১৯ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৯

হাওরে মাছের মড়ক

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে শতাধিক হাওরের আধাপাকা ধান। এবার পচা ধানের বিষাক্ত গ্যাসে মরে ভেসে উঠছে হাওরের মাছ। ধান আর মাছের পচা গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওরের বাতাস। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন হাওরপাড়ের মানুষরা। এছাড়া ধানের পর মাছ মরে যাওয়ায় জীবিকা অর্জনের শেষ সম্বলটুকু হারাতে বসলো কৃষকরা।

এদিকে স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার থেকে জানান, মরা-পচা মাছ আর ধান পচা দুর্গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে হাকালুকির বাতাস। গেল ক’দিন থেকে হাকালুকি হাওরে দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের মাছ মরে পানিতে ভেসে উঠছে। টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার পর এখন মড়ক লেগেছে মাছে। হওরের বিল এলাকায় হেক্টরের পর হেক্টর পানিতে তলিয়ে যাওয়া বোরো ধান পচে পানি দূষিত হওয়ায় মরছে মাছ ও অনান্য জলজ প্রাণী। এমনটিই ধারণা স্থানীয় লোকজন ও মৎস্য বিভাগের। পচা ধান আর মরা পচা মাছের দুর্গন্ধে হাওর পাড়ের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। ধানের পর মাছ। হঠাৎ একের পর এক দুর্যোগে দিশেহারা হাওর পাড়ের কৃষি ও মৎস্যজীবী লোকজন। তাদের চোখের সামনেই বছরজুড়ে জীবিকা নির্বাহের উপকরণগুলো অকাল বন্যায় গিলে খাচ্ছে। বেঁচে থাকার এই দু’উপকরণ হারিয়ে এখন তারা নির্বাক। স্থানীয়রা জানালেন এ ক’দিন থেকে পানির নিচে থাকা ধান পচার কারণে হাওরের পানির রং পরিবর্তন হয়েছে। হাওরের সফেদ পানি রং পরিবর্তন হয়ে এখন কালছে হয়েছে। আর ঘনত্ব বেড়ে ভারি হয়েছে পানি। এতে ব্যাপক হারে মরছে মাছ। মরছে জলজ প্রাণীও। ধান আর মাছ পচা দুর্গন্ধ পুরো হাওরজুড়ে। এমন পরিস্থিতিতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাওর তীরের বাসিন্দারা। বিশুদ্ধ খাবার পানি ও প্রয়োজনীয় পানির দেখা দিয়েছে সংকট। হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়ার ভূকশিমইল ইউনিয়নের বড়ধল, কাড়েরা ও ছকাপন এলাকার লাল মিয়া, আছর উল্লাহ, ইসুব আলী, রজব আলী, আমীর আলী, ফুরকান মিয়া, সুরমান মিয়া, অবিন মালাকারসহ অনেকেই জানান- গেল ৩-৪ দিন থেকে হাওরের দুর্গন্ধযুক্ত বাতাসে বমি আসে। মাছ আর ধান পচা দুর্গন্ধে হাওরপাড়ে বসবাস করাই এখন কষ্টকর। একই অবস্থা জানালেন একই উপজেলার ভাটেরা, বরমচাল ও ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের হাওরপাড়ের বাসিন্দারা। দুর্গন্ধে দুর্ভোগে পড়েছেন জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার হাওর তীরের লোকজন। সরেজমিন হাকালুকি হাওরের নাগুয়া ও চকিয়া বিলসহ নৌকাযোগে আশপাশের কয়েকটি বিলে গেলে মরা মাছ পচে ভেসে উঠার দৃশ্য দেখা যায়। ভেসে উঠা মরা মাছের মধ্যে ছিল পুঁটি, টেংরা, ভেদা, গুতুম, কাশখয়রা, বাইলা, কাখলা, বাইম, মলা, চাপিলা লাটি, শইল, বোয়াল, চান্দা, পাবদা, রুই, কাতলাসহ নানা জাতের দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা মরে ভেসে উঠছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর কুলাউড়ায় হাওরের ১২টি বিলে গড়ে ৯৫০ টন, বড়লেখায় ১৩৪টি বিলে ৩ হাজার ২৭০ টন এবং জুড়ীতে ৩৮টি বিলে প্রায় ১ হাজার ৭০০ টন মাছ উৎপাদিত হয়। এ বছর হঠাৎ এমন মড়কে মাছের উৎপাদন নিয়ে বিল ইজারাদার ও স্থানীয় মৎস্যজীবীরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তবে মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন পানির এই সমস্যা কাটিয়ে উঠলে প্রতি বছরের মতো এবারো বরাদ্দকৃত মাছের পোনা অবমুক্ত করা হলে