১৮ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৪৮

কূটনীতির কূটজালে বাংলাদেশ

|| ড. আবদুল লতিফ মাসুম ||

পররাষ্ট্রনীতির নির্ধারক বা বাধ্যবাধকতা দুই ধরনের : বহিঃদেশীয় ও অভ্যন্তরীণ। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত সবাই স্বীকার করবেন, ভারত একটি নির্ধারক বা বাধ্যবাধকতা। অভ্যন্তরীণ নির্ধারক বা বাধ্যবাধকতা হচ্ছে দেশের মানুষের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের এ নিরিখেই প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক দিল্লি সফর বিবেচ্য। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উভয় দেশের ক্ষমতার রাজনীতির বিষয়টি। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে ভারতীয় আধিপত্যের বিষয়টি অনিবার্যতা পেয়ে আসছে। অপর দিকে, বাংলাদেশের মানুষ নানা কারণে ভারতবিরোধীÑ এটাও সত্য। ভারতীয় আধিপত্যের ছোবল এবং বাংলাদেশের মানুষের মনমগজÑ এই দ্বৈত বাস্তবতায় নির্ণয় হয়েছে বর্তমান ঢাকা-দিল্লির স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতার বাতাবরণ। ঢাকায় ক্ষমতাসীন থাকতে হলে দিল্লির আশীর্বাদ প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বাস্তবতার স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন, ২০০১ সালে ভারত-মার্কিন সমঝোতায় বিএনপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। অপর দিকে, প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেনÑ আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে শেখ হাসিনা দিল্লি গেছেন। তাহলে দিল্লি যে একটা নির্ধারক বা বাধ্যবাধকতা তা উভয় নেত্রীর উচ্চারিত বাক্যেই প্রমাণিত। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রাষ্ট্র যত বড়ই হোক বা ছোটই হোকÑ কূটনীতির কুশলতা অনেক সময়েই রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ধারণ করে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি এবং অভিজ্ঞ কূটনীতি সব কিছুকে ওলটপালট করে দিতে পারে। ১৯৬২ সালে চীন যখন ভারত ভূমিতে ক্রম অগ্রসরমান এবং সোভিয়েত শক্তি যখন ব্যর্থ তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ছুটে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির কাছে। ভারত মার্কিন অসম সম্পর্ক সত্ত্বেও নেহরুর ব্যক্তিত্বের উষ্ণতা কেনেডিকে মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়। একটি মার্কিন হুংকারে চীন পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ পরবর্তীকালে পাকিস্তান যখন বিধ্বস্ত তখন কূটব্যক্তিত্ব জুলফিকার আলি ভুট্টোর কেরামতিতে তারা ১৯৩ জন যুদ্ধ অপরাধীসহ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে ভারত থেকে ফেরত নিতে সক্ষম হয়। ছোট রাষ্ট্র হলেও নেতৃত্ব বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এরূপ ব্যক্তিত্বের সাফল্য আমাদেরও আছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দীর্ঘকাল বাংলাদেশে অবস্থান পরিকল্পনা সত্ত্বেও ১৯৭২ সালে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে ভারত বাংলাদেশ থেকে অতি দ্রুত সেনাবাহিনী প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। অপর উদাহরণটি জিয়াউর রহমান আমলের। ক্ষমতার সমীকরণ যখন বদলে যায় ভারত তখন বাংলাদেশের ওপর ক্ষুব্ধ। এই বৈরী পরিবেশে কিভাবে জিয়াউর রহমান তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে মুগ্ধ করেছিলেন এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বাভাবিকপর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন সেটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঘটনাটিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করলেও তা বাংলাদেশ নেতৃত্বের ইতিবাচক দিককে নির্দেশ করে।
পররাষ্ট্রনীতির অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে ‘জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ’। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোনের বহুল উদ্ধৃত উক্তিটি এ রকম ‘গ্রেট ব্রিটেন ডাজ নট হ্যাভ অ্যানি পারমানেন্ট ফ্রেন্ড অর ফো, বাট হ্যাজ গট পারমানেন্ট ইন্টারেস্ট।’ স্থিতিশীল জাতিগুলো সরকারের অদলবদল হলেও পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষা কৌশল এবং উন্নয়ন বিষয়ে কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয় না। কিন্তু আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় সরকারের বদল হলেই রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির পরিবর্তন ঘটে। ভারতে যখন সরকার পরিবর্তন হলো কংগ্রেসের বদলে বিজিপি ক্ষমতায় এলো তখন বাংলাদেশের অনেকেই ভেবেছিলেন বাংলাদেশ প্রশ্নেও পরিবর্তন আসবে। তাদের ধারণা গুরুতর অসাড় প্রমাণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার যখন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সাথে দেখা করেন তখন তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন’। স্মরণ করা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান সফর কংগ্রেস সরকার অনুসৃত নীতিমালারই সম্প্রসারণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষা কৌশল এবং উন্নয়ন বিষয়ে স্বাধীনতার অর্ধশত বছরেও ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
