মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই রেলিং ভেঙ্গে পড়া একটি সেতুর চিত্র -ফাইল ছবি
১৭ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১০:৩২

চার হাজার সেতু চলাচলের অযোগ্য নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই

কথা ছিল সেতুটি নির্মাণের পর ৫০ বছর চলবে। কিন্তু বছর কয়েক যেতে না যেতেই অনেক স্থানে ফাটল ধরেছে। ধীরে ধীরে ফাটল হতে থাকায় এক সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এলজিইডির তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা সদর থেকে জাজিরা হয়ে সহজে ঢাকায় যাতায়াতের জন্য ১৯৯৬ সালে কীর্তিনাশা নদীর ওপর ১০০ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সেতুর এক প্রান্তে ফাটল দেখা দেয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। ধীরে ধীরে ফাটলটি বড় হতে থাকে। অবশেষে গত বছরের জুনে এ সেতু দিয়ে বাস ও ভারি যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলায় জয়কা ইউনিয়নের বারুকবাজার-সংলগ্ন নরসুন্দা শাখা নদীর ওপর এলজিইডি নির্মিত সেতুটির পিলার প্রায় দুই ফুট মাটির নিচে দেবে যায় ২০১৫ সালে। ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর উপজেলা এলজিইডির তত্ত্বাবধানে প্রায় ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩৯ মিটার দৈর্ঘ্যের এ সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল।
কেবল নড়িয়া ও করিমগঞ্জের এ দুটি সেতু নয়, সারা দেশে এলজিইডি নির্মিত এ রকম অসংখ্য সেতু রয়েছে, যেগুলোর কোনোটির পিলার হেলে পড়েছে, কোনোটিতে দেখা দিয়েছে ফাটল, আবার কোনোটির রেলিং ভেঙে গেছে। এরই মধ্যে এ রকম সাড়ে চার হাজার সেতু ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এলজিইডি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে এলজিইডির আওতাধীন ১২ লাখের মতো সেতু ও কালভার্ট রয়েছে। এর মধ্যে অনেক সেতু রয়েছে যেগুলোর নির্মাণকালে মেয়াদকাল ধরা হয়েছিল ৫০ বছর। কিন্তু তার অনেক আগেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এসব সেতুতে যান চলাচল।
সম্প্রতি এলজিইডির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে নিজ এলাকার ত্রুটিপূর্ণ সেতুর তথ্যাদি চেয়ে চিঠি দেয় এলজিইডির ডিজাইন ইউনিট। মাঠপর্যায়ের তথ্য থেকেই ত্রুটিপূর্ণ সেতুর তালিকা তৈরি করছে সংস্থাটি। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠার আগেই সেতুগুলো মেরামত করা হবে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, সমীক্ষা ছাড়াই ১০০ মিটারের নিচে প্রায় সাত হাজার ছোট ছোট সেতু নির্মাণ করেছে এলজিইডি। ছোট নদীগুলোয় ১০০ মিটারের কম দৈর্ঘ্যের যেসব সেতু নির্মাণ হয়, তার কোনোটিরই হাইড্রোমরফোলজিক্যাল সমীক্ষা নেই। সমীক্ষা ছাড়াই নির্মিত এসব সেতু জনগণ ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে বরিশালের পশ্চিম বার্থী গ্রামের ৭৫ ফুট ব্রিজের কাছে বটতলা নামক স্থানে ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে কয়েক স্থানে প্লাস্টার ধসে পড়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে সেতুটি।
ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার দক্ষিণ চেঁচরি গ্রামের জমাদ্দার হাট খালের ওপর ১৯৮৪-৮৫ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ একটি লোহার সেতু নির্মাণ করে। নির্মাণের আট বছর পর ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে সেতুর উত্তর অংশ ভেঙে দেবে যায়। সেতু ভেঙে যাওয়ার পর ২১ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত তা সংস্কারের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এলজিইডি বিভাগ।
ভোলার চরগাজী ব্রিজটি ভেঙে পড়ায় পাঁচটি গ্রামের বাসিন্দাদের সড়কপথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। দেড় বছর আগে ব্রিজটি ভেঙে গেলেও এখনো কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেয়নি এলজিইডি। ফলে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ।
