তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান গতকাল ইস্তাম্বুলের ইয়াপ সুলতান মসজিদ এলাকা সফরকালে সমর্থকদের শুভেচ্ছা জানান :এএফপি
১৮ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৫৭

তুরস্কের ঐতিহাসিক গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী

পার্লামেন্টারির বদলে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রশাসন চালু হবে

 

পার্লামেন্টারি পদ্ধতির বদলে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রশাসন চালুর জন্য আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কারের প্রশ্নে আয়োজিত গণভোটে জয়ী হয়েছে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের দল ক্ষমতাসীন একেপি। ফলে তুরস্কে নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হবেন প্রেসিডেন্ট। এএফপি, বিবিসি ও রয়টার্স।
৯৯.৪৫ শতাংশ ভোট গণনার পর দেখা যায়, এরদোগানের সংস্কার প্রস্তাবের পে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং ‘না’ ভোট পড়েছে প্রায় ৪৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অবশ্য তুরস্কের প্রধান দু’টি বিরোধী দল বলছে, তারা গণভোটের এ ফলাফল চ্যালেঞ্জ করবে। দেশটির রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) ৬০ শতাংশ ভোট পুনর্গণনার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু গণভোটের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তোলার পর নির্বাচন কর্তৃপরে প্রধান সাদি গুভেন সোমবার এ ফলাফলকে বৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। তেমনি গণভোটে জয়ী হওয়ায় এরদোগানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা।
প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টিসহ (সিএইচপি) অন্য বিরোধীরা গণভোটে স্ট্যাম্পবিহীন ব্যালট ব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। ৬০ শতাংশ ভোট পুনর্গণনারও দাবি জানায় সিএইচপি। এই প্রোপটে সোমবার সাদি গুভেন সাংবাদিকদের বলেন, স্ট্যাম্পবিহীন ব্যালটগুলো হাই ইলেকটোরাল বোর্ড থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছে এবং তা বৈধ। আগের নির্বাচনও একই প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নির্বাহী মতার অধিকারী হয়ে গেলে এরদোগান আরো বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠবেন বলে বিরোধী শিবিরের আশঙ্কা। কিন্তু একেপি এই আশঙ্কা অমূলক বলে নাকচ করে দিয়েছে। তারা বলছেন, আধুনিক তুরস্কের আরো উন্নয়নের জন্য সংবিধানের এই সংস্কার জরুরি।
গণভোটে জয়ের পর এরদোগানের সমর্থকেরা বড় শহরগুলোর রাস্তায় রাস্তায় পতাকা নিয়ে উল্লাস শুরু করেন। অন্য দিকে এরদোগানবিরোধীরা ইস্তাম্বুলে হাঁড়ি-পাতিল পিটিয়ে বিােভ দেখান। রোববার তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয় এবং দেশের বাকি অংশে ভোট শুরু হয় স্থানীয় সময় সকাল ৮টা থেকে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দু-এক জায়গায় গোলযোগ হয়। বিশেষ করে কুর্দি অধ্যুষিত দিয়ারবাকির এলাকায় ভোট কেন্দ্রের কাছ গুলিতে নিহত হন তিনজন। অন্য কোথাও গোলযোগ বা অশান্তি হয়নি বলে বিরোধীরাও স্বীকার করেছেন।
রোববার রাতে গণভোটে জয়ের ঘোষণা দিয়ে ৬৩ বছর বয়সী এরদোগান বলেন, তার এই জয়কে অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে। সেই সাথে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিধান ফিরিয়ে আনতে আরেকটি গণভোটের প্রস্তাব তোলেন। ইস্তাম্বুলে নিজের সরকারি বাসভবন হুবার প্রাসাদে এক ব্রিফিংয়ে এরদোগান বলেন, ‘তুরস্ক আজ এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনগণকে সাথে নিয়ে আমরা দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করতে যাচ্ছি।’
সাংবিধানিক সংস্কারে যা ঘটবে : গত জানুয়ারি মাসে তুর্কি পার্লামেন্ট সে দেশের সংবিধানের ১৮টি ধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন অনুমোদন করে। সংবিধান সংশোধনের পে ৩৩৯ ও বিপে ১৪২ ভোট পড়ে। ওই সংশোধনী জনগণ পছন্দ করে কি না তা জানার জন্য রোববারের গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় এক শতক আগে প্রজাতন্ত্র ঘোষিত তুরস্কের সংবিধানে আমূল পরিবর্তন ঘটবে এই সংস্কারের ফলে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, তুরস্কের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর। তখন থেকে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর এবং সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ তিনি মতায় থাকতে পারবেন। অতএব এরদোগান পরপর দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হলে তার পক্ষে ২০২৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকার পথ খুলবে।
সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ মতায় থাকার সীমা বেঁধে দেয়া হলেও পার্লামেন্ট প্রয়োজন মনে করলে দ্বিতীয় মেয়াদ সংপ্তি করে আগাম নির্বাচন দিতে পারবে এবং সে েেত্র আগের প্রেসিডেন্ট আরো এক মেয়াদ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
নতুন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর তেমন ভূমিকা থাকবে না। নির্বাহী মতা কেন্দ্রীভূত হবে প্রেসিডেন্টের হাতে। অনির্দিষ্টসংখ্যক ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিতে পারবেন তিনি।
মন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বরখাস্ত করার েেত্র প্রেসিডেন্টের মতা বাড়বে।
এখন মন্ত্রিসভা ডিক্রি জারি করতে পারে। নতুন ব্যবস্থায় সেই মতা যাবে প্রেসিডেন্টের হাতে। দেশে কখন জরুরি অবস্থা জারি করতে হবেÑ সেই সিদ্ধান্তও তিনি নিতে পারবেন।
প্রেসিডেন্ট হবেন সরকারের নির্বাহী প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান। আবার রাজনৈতিক দলের সাথেও তিনি সম্পর্ক রাখতে পারবেন।
এক দশকের বেশি সময় তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির তখনকার নেতা রজব তাইয়েব এরদোগান। পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টের পদটি আলঙ্কারিক হলেও ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে এরদোগানের হাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা চলে যায়। এরদোগানের সময় তুরস্কের মধ্যবিত্তের হাতে অর্থ এসেছে, দেশের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।
তিনি বলছেন, অভ্যুত্থান চেষ্টার ৯ মাস পর তুরস্কের নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলো আমলে নিতে এবং অতীতে জোট সরকারগুলোর সময় যে নাজুক সময় তুরস্ক পার করেছে, তার পুনরাবৃত্তি এড়াতে এসব পরিবর্তন দরকার। তুরস্কের নতুন এ সরকারব্যবস্থা হবে অনেকটা ফ্রান্স বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো। মধ্যপ্রাচ্যের উদ্বাস্তু সঙ্কট থেকে শুরু করে প্রতিবেশী সিরিয়ায় যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, কুর্দি বিদ্রোহ ইত্যাদি সমস্যার এ সময়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নতুন সরকারকাঠামো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/212970