স্বাক্ষরিত ছয়টি চুক্তি এবং ১৬টি সমঝোতাস্মারক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সম্পর্কের বিষয়টি সর্বাত্মক। ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’ পর্যন্ত কোনো কিছুই বাদ যায়নি। সব বিশ্লেষণ করলে এর প্রমাণ মিলবে। ছয়টি চুক্তি এ রকম : ১. পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহযোগিতা, ২. পারমাণবিক নিরাপত্তা ও তেজস্ক্রিয়তা রোধে কারিগরি তথ্য ও বিধিবিধান প্রণয়ন, ৩. বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা, ৪. অডিওভিজুয়াল যৌথ প্রযোজনা চুক্তি, ৫. মোটরযান যাত্রী চলাচল (খুলনা-কলকাতা রুট), ৬. বাংলাদেশে ৩৬টি কমিউনিট কিনিক নির্মাণে অর্থায়ন। অপর দিকে ১৬ সমঝোতা স্মারকের বিষয়গুলো নি¤œরূপ : ১. প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কাঠামো, ২. বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণসহায়তা, ৩. তামিলনাডুর ওয়েলিংটন (নীলগিরিস) ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ এবং মিরপুরের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের মধ্যে কৌশলগত ও অপারেশনাল স্টাডিজ বিষয়ে সহযোগিতা বাড়ানো, ৪. বাংলাদেশকে সরকার ভারত সরকারের দেয়া ঋণ, ৫. ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ঢাকা এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, নয়াদিল্লির মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও কৌশলগত বিষয়ে সহযোগিতা জোরদার করা, ৬. মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, ৭. তথ্যপ্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিকস ক্ষেত্রে সহযোগিতা, ৮. সাইবার নিরাপত্তা, ৯. ‘সীমান্ত হাট’ স্থাপন, ৯. বিচার বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা, ১১. বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের ভারতে প্রশিক্ষণ, ১২. নৌচলাচল বিষয়ে সহযোগিতা, ১৩. ভূবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন, ১৪. উপকূলীয় ও প্রটোকল রুটে যাত্রী ও জাহাজ চলাচল, ১৫. সিরাজগঞ্জ থেকে দইখাওয়া এবং আশুগঞ্জ থেকে জকিগঞ্জ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল রুটে চলাচলের সুবিধা ও ১৬. গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সহযোগিতা। সফরের দ্বিতীয় দিনে ভারত বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। ১১টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত ৬২ দফার এ বিবৃতিতে উভয় দেশের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়। ১১টি অনুচ্ছেদের প্রথম দফায় উভয় প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি ও আনুষ্ঠানিকতা বিষয় স্থান পায়। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বের গভীরতা ও ব্যাপকতা ব্যাখা করা হয়। তৃতীয় অনুচ্ছেদে সফর বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত স্থিতিশীল অংশিদারিত্বের প্রশংসা করা হয়। চতুর্থ অনুচ্ছেদে উভয় দেশের নিরাপত্তা পরিবেশ নিশ্চিতকরণের পদক্ষেপগুলো বর্ণনা করা হয়। পঞ্চম অনুচ্ছেদে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে ভারতীয় অবদানের ব্যাখ্যা করা হয়। ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে জ্বালানি খাতে বর্ধমান সহযোগিতার কথা বিবৃত হয়। সপ্তম অনুচ্ছেদে সমৃদ্ধ অংশিদারিত্বের জন্য ব্যবসায় এবং বিনিয়োগ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। অষ্টম অনুচ্ছেদে জলে, স্থলে ও আকাশে যোগাযোগ ক্ষেত্রে আরো সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলা হয়। নবম অনুচ্ছেদে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয় তুলে ধরা হয়। দশম অনুচ্ছেদে ভারত-বাংলাদেশ নাগরিকদের মধ্যে অধিকতর সম্পর্কোন্নয়নের ওপর জোর দেয়া হয়। একাদশ অনুচ্ছেদে দেশ-বিদেশে যৌথ বন্ধুত্বের খতিয়ান তুলে ধরা হয়।
চুক্তি, সমঝোতা ও যৌথ বিবৃতিগুলোয় পারস্পরিক প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা এবং আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের আধিক্য রয়েছে। এর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে প্রতিরক্ষা খাতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণসহ ২২টি চুক্তি ও সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর করেছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে আরো ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার ঘোষণাও আসছে ওই বৈঠক থেকে। বাণিজ্যিক বিষয়ে বিভিন্ন সমঝোতা, স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সব মিলিয়ে কত সমঝোতা চুক্তি এবং অনুচুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে স্বয়ং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও জানেন