এই ক্ষতি পুষিয়ে যাবে বলে তারা আশা করছেন। হাওর তীরের ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, হাকালুকি হাওর কেবল এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর নয়, দেশের সর্ববৃহৎ মিঠা পানির মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। এখানে ২-৪ বছরের ব্যবধানে পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যা হয়। কিন্তু এবারের মত চৈত্র মাসে কখনও বন্যা হয়নি। এই অকাল বন্যায় ধানের পচনে মাছেও মড়ক লেগেছে। ফলে মিঠা পানির এই মৎস্য প্রজন্ন কেন্দ্রটিতে মৎস্য প্রজনন হুমকির মুখে পড়বে। সংকট সৃষ্টি হবে মাছের। এমনিতে নেই ধান আর সেই সঙ্গে যদি মাছও না থাকে তাহলে হাওর তীরের মানুষের জীবন জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। দক্ষিণ হাকালুকি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির লোকজন জানান, চৈত্র মাসের অকাল বন্যায় হেক্টরের পর হেক্টর জমির বোরো ধানের পাশাপাশি হাকালুকি হাওরের ছোটবড় ২৩৭টি বিলের অধিকাংশই তলিয়ে যায়। জলমহালগুলো ছেড়ে পোনা মাছ নির্দিষ্ট সময়ের আগে পুরো হাওরেই ছড়িয়ে পড়ে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান রোদে পচন ধরে। এতে পানি দূষিত হয়ে ব্যাপকহারে মাছে মড়ক লেগেছে। হাওরের চকিয়া বিলে ৩ বছরের জন্য ইজারা নেয়ায় ইজারাদার সেখানে ১৫ লাখ টাকার পোনা মাছ অবমুক্ত করেন। কিন্তু মাছের মড়কে তারা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হবেন বলে জানান। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আ.ক.ম শফিক উজ-জামান মুঠোফোনে মানবজমিনকে জানান, পানির নিচে থাকা পচা বোরো ধানের কারণে পানি দূষিত হলে গত শনিবার থেকে মাছের মড়ক দেখা দেয়। খবর পেয়ে আমরা হাওরের বিলগুলো পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই। সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিন উপজেলা কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখার হাওর এলাকায় পানি দূষণমুক্ত করার জন্য ৩ লাখ টাকার চুন বরাদ্দ দেয়া হয়। এখন সেগুলো ছিটানোর পাশাপাশি ভেসে থাকা পচা মাছগুলো পানি থেকে সরানোর কাজ চলছে। ৩ দিনের জন্য হাওরে মাছ ধরা বন্ধ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানীয় মৎজীবীদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে ২-১ দিনের মধ্যে দূষণমুক্ত হয়ে পানির গুণগত মান ঠিক থাকবে। সে লক্ষেই আমাদের দ্রুত কাজ চলছে। তবে এখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানান, হাকালুকি হাওরে পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান পচার ফলে কালচে আর ভারি হয়েছে পানি। এতে ব্যাপকহারে মরে ভেসে উঠছে মাছ। ধান আর মাছ পচা গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস। এমন পরিস্থিতিতে হাওর তীরের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
হাকালুকি হাওর তীরের ভাটেরা ইউনিয়নের কবির আহমদ, নোমান আহমদসহ বেড়কুড়ি ও দক্ষিণভাগ এলাকার মানুষ জানান, হাওর থেকে যখন বাতাস আসে তখন দুর্গন্ধে যেন নাড়িভুঁড়ি ছিড়ে বমি আসে। মাছ আর ধান পচে একাকার। দুর্গন্ধে এলাকায় বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সরজমিন হাকালুকি হাওরের চকিয়া বিলে গেলে দক্ষিণ হাকালুকি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির লোকজন জানান, চৈত্র মাসের অকাল বন্যায় ২৫ সহস্রাধিক হেক্টর জমির বোরো ধানের পাশাপাশি হাকালুকি হাওরের ছোট-বড় ২৩৭টি বিলও তলিয়ে যায়। তলিয়ে যাওয়া ধান রোদে পচন ধরে। এতে পানি দূষিত হয়ে ব্যাপকহারে মাছ মরে ভেসে উটছে। হাওরের চকিয়া বিলে ৩ বছরের জন্য ইজারা নেয়ায় ইজারাদার সেখানে ১৫ লাখ টাকার পোনা মাছ অবমুক্ত করেন। সমিতির পক্ষ থেকে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করা হয়। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ সরজমিন গতকাল হাকালুকি হাওরের চকিয়া বিল পরিদর্শন করেন।
