রাজধানীর করাইল বস্তিতে বাঁশের খুঁটি দিয়ে বিদ্যুতের লাইন টানানো হয়েছে (বাঁয়ে) ব্যবহার হচ্ছে জিয়াই পাইপে গ্যাস। ছবি : কালের কণ্ঠ
১৯ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৪

বাঁশের খুঁটিতে বিদ্যুৎ জিআই পাইপে গ্যাস

সাধারণত বাড়ির ভেতরে পানির লাইন টানা হয় জিআই পাইপ দিয়ে। অথচ কুড়িল বস্তিতে গ্যাস সরবরাহে ব্যবহার করা হচ্ছে এই পাইপ। শুধু তাই নয়, বাগানে পানি ছিটানোর হোস পাইপও এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে। কারিগরি জ্ঞান ছাড়াই এসব লাইন টানা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। আর এই ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের গ্যাসে প্রতিদিন রান্নার কাজ সারছে লাখ লাখ বস্তিবাসী। এমন ভয়ংকর চিত্র দেখা গেল কড়াইল বস্তি ঘুরে। শুধু তাই নয়, বিশাল এই বস্তিতে ৬৪ হাজার পরিবারকে বিদ্যুতের লাইনও দেওয়া হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণভাবে। বাঁশের খুঁটিতে নিম্নমানের তারে দেওয়া হয়েছে সংযোগ। অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইনের কারণে সেখানে যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বিষয়গুলো প্রকাশ্য হলেও সরকারের কোনো হেলদোল নেই বলে অভিযোগ বস্তিবাসীর।
জানা গেছে, কড়াইল বস্তির এই সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষও। অবৈধ লাইন কাটতে গেলেই প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে।
পুরো গ্যাসই অবৈধ : সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কড়াইল বস্তির প্রায় সব বাড়িতেই গ্যাস সংযোগ আছে। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গুলশান-বনানী এলাকা দিয়ে যাওয়া গ্যাসলাইনে চোরাই ফুটো করে সেখান থেকে জিআই পাইপের মাধ্যমে লাইন টেনেছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। তিতাস গ্যাসের এক প্রকৌশলী কালের কণ্ঠকে জানান, পানি সরবরাহে সাধারণত জিআই পাইপ ব্যবহার করা হয়। বাসার ভেতরে অল্প চাপের গ্যাস ব্যবহারের জন্যও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ পাইপ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে মূল লাইন থেকে গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতা জিআই পাইপের নেই। যেকোনো সময় প্রচণ্ড চাপে এ পাইপ বিস্ফোরিত হয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আরেক কর্মকর্তা জানান, তাঁদের জানামতে বস্তিতে সিন্ডিকেট সদস্যরা হোস পাইপ দিয়েও গ্যাসের লাইন টেনেছেন। এই পাইপ দিয়ে সাধারণত বাগানে পানি ছিটানো হয়। গ্যাস সরবরাহে ওই পাইপ ব্যবহার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তিতাস কর্তৃপক্ষ কড়াইল বস্তির অবৈধ লাইন কয়েকবার কেটেছে। এরপর তারা আবার লাইন টেনেছে। লাইন কাটতে গেলেই হামলার শিকার হতে হয়। হাজার হাজার বস্তিবাসী লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেডের ইমার্জেন্সি গ্যাস কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের ডিজিএম প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন তো গ্যাসলাইন দেওয়াই বন্ধ। কড়াইল বস্তি অবৈধ। সেখানে লাইন দেওয়ারই কোনো সুযোগ নেই। ’
১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কড়াইল বস্তির সমস্যা অনেক বড়। এ বিষয়ে আমি মেয়র সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। গ্যাসলাইনের পুরোটাই অবৈধ। ফলে এখানে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমরা তিতাস কর্তৃপক্ষকে বলতে চাই, হয় তারা বৈধভাবে গ্যাস দিক, নয়তো বন্ধ করে দিক। ’
তিনি আরো বলেন, ‘বহু বছর ধরে এখানে আছি। আমি দেখেছি, একসময় বস্তিবাসী সারা দিন কাজ শেষে ফেরার সময় লাকড়ি নিয়ে ঢুকত। গ্যাস আসার পর সেই দৃশ্য উধাও। ’ অবৈধভাবে এত গ্যাস কিভাবে বস্তিবাসী পাচ্ছে—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তিতাসের লোকজনই তা ভালো বলতে পারবেন। ’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাকে যখন এসব বিষয়ে বস্তিবাসী প্রশ্ন করে তখন চুপ করে থাকি। কোন পক্ষে কথা বলব?’
বাঁশের খুঁটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ : সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মাকড়সার জালের মতো বিদ্যুতের তারে ছেয়ে আছে বস্তিটি। প্রায় প্রতিটি বাড়ির ওপর দিয়ে লাইন গেছে। তার টানা হয়েছে বাঁশের খুঁটি বসিয়ে। ফলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত বস্তিবাসীও। ঝুঁকি থাকলেও অন্ধকার তাড়াতে তারা এই বিপজ্জনক বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে।
বস্তির বাসিন্দা ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘বহুদিন ধরে চেষ্টা করছি বস্তিতে সরকারিভাবে বৈধ খুঁটি বসিয়ে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ খুব জরুরি। সে জন্যই ঝুঁকি নিয়েও বাঁশ দিয়ে লাইন টানা হয়েছে। ’ তবে তিনি জানিয়েছেন, ২৫টি বড় মিটার আনা হয়েছে। সেই মিটার থেকে বিভিন্ন ঘরে সাব-লাইন টানা হয়েছে বাঁশের খুঁটি বসিয়ে। বস্তির ৬৪ হাজার পরিবার গড়ে একটি বাল্ব ও একটি ফ্যান ব্যবহার করছে।
এ বিষয়ে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শহিদ সারওয়ার বলেন, ‘বস্তি এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ কঠিন একটি বিষয়। কড়াইলের জন্য কিছু মিটার দেওয়া হয়েছে। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/04/19/488328