না। সবচেয়ে যে বিষয়টি ভারতের পক্ষ থেকে গুরুত্ব পায় তা হচ্ছে প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, দুই নেতা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং গভীরতর সহযোগিতার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিষয়টির ওপর তারা গুরুত্বারোপ করেন। তারা উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। দুই প্রধানমন্ত্রী আরো সংহত ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। দুই নেতা স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারককে স্বাগত জানান। তারা প্রতিরক্ষা খাতে প্রদত্ত ঋণ এবং বিভিন্ন প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রশিক্ষণ সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেন। তবে প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে উভয় সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে কোনো ধরনের গোপনীয়তার কথা অস্বীকার করেন। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘এগুলো নিয়ে লুকোছাপার কোনো কারণ নেই, গণমাধ্যমে এসেছে। কিছু চুক্তি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে।’ প্রতিরক্ষা বিষয় স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘সমঝোতাস্মারক মানার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ বিএনপির সময় স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী রাষ্ট্রের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে।’ স্মরণ করা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী সফরের আগে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝোতার বিষয়টি দেশে বিপুল বিতর্ক সৃষ্টি করে। সংবাদপত্র, টকশো এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ চুক্তির তীব্র বিরোধিতা লক্ষ করা যায়। এর পক্ষেও কিছু বুদ্ধিজীবী অবস্থান নেন। চুক্তি বিরোধিতাকারীদের যুক্তি এই, একমাত্র রাষ্ট্রের তরফ থেকে প্রতিরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে, তার সাথে চুক্তির আদৌ কোনো যৌক্তিকতা রয়েছে কি? প্রতিপক্ষ যুক্তি দেখায়, ভারত পরীক্ষিত মিত্র। তার সাথে চুক্তিতে বাধা নেই। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে এ নিয়ে টানাপড়েন চলে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, বিষয়বস্তুর সাথে সরকার দ্বিমত পোষণ না করলেও কৌশলগত কারণে ‘চুক্তি শব্দটি ব্যবহারে সরকারের আপত্তি রয়েছে’। দৃশ্যত ভারত বাংলাদেশ বৃহত্তর প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা চুক্তিতে ইতঃপূর্বেই আচরণগতভাবে আবদ্ধ হয়েছে। উভয় দেশ : ক. পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য দেশের ভূমি যাতে সন্ত্রাসী বা অন্য কোনো পক্ষ ব্যবহার না করতে দেয় সে ব্যাপারে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে, খ. সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার অঙ্গীকার রয়েছে, গ. তথ্যবিনিময় সহযোগিতায় উভয়পক্ষ সম্মত রয়েছে, ঘ. উভয় দেশের অপরাধী প্রত্যর্পণে চুক্তি রয়েছে, ঙ. বর্তমান স্বাক্ষরিত চুক্তির বলে ট্রানজিট বা কানেকটিভিটির বিষয়টি সামরিক বা প্রতিরক্ষা খাত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এই প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম কিনবে। এ খাতে ভারত বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ঋণ দিয়েছে। এত দিন বাংলাদেশ শুধু সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ চীনের বিরূপ মনোভাবের শিকার হবে হয়তো।
যৌথ বিবৃতিতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে কোণঠাসা করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। নবগঠিত দক্ষিণ এশীয় উপ-আঞ্চলিক জোট বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল-বিবিআইএনের উল্লেখ আছে। আরো উল্লেখ আছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড সমন্বয় গঠিত বিমসটেকের। কিন্তু বাংলাদেশের উদ্যোগে গঠিত আঞ্চলিক ফোরাম সার্কের উল্লেখ নেই। যৌথ ঘোষণার একাদশ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ দ্ব্যর্থহীনভাবে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের জন্য ভারতের দাবিকে সমর্থন করার অঙ্গীকার করেছে।
উল্লেখ্য, চীন ভারতের এ দাবিকে সর্বাত্মক বিরোধিতা করে আসছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জন্য স্বাধীন ও উন্মুক্ত সিদ্ধান্তের অধিকার খর্ব হয়েছে। চুক্তির সামগ্রিক বিশ্লেষণ করে একটি জাতীয় দৈনিকে মন্তব্য করা হয়, ‘চুক্তি ও সমঝোতাগুলোর শিরোনাম থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, এসব চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভারত নির্ভরতা কার্যত নিরঙ্কুশপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
