমন অবস্থার শিকার তারা।
নাছিরপুর গ্রামের চিংড়ি চাষি আব্দুল মজিদ গাজী জানান, ‘আমি ১৫ দিন আগে থেকে চিংড়ি ধরা শুরু করেছি। এ বছর চিংড়ির মূল্যটা ভাল আছে, কিন্তু ভাইরাসে ক্ষতি করছে, ঘেরে নামলেই মরা চিংড়ি পাচ্ছি। আমার মনে হয় বাগদা চিংড়িতে পোনার জন্মলগ্ন থেকেই ট্যাংকি থেকে ভাইরাস আসছে।’
আরেক ঘের ব্যবসায়ী অমিত হালদার জানান, ‘চিংড়িতে ভাইরাসের কারণে বছরের প্রথমেই আমরা একেবারেই ধরাশয়ী। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে চিংড়ি চাষ করেছি, কিভাবে সেটা পরিশোধ করবো তা ভেবে পারছি না।’
পাইকগাছার সাপোয়ান অ্যাকোয়া কালচার লিমিটেড’র ব্যবস্থাপক অমর কুমার দাস বলেন, তার ৮০ বিঘা জমির ২০টি পুকুরের মাছ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় চার কোটি টাকা। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা নতুন পোনায় আবারও চাষ শুরু করছেন। এছাড়া আর কোন উপায় নেই বলেও জানান তিনি। এছাড়া শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ-হরিনগরের ছাত্তার মোড়লসহ অনেকেরই আধানিবিড় পদ্ধতির চিংড়ি চাষে ভাইরাস আক্রমণ করেছে।
আধা নিবিড় পদ্ধতির সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত প্রবায়োটিক এবং মিনারেলস সময়মত না পাওয়ায় এ ধরণের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আধা নিবিড় চিংড়ি চাষ পদ্ধতির সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি কোন ধরনের প্রণোদনা ছাড়া চাষিরা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এ শিল্পকে রক্ষা করা না গেলে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ব্যাহত হবে। তাই এ শিল্প রক্ষা করতে সরকার প্রধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেন সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার চিংড়ি চাষিরা।
পাইকগাছা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে অধিক তাপমাত্রা ও ঘেরে পোনা ছাড়ার সময় নার্সিং পয়েন্টে না রাখার কারণে চিংড়িতে ভাইরাস লেগেছে। ভাইরাস মুক্ত পোনা কিনা ঘেরে দেওয়ার আগে চাষিদেরকে নিশ্চিত হতে হবে।’
মৎস্য কর্মকর্তাদের মতে, দূর্বল নার্সারী, তাপমাত্রা ওঠানামা, ত্রুটিপূর্ণ ঘের ব্যবস্থাপনা এবং চাষাবাদে ভাইরাসমুক্ত পোনা ব্যবহার না করা ও চাষের ক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ না করাটা চিংড়িতে ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগ বালইয়ের কারণ বলে মনে করছেন। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের অন্যতম খাত হচ্ছে হিমায়িত চিংড়ি, যা রফতানি করে সরকার প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে।

 

http://www.dailysangram.com/post/280392-