জানা গেছে, ভোলা সদর উপজেলার ভেলুমিয়া বাজার থেকে চরগাজী পর্যন্ত সড়কে তেঁতুলিয়া নদীর শাখা ফুলগাজী খালের ওপর ২০০১ সালে এলজিইডি ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯০ ফুট দৈর্ঘ্য লোহার ব্রিজটি নির্মাণ করে। কিন্তু নির্মাণের পর আর সংস্কার না হওয়ায় গত ২৬ জুন হঠাৎ মাঝখান থেকে ভেঙে যায় ব্রিজটি। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে চন্দ্র প্রসাদ ফুলগাজী ও চরগাজীসহ পাঁচটি গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা।
জানা গেছে, ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে এলজিইডির আওতায় বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় হালকা যান চলাচল প্রকল্পের অধীনে ৮৭টি সেতু নির্মাণ করা হয়। নির্মাণের পর এসব সেতু রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় এরই মধ্যে অধিকাংশ জরাজীর্ণ হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে সেতুগুলোর সিমেন্টের স্পিন্টার, হাতল ও অবকাঠামো। এছাড়া চুরি হয়ে যাচ্ছে লোহার সেতুর হাতল ও অ্যাঙ্গেলসহ অন্য মালপত্র। পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগেই বাঁশ, সুপারি ও অন্যান্য গাছের কাঠ দিয়ে সেতুগুলো কোনো রকমে মেরামত করেন এলাকার বাসিন্দারা। বর্তমানে ঝুঁকি নিয়ে এসব সেতু দিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। ফলে পথচারীরাও প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
এলজিইডির ডিজাইন ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী এবাদত আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের সেতুগুলোর নকশায় লাইফটাইম ৫০ বছর রাখা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অতিক্রম হয় না। তাই কীভাবে এসব সেতু আয়ুষ্কাল পর্যন্ত টেকানো যাবে, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আর ত্রুটিপূর্ণ যেসব সেতু চিহ্নিত হয়েছে, শিগগিরই তা মেরামতের ব্যবস্থা করা হবে। বেশকিছু সেতু একেবারে ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে।
সমীক্ষা ছাড়াই সেতু নির্মাণের বিষয়ে তিনি বলেন, ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘের সেতুগুলোর ক্ষেত্রে সমীক্ষা বাধ্যতামূলক। তবে দৈর্ঘ এর কম হলে সমীক্ষার বাধ্যবাধকতা নেই। মূলত বাড়তি খরচ বাঁচাতেই ছোট ছোট সেতু নির্মাণের আগে সীমাক্ষা চালানো হয় না।
উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কে নির্মিত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আওতাধীন চার হাজার জরাজীর্ণ সেতু ও কালভার্ট সংস্কারে ৬ হাজার কোটি টাকা দিতে চায় বিশ্বব্যাংক। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি এ বিষয় জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছে এলজিইডি। ইআরডি থেকেও এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংককে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, এ বাবদ ১ শতাংশ সুদে বাংলাদেশ সরকারকে ঋণ হিসেবে ৬ হাজার কোটি টাকা দিতে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক, যা ৪০ বছর মেয়াদে পরিশোধ করতে হবে।
বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, লক্ষ করলে দেখা যাবে, ত্রুটিপূর্ণ এসব সেতুর অধিকাংশই ছোট। স্থানীয় অযোগ্য ঠিকাদাররা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় সেতুগুলো নির্মাণের কাজ পান। অনেক সময় যিনি কাজ পেয়েছেন, তিনি তা নিজে না করে অন্য কাউকে দিয়ে করিয়েছেন। ফলে অন্য যে ঠিকাদার কাজটি করেছেন, তার লভ্যাংশও ভাগাভাগি হয়ে যায়। এতে ছোট ছোট সেতুর ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ একেবারেই হয় না। যে সাড়ে চার হাজার সেতু ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোর এ অবস্থা কেন হলো, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করতে না পারলে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/280034-