এই সফরে ভারতের সবচেয়ে লাভজনক বিষয়টি হচ্ছে বাণিজ্য সম্প্রসারণ। বস্তুত মোদি সরকার যে করপোরেট বাণিজ্যের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে তারা তা বিভিন্নভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে নরেন্দ্র মোদির নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ বাণিজ্যিকভাবে উদ্দেশ্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর সফরে অবশেষে ৯০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। ভারতের জন্য চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে পৃথক ইপিজেড প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। অপর দিকে, সীমান্তে আরো শুল্ক কেন্দ্র ও হাট প্রতিষ্ঠা এবং নানাভাবে বাণিজ্য সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে অধিকতর প্রকল্প গ্রহণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে জ্বালানি খাতে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ, ডিজেল, তরলীকৃত গ্যাস এবং পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। এসবের বেশির ভাগই বেসরকারি খাতে রয়েছে। সরকারি যে ঋণপ্রস্তাব করা হয়েছে তার উল্লেখযোগ্য অংশ বিনিয়োগ হবে জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতের অবকাঠামো নির্মাণে। এর মধ্যে রয়েছে ট্রান্সবাউন্ডারি পাইপলাইন প্রকল্প। এ প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে কার্যত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বা পশ্চিম অংশ থেকে বাংলাদেশের পূর্বাংশে অবস্থিত সাতটি প্রদেশে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। এ প্রকল্পের অধীনে প্রস্তাব রয়েছে বাংলাদেশের কুতুবদিয়া দ্বীপে এলএনজি টার্মিনালের কথা। আগেই বলা হয়েছে, ভারতীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুত ৯০০ কোটি ডালারের ৬০০ কোটি ডলারই ব্যয় হবে এ জ্বালানি খাতে। ফলে জ্বালানি ক্ষেত্রে সর্বাংশে বাংলাদেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘিœত হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন। এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতোমধ্যে কৃত বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হুমকির সম্মুখীন হবে। স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ সফরের সময়ও ভারত হাজার রকম ব্যবসায় ও বাণিজ্যের সুবিধা বাগিয়ে নেয়। নরেন্দ্র মোদির এসব বাণিজ্যিক সাফল্য দেখে অনেকে তাকে বাণিজ্যবান্ধব বলে প্রচার করছে। ঢাকায় তিনি যে গণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা ছিল লোকরঞ্জনের একটি বড় উদাহরণ। তিনি যেখানেই যান সেখানেই তুষ্ট করে কথা বলেন। মোদির ঢাকা সফরের অবশেষে একজন কলামিস্ট তাকে চমৎকার বক্তব্য দানকারী বাস-ট্রেনের ফেরিওয়ালার সাথে তুলনা করেছিলেন।
দিল্লি অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে রাজকীয় সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগের লোকেরা ভাবে গদো গদো। প্রটোকল ভেঙে শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অভ্যর্থনা সবাইকে অবাক করেছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে রাত্রিযাপনও ছিল সম্মানজনক। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এটি রাষ্ট্রীয় সম্মান। সন্দেহ নেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি সম্মান। কিন্তু যে কেউ প্রশ্ন করতে পারে এ সম্মানের লক্ষ্য কী? ব্যক্তিকে খুশি করে স্বার্থ আদায়ের সংস্কৃতি নতুন কিছু নয়। অপর দিকে, রাষ্ট্রিক কূটনীতির ক্ষেত্রে বাহুল্য বা আড়ম্বরের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন একটি কৌশল হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এত সম্মান, এত মর্যাদা দেয়া হলো অথচ তার আসল দাবিটিই পূরণ করা হলো না। কূটনৈতিক কুশলীরা বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে তিস্তা চুক্তি হয়নি এ কথা সত্য নয়। বরং সত্য এই যে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘকালীন অনুসৃত প্রতিবেশী পীড়নের অংশ হিসেবেই তা করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে না বলার সাধ্য তাদের হতো না, যদি না বাংলাদেশ তার তুরুপের তাসটি হাতে রাখত। কূটনীতির কূটিলতা এ রকমই যে, সেখানে সহজ সরলতার কোনো স্থান নেই। দেশ কেউ বিক্রি করতে পারে না। আর প্রধানমন্ত্রী সঙ্গতভাবেই বলেছেন ‘দেশ ধামায় করে নিয়ে বিক্রি করার কোনো জিনিস নয়’। দেশ বিক্রির ব্যবসায় এখন আর পুরনো কায়দায় হয় না। দেশ কেউ দখল করে না। দেশের ব্যবসায় বাণিজ্য দখল করে। দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার পরিকল্পিতভাবে বদলে দেয়। মানুষের বিশ্বাস মূল্যবোধ দেশপ্রেমে ভাঙন ধরায়। জাতি হিসেবে স্বকীয়, স্বতন্ত্রবোধের মাত্রাটুকু ধীরে ধীরে ফুরিয়ে দেয়। তবে বাংলাদেশের জনগণের বিষয় বৈশিষ্ট্য অনন্য। এ দেশ সম্পর্কে কবি সুকান্তের ভাবধারায় বহুল উচ্চারিত পঙ্ক্তি ‘সাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ এ যদি হয় বাংলাদেশের মানুষের প্রতিজ্ঞা তাহলে বাংলাদেশ অজেয় থাকবে চিরকাল।
প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mal55ju@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/212847