সরজমিন পরিদর্শনকালে হাকালুকি হাওরে প্রচুর মরা মাছ ভেসে থাকতে দেখা যায়। ভেসে উঠা মরা মাছের মধ্যে ছিল পুটি, টেংরা, ভেদা, বাইলা, বোয়াল মাছ, বোয়াল মাছের পোনা, চান্দা, পাবদা এবং রুই জাতীয় মাছের ছোট পোনা মরে ভেসে উঠছে। তলিয়ে যাওয়া ধান ও পচা মাছের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে হাওর জুড়ে।
জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে হাওরে ধান পচে বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে মরে যাচ্ছে মাছ। মঙ্গলবার মৎস্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ উপজেলার সর্ববৃহৎ নলুয়া, মইয়ার, পিংলার হাওর ও নলজুর নদী পরির্দশন করে ওষুধ প্রয়োগ করেছেন বিভিন্ন হাওরে।
হাওর পরিদর্শন শেষে সিলেট বিভাগের মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোশারেফ হোসেন স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জানিয়েছেন, গত ৩ দিনে জগন্নাথপুরের বিভিন্ন হাওরে এমোনিয়া গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে ৫.২৫ মে. টন মাছ মারা গেছে। তিনি জানান, মঙ্গলবারও হাওরে মাছ মরে ভাসতে দেখা গেছে। হাওরের কাঁচা ধান পচে পানি বেশি ঘন হওয়ায় মাছ অক্সিজেন পাচ্ছে না। এখন বৃষ্টি হলে হাওরের মাছরক্ষায় খুবই ভালো হতো। আমরা মাছ সংরক্ষণে প্রচুর পরিমাণে চুন ও ওষুধ প্রয়োগ করেছি।
জগন্নাথপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়াহিদুল আবরার জানান, পানিতে ধান পচে এমোনিয়া গ্যাস সৃষ্টি হওয়ায় মাছগুলো মরে ভেসে উঠেছে। এসব মাছ আহার করলে ক্ষতি হতে পারে এমন আশঙ্কায় আমরা সচেতনতামূলক মাইকিং করেছি।
মোহনগঞ্জ (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি: নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওরের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর গত দু’দিন ধরে হাওরের পানিতে মরে ভেসে উঠছে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী। ফলে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা বোরো ফসল হারিয়ে হাওরে জাল দিয়ে মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহের শেষ অবলম্বনটুকু হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। গতকাল সকালে ময়মনসিংহ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মো. খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি মৎস্য গবেষক দল উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওর পরিদর্শন করেছেন।
এ সময় নেত্রকোনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আশরাফ উদ্দিন আহম্মেদ ও মোহনগঞ্জ উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহাসহ মৎস্য বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
হাওরাঞ্চলের কৃষকরা জানান, অকাল বন্যায় উপজেলার ডিঙ্গাপোতাসহ বিভিন্ন হাওরের কাঁচা ও আধাপাকা বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার পর হাওর পাড়ের অনেক কৃষকই আসন্ন বর্ষা মৌসুমে হাওরে জাল দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু গত দু’দিন ধরে ডিঙ্গাপোতা হাওরসহ উপজেলার সব ক’টি হাওরের পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রোববার দুপুর থেকে ব্যাপক হারে হাওরের বিভিন্ন এলাকার পানিতে নানা প্রজাতির ছোট-বড় মাছসহ জলজপ্রাণি মরে পানিতে ভেসে উঠতে শুরু করে।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=62083&cat=3/