১৮ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৩০

বন্ডের অপব্যবহার করে বিপুল অর্থপাচার

বন্ড সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে তা দেদার খোলাবাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শূন্য শুল্ক সুবিধায় আনা কাগজজাতীয় পণ্যই খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে বেশি। এভাবে শুল্ক ফাঁকির পাশাপাশি ভুয়া কাগজপত্রে পাচার করা হচ্ছে বিপুল অর্থ। অথচ এসব পণ্য দেশেই উত্পাদন হচ্ছে। আর কর ফাঁকি ও অর্থপাচার চক্রের দৌরাত্ম্যে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় কাগজকলগুলো।

শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পে পণ্য উত্পাদনে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দিয়েছে সরকার। অথচ এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সরকারি এই সুবিধার অপব্যবহার করে চলেছে। তারা বন্ডের আওতায় কাঁচামাল আমদানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অর্থ পাচার করছে। আর বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে দেশ থেকে অর্থপাচারে কাগজজাতীয় পণ্য ও প্লাস্টিক দানা আমদানির ক্ষেত্রটিকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার শুল্কমুক্ত সুবিধার এসব পণ্য দেশের খোলাবাজারে বিক্রি করেও হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল অর্থ। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে।
বন্ড সুবিধার আওতায় এলসি খুলে আমদানি করা কাগজপণ্যের মধ্যে আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, কার্বনলেস পেপার ও হার্ড টিস্যু অন্যতম। তৈরি পোশাক ও এর সহযোগী শিল্প খাতের ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য সবচেয়ে বেশি আমদানি করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীরা কাগজপত্র জাল করে বা ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে এসব আমদানি করছেন। অনেক সময় এসব অসাধু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী অর্থপাচারে সহযোগিতা করছেন।
এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তৈরি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে—বন্ড সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত থাকে যে আমদানি করা কাঁচামালের পুরোটাই পণ্য উত্পাদনে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাঁচামাল হিসেবে বিনা শুল্কে আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করছেন। আর এমন অপকর্ম সবচেয়ে বেশি ঘটছে আমদানি করা কাগজজাতীয় পণ্য ও প্লাস্টিক দানার ক্ষেত্রে।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত ফিউচার এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রির বার্ষিক উত্পাদনক্ষমতা তিন হাজার ৪৬৩ টন। অথচ প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ হাজার ৭৬০ টন ডুপ্লেক্স বোর্ড ও আর্ট কার্ড আমদানির জন্য ব্যাংকে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলে। উদ্দেশ্য ছিল, বন্ড সুবিধার আওতায় শূন্য শুল্কে অতিরিক্ত দুই হাজার ২৯৭ টন কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করা। শুল্ক গোয়েন্দারা এই কারসাজির পক্ষে প্রমাণও পেয়েছেন।
গোয়েন্দারা কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখতে পান, প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের ২৪ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ৪২৭ টন আর্ট কার্ড ও ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানি করে বন্ড রেজিস্টারে এন্ট্রি না করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বন্ড রেজিস্টারে উল্লিখিত আর্ট কার্ড ও ডুপ্লেক্স বোর্ডের মজুদের সঙ্গে সরেজমিনে প্রাপ্ত মজুদের ঘাটতি ৫৯৭ টন। আর এই ঘাটতি থাকা পুরো পণ্যই প্রতিষ্ঠানটি খোলাবাজারে বিক্রি করেছে বলে নিশ্চিত হন তাঁরা। আর এভাবে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় তিন কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির কারখানা ও বন্ডেড ওয়্যারহাউসে অভিযান চালিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দেখতে পান, বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে একাধিক চালানে বিদেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অর্থ পাঠানো হলেও হিসাবের চেয়ে কম পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের দায়ে আশুলিয়ায় মেসার্স এফএল প্যাকেজিংয়ের বিরুদ্ধে তিন কোটি ৬৬ লাখ টাকার শুল্ক ফাঁকির মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। আটক করা হয়েছে এক হাজার ৮২ টন পণ্য, যার মূল্য সাড়ে ১০ কোটি টাকার বেশি। আটক পণ্যের মধ্যে রয়েছে আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পিপি, বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ। বন্ড সুবিধায় আনা এসব পণ্য বোঝাই কাভার্ড ভ্যানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কারখানায় না এনে খোলাবাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে রাজধানীর বকশিবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, ‘অধিদপ্তর থেকে গত দুই বছরে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্যে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। পণ্য এনে খোলা বাজারে বিক্রি করে সরকারের বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। আর তাতে করে সৎ ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়েছে। ’
দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বন্ডেড ওয়্যার হাউসের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার। শুধু ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের আওতায়ই ছয় হাজার ২৭০টি বন্ডেড ওয়্যার হাউস রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চার হাজার ২৭২টি গার্মেন্টস বন্ড। এসব বন্ডেড ওয়্যার হাউসের কারখানায় পণ্য উত্পাদনে কাঁচামাল হিসেবে কাগজ-জাতীয় পণ্যের ব্যবহার হয়ে থাকে।
ড. মইনুল খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বন্ড সুবিধার সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার হচ্ছে কাগজ-জাতীয় পণ্য ও প্লাস্টিক দানা আমদানি এবং ব্যবহারে। এ ক্ষেত্রে নজরদারি আরো বাড়ানো হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের প্রায় ৮৫টি কাগজ কারখানায় আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, কার্বনলেস পেপার, হার্ড টিস্যুসহ কাগজ জাতীয় বিভিন্ন পণ্য উত্পাদন হচ্ছে। দেশীয় এই উত্পাদন স্থানীয় শিল্পের কাঁচামালের চাহিদা পূরণে পুরোপুরি সক্ষম। তার পরও শুল্কমুক্ত সুবিধায় চীন, ভারত, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কাগজ জাতীয় এসব পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। তার ওপর বিনাশুল্কে আমদানি করা এসব পণ্য আইন ভেঙে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় সব নিয়ম মেনে রাজস্ব দিয়ে পণ্য উত্পাদন করে বাজারজাত করতে গিয়ে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে দেশি কাগজ কলগুলো। কারণ বিনাশুল্কে আমদানি করা পণ্য দেশে উত্পাদিত পণ্যের চেয়ে গড়ে টনপ্রতি ২০ হাজার টাকা কমে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সচিব নওশেরুল আলম এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানীকৃত শুল্কমুক্ত সুবিধার পণ্য বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেওয়ায় দেশের কাগজ কলগুলো প্রতিনিয়ত লোকসানে পড়ছে। অথচ এসব পণ্য দেশি কাগজ কলেও উত্পাদিত হচ্ছে। ’ এই অপতত্পরতা বন্ধে কঠোর নজরদারির দাবি জানান তিনি।
এনবিআরের তদন্তে দেখা যায়, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর ৮০ শতাংশই পাচার হচ্ছে আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে। আর এই অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে কাগজ জাতীয় পণ্য আমদানিতে। এ ছাড়া সরকার বছরে ৫৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে অসাধু ব্যক্তিরা অতীতে পার পেলেও এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। সৎ ব্যবসায়ীদের ব্যবসা গতিশীল করতে এনবিআর বন্ড সুবিধার অপব্যবহার বন্ধে সর্বোচ্চ তত্পর রয়েছে। এনবিআরের কঠোর নজরদারির কারণে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার কমে আসছে। আর এই অসাধুতায় জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে এনবিআর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/04/18/487919