১৮ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৫৯

ঠেকানো যাচ্ছে না সর্বনাশা ইয়াবা

এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১৫ বছর পরে দেশে একজন সুস্থ তরুণও পাওয়া যাবে না || আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গ্রুপ ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাও জড়িত ||

গত রবিবার চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগর থেকে শত কোটি টাকার ২০ লাখ পিস ইয়াবাসহ শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী মোজাহের সিন্ডিকেটের প্রধান মোজাহেরসহ ৯ জনকে আটক করে র্যাপিড আ্য্যকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। জানা গেছে, মোজাহের ছিল সামান্য আলু-পিঁয়াজের ব্যবসায়ী। ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে সে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছে।

নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় বিলাসবহুল বহুতল ভবনসহ প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক সে। তার ছেলেমেয়েরা সকলেই সুপ্রতিষ্ঠিত। নিজের ছেলেমেয়েরা ভালো অবস্থানে থাকলেও পরের সন্তানকে ধ্বংস করার জন্য সে ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। একইভাবে সাম্প্রতিককালে টেকনাফ, উখিয়াসহ পুরো কক্সবাজার শহরে এমন অসংখ্য নতুন নতুন অট্টালিকা হয়েছে যা নির্মিত হয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ী নব্য ধনীদের টাকায়।

কোনভাবেই ইয়াবার সরবারাহ ঠেকানো যাচ্ছে না। দেশে ইয়াবা পাচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গ্রুপ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১৫ বছর পরে দেশে একজন সুস্থ তরুণও পাওয়া যাবে না বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন।

টেকনাফ এখন ‘ইয়াবা জোন’। ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, স্থানীয় প্রশাসন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা। সমপ্রতি এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ইয়াবায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ইয়াবায় আসক্ত। টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবার চালান ঠেকাতে কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও ইয়াবার চালান আসছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে রয়েছে ইয়াবা কারখানা। মিয়ানমার থেকে ২৫ টাকায় ইয়াবা কিনে ঢাকায় এনে ৫০০ টাকা পিস বিক্রি করা হয় বলে আটককৃতরা জানিয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) তৌফিক উদ্দীন আহমেদ বলেন, ইয়াবার বিষয়ে মায়ানমারের সঙ্গে আমরা দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক করেছি। তবে তারা এ বিষয়ে আমাদের কোন ধরনের সহযোগিতা করছে না। তবুও আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। ইয়াবা নিয়ন্ত্রণে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সকল প্রার্থনালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইয়াবার ভয়াবহতার বিষয়ে সচেতন করতে হবে।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে ২ কোটি পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। ইয়াবার সরবরাহ ঠেকাতে এটার চাহিদা কমানোর বিকল্প নেই। ইয়াবা ঠেকাতে বিজিবিও তত্পর রয়েছে। তারাও কোন অবস্থায় ছাড় দিচ্ছে না।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে দীর্ঘদিন কাজ করছেন এমন একজন কর্মকর্তা জানান, ইয়াবার সর্বনাশ না ঠেকাতে পারলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে দেশে একজন সুস্থ তরুণও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মায়ানমার আমাদের দেশকে ধ্বংস করার জন্য, মেধাশূণ্য করার জন্য ইয়াবা সরবরাহ করছে।

পুলিশের ডিআইজি (চট্টগ্রাম রেঞ্জ) এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, ইয়াবা তরুণ সমাজকে ধ্বংস করছে। ইয়াবার সরবরাহ ঠেকানোর বিষয়টি আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। যেকোনভাবে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করা হবে। টেকনাফের ২৫টি এলাকা দিয়ে ইয়াবা আসে। যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আবু মোজাফ্ফর মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আওরঙ্গজেব চৌধুরী বলেন, আমাদের সমুদ্রসীমা আরেকটা বাংলাদেশের সমান। আমরা আমাদের সীমিত জনবল নিয়ে সমুদ্রের নিরাপত্তাসহ মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। গত তিন মাসে ১১ লাখ ইয়াবা ধরা হয়েছে। গতকাল সোমবার ৮০ হাজার পিস ইয়াবাসহ মিয়ানমারের ৬ নাগরিকককে আটক করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্ক অনেক বড়। এদেরকে চিহ্নিত করতে হলে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক জোরালো করতে হবে। তবে আসল কথা হচ্ছে, চাহিদা বন্ধ না হলে সরবরাহ ঠেকানো কঠিন।

পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমরা সবসময় জিরো টলারেন্স। কোন অবস্থাতেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের ছাড় দেয়া হবে না। মিয়ানমার থেকে যে রুটে ইয়াবা আসে সেটা অনেক বড় এলাকা এবং প্রত্যন্ত হওয়ায় একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

চট্টগ্রাম অফিস থেকে শামীম হামিদ জানান, চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবার ব্যবসায় অসাধু পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরা জড়িয়ে পড়েছে। তরুণ প্রজন্মকে ইয়াবার মরণ ছোবল থেকে রক্ষায় যাদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করার কথা, তারাই মিয়ারমার থেকে ইয়াবা আমদানি করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

বিভিন্ন সরকারি সংস্থার তথ্যমতে, কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশের থানা ও ফাঁড়িগুলোতে দায়িত্বরতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশ ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। তাদের সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশের থানা এমনকি ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানা এবং ডিবির কতিপয় পুলিশও এই কাজে জড়িত।

২০১৫ সালের ২১ জুন ফেনীতে নিজের প্রাইভেট কারে ঢাকায় ইয়াবা নিয়ে যাওয়ার সময় ৬ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়ে ডিএমপির বিশেষ শাখার এসআই মো. মাহফুজুর রহমান। ওই ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ইয়াবাসহ পুলিশ ধরা পড়েছে।

ইয়াবা ব্যবসায় সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে কক্সবাজার জেলার ৫ থানার ওসি, এসআই, এএসআইসহ ৭৪ জন পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়েছে। একই জেলায় পুলিশের একজন গানম্যানও ইয়াবাসহ ধরা পড়েছে। একই চিত্র চট্টগ্রাম মহানগরীতেও। সর্বশেষ গত সপ্তাহে নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার একটি বাসা থেকে জেলা পুলিশের দুই সদস্য ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।

উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা রফিক উদ্দিন বাবুল জানান, উখিয়া টেকনাফ সীমান্তের ২৫টি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ইয়াবার চালান। বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কতিপয় লোকজন অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত অবস্থায় ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে পাচারকারীদের ছেড়ে দেওয়ার কারণে ইয়াবা পাচার ও সেবন এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। গতকাল সোমবার রাতে টেকনাফ জাইল্ল্যার দ্বীপ নদী পথে আসা ১৫ কোটি টাকা মূল্যের ৫ লাখ ইয়াবাসহ গত এক মাসে শত কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার ও প্রায় অর্ধশতাধিক পাচারকারীকে আটক করেছে বিজিবি-পুলিশ ও কোষ্টগার্ড।

টেকনাফ (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জসিম উদ্দিন টিপু জানান, টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবা অনুপ্রবেশ কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। ইয়াবা অনুপ্রবেশ বন্ধ না হওয়ায় সীমান্ত এ জনপদের জনসাধারণ প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়ছেন। মানবঘাতি মাদক পাচার ও সেবনে সর্বপেশার মানুষ দিন দিন আশংকাজনক হারে ঝুঁকে পড়েছে। স্থানীয় কতিপয় ছাত্র-শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, ছদ্মবেশী সংবাদকর্মী, এনজিও কর্মী, চালক-হেলপার-মালিক, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যসহ বেকার জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়ছে। এসব পেশার লোকজন বিভিন্ন সময় হাতে নাতে ইয়াবাসহ আটক হয়েছেন। প্রশাসনের কতিপয় অসাধু সদস্যের কারণে এই ইয়াবা পাচার বন্ধ হচ্ছে না।

জানা গেছে, গত ৫ দিনে বিজিবি এবং কোষ্টগার্ডের অভিযানে ২২ লাখ ৮৭ হাজার পিচ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এসময় ইয়াবা পাচারকারী-বিজিবির মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এতে মিয়ানমারের একনারী নিহত ও তিন বিজিবি সদস্যসহ ৭ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া মার্চ মাসে পুলিশ-বিজিবি-কোষ্টগার্ড অভিযান চালিয়ে ১৮ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৪ পিচ ইয়াবা উদ্ধার করে। ওই সময় ১১৫ মাদক পাচারকারীকে হাতে নাতে আটক করেন। প্রশাসনের হাতে প্রতিনিয়ত বড় বড় চালানসহ পাচারকারী আটক হলেও ব্যবসায় জড়িত রাঘববোয়ালরা ঠিকই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।

http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/first-page/2017/04/18/189725.html