ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে প্রমত্তা পদ্মা এখন সরু খাল। দু’চোখ যে দিকে যায় শুধু ধু ধু বালুচর :নাসিম সিকদার
১৮ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৪১

ভারত তিন মাসে ৫৬,৭৩৭ কিউসেক পানি কম দিয়েছে

বাংলাদেশের প্রতিবাদ আমলে নেয়া হচ্ছে না

 

প্রতিদিন প্রতি কিস্তিতেই গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। বারবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাগাদা দেয়া হলেও গঙ্গাচুক্তি অনুযায়ী পানি নিশ্চিত করছে না ভারত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমনিতেই গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে বাঁধ দিয়ে ব্যারাজ নির্মাণের কারণে নদীতে পানিপ্রবাহ কমে গেছে, তার ওপরে চুক্তি অনুযায়ী পানি না পেলে বাংলাদেশের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হবে। তাদের মতে, গঙ্গাচুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ যতটুকু পানি প্রাপ্য তা নিশ্চিত করা ভারতের কর্তব্য। তা না হলে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের গঙ্গা অববাহিকা এলাকায় পানির অভাবে কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের ১০ তারিখ পর্যন্ত ফারাক্কা পয়েন্টে ৫৬ হাজার ৭৩৭ কিউসেক পনি কম পেয়েছে বাংলাদেশ। গঙ্গার পানি ভাগাভাগির এই মওসুমে বাংলাদেশ প্রায় প্রতিটি কিস্তিতে গড়ে দশ হাজার কিউসেক পানি কম পেয়েছে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পাদিত পানিচুক্তির ইন্ডিকেটিভ শিডিউল অনুযায়ী দেশটি (ভারত) এই পরিমাণ পানি কম দিয়েছে বাংলাদেশকে।
গঙ্গাচুক্তি অনুযায়ী এই সময়ে পাওয়ার কথা ছিল চার লাখ ৩৮ হাজার ৩১৯ কিউসেক পানি। চুক্তির ইন্ডিকেটিভ শিডিউল অনুযায়ী এ পরিমাণ পানিই নিশ্চিত করার কথা ভারতকে। কিন্তু দেশটি ফারাক্কা পয়েন্টে চুক্তির সংলগ্নি-১-এর বণ্টন ফর্মুলা অনুয়ায়ী বাংলাদেশকে দিয়েছে তিন লাখ ৮১ হাজার ৫৮২ কিউসেক পানি, অর্থাৎ ৫৬ হাজার ৭৩৭ কিউসেক পানি কম। অর্থাৎ প্রায় পুরো তিন মাসে বাংলাদেশ ফারাক্কা পয়েন্টে পানি কম পেয়েছে এবং এটা চলছেই।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফারাক্কা পয়েন্টে পুরো জানুয়ারিতেও পানি কম পেয়েছে বাংলাদেশ। জানুয়ারির পুরো মাসে তিন কিস্তিতে ২৮ হাজার ২৮৭ কিউসেক পানি কম পেয়েছে বাংলাদেশ।
অপর দিকে ফেব্রুয়ারিতে পাওয়ার কথা ছিল এক লাখ ২৮ হাজার ২৮৮ কিউসেক পানি, পেয়েছে এক লাখ আট হাজার ৯১০ কিউসেক। এ ক্ষেত্রে কম পেয়েছে ১৯ হাজা ৩৭৮ কিউসেক পানি। অপর দিকে মার্চে পাওয়ার কথা ছিল ৯৯ হাজার ৬৮৮ কিউসেক পানি, কিন্তু পেয়েছে ৯০ হাজার ৬১৬ কিউসেক পানি। কম পেয়েছে ৯ হাজার ৭২ কিউসেক পানি।
এ দিকে মন্ত্রণালয় সূত্রে আরো জানা গেছে, বাংলাদেশ পানিচুক্তির ইন্ডিকেটিভ সিডিউল অনুযায়ী পানি নিশ্চিত করতে ভারতকে তাগাদা দিয়েছে এ বছরের জানুয়ারিতেই, তবে এর কোনো সাড়া মেলেনি। জলবায়ু পরিবর্তনসহ গঙ্গার উজানে পানি নেই বলে বাংলাদেশকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে ভারত। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী পানি বণ্টন কার্যক্রম শুরু হয়েছে জানয়ারির ১ তারিখ থেকে, ৩১ মে পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর এই গঙ্গাচুক্তি সম্পাদন হয়। দেখা গেছে, ভারত বাংলাদেশ চুক্তি সংলগ্নি-১-এর বণ্টন ফর্মুলা অনুযায়ী পানি নিশ্চিত করলেও ইন্ডিকেটিভ শিডিউল অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। পানি বণ্টনের বেশির ভাগ সময়েই ভারত ইন্ডিকেটিভ শিডিউল অনুযায়ী পানি নিশ্চিত করেনি।
চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ মাত্র ১ বছর পানি পেয়েছে : ভারতের এ ধরনের অজুহাতের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালের গঙ্গাচুক্তি অনুযায়ী পানি ভাগাভাগি শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশকে দেশটি প্রতিটি কিস্তিতে কম দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে গঙ্গাচুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত দু-এক বছর বাংলাদেশ গঙ্গাচুক্তির হিস্যা মতো পানি পেয়েছে। ১৯৯৮ সালে সব কিস্তিতে ইন্ডিকেটিভ শিডিওলের চেয়ে বাংলাদেশ পানি বেশি পেয়েছিল। এর পরে একটি বছর পনি বেশি পেয়েছিল। কারণ সে সময়ে ফারাক্কা ব্যারাজের বেশ কয়েকটি গেট নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবে চুক্তির পর মাত্র একটি বছর সব কিস্তিতে ভারত ইন্ডিকেটিভ শিডিওল অনুযায়ী পানি দিয়েছে।
যে কারণে বাংলাদেশ পানি কম পাচ্ছে : ভারত গঙ্গার উজানে ফারাক্কা ব্যারাজ ছাড়াও আরো অনেক ড্যাম-ব্যারাজ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফারাক্কা পয়েন্টে আসার আগে আগে তারা পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। জানা গেছে, ভারত গঙ্গার উজানে নির্মিত বিশালাকায় তেহারি ড্যামে বিপুল পানি আটকিয়ে নিজ এলাকায় সেচকার্যক্রমের কারণে ভাটিতে ফারাক্কা পয়েন্টে প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ভারত দশ বছর আগে অর্থাৎ গঙ্গাচুক্তির অল্প দিন পরেই উত্তর প্রদেশের তেহারি-গাড়ওয়াল জেলায় এই ড্যাম নির্মাণ শেষ করে। এ ড্যাম নির্মাণের পর থেকে গঙ্গায় ফারাক্কা পয়েন্টে পানি কমে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ড্যাম নির্মাণের পরে এর দ্বারা সেচসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের পর থেকে ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ ভয়াবহভাবে কমে গেছে, এখনো যাচ্ছে। এটি গঙ্গার উজানে ছাড়াও পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ ড্যাম, যার বিস্তৃতি ৪৫ কিলোমিটার জুড়ে। এ বাঁধটি হচ্ছে গঙ্গার ওপর ভারতের সর্বশেষ বড় প্রকল্প। এ ছাড়া এর আগে ভারত গঙ্গা নদীর উজানের বিভিন্ন পয়েন্টে শত শত ড্যাম-ব্যারাজ নির্মাণ করেছে। এভাবে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করে দেশটি এই নদীর পানি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। ড্যাম, ব্যারাজ ছাড়া গঙ্গার উজানের বিভিন্ন পয়েন্টে সরাাসরি পাইপ দিয়েও গঙ্গার পানি উজান থেকে টেনে নিচ্ছে। জানা গেছে, গঙ্গার উজানে এমন অবকাঠামো বর্তমানে ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে। আর এ কারণে শুষ্ক মওসুম শুরু না হতেই ফারাক্কায় চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাশিত পানি আসছে না।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/212971