রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান : নয়া দিগন্ত
১৭ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১০:৩০

নগরজুড়ে পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা

সিটিং সার্ভিস বন্ধ বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ হয়নি

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে অভিযুক্ত সিটিং সার্ভিস নামে পরিচালিত নগর পরিবহন গতকাল থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সকালে মিরপুর ও আসাদ গেটে একযোগে বিআরটিএ ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির যৌথ উদ্যোগে অভিযান শুরু হয়। অভিযানের পর আকস্মিকভাবে সিটিং সার্ভিস লেখা বেশির ভাগ গাড়ি রাস্তায় নামানো বন্ধ হয়ে যায়। অনেকেই দ্রুত লেখার ওপর স্টিকার সেঁটে লোকাল সার্ভিস বানিয়ে নেয়। সিটিং সার্ভিস বন্ধ হলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় একটুও বন্ধ হয়নি। বাস চলাচল কমে যাওয়ায় লোকাল সার্ভিসগুলোর বিরুদ্ধে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে রাজধানীজুড়ে পরিবহন খাতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কয়েক জায়গায় যাত্রীদের সাথে বাসের হেলপার-ড্রাইভারের বাগি¦তণ্ডা হয়। এমনকি অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে হাতাহাতির খবরও পাওয়া গেছে।
সাভার থেকে মতিঝিলগামী ওয়েলকাম পরিবহন গতকালও আগের ভাড়া ৫০ টাকা আদায় করেছে। গাবতলী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নেয়া হয়েছে আগের ভাড়া ২৫ টাকা। হেমায়েতপুর, কলেজগেট ও বাংলা মোটরের পরে তিনজন চেকারও তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে। তবে ভাড়া কম না নিলেও দরজা খোলা রেখে যেখান-সেখান থেকে দেদার লোক উঠানো-নামানোর কথা জানিয়েছেন যাত্রীরা। বেলা ১১টার দিকে ওই পরিবহনে গাবতলী থেকে পল্টনে আসেন সামিউল। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, দরজা খোলা রেখে যত্রতত্র যাত্রী উঠানো-নামানো হয়েছে। তবে ভাড়া কম নেয়নি। আগেও ২৫ টাকা নিয়েছে, এখনো তাই নিচ্ছে। আগে ভোগান্তি কম ছিল। এখন গাদাগাদি করে যাত্রী উঠানো-নামানো হচ্ছে। এতে সময়ও বেশি লাগছে।
মিরপুর থেকে সায়েদাবাদে আসে শিকড়, শিখরসহ বেশ কয়েকটি পরিববহন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে গুলিস্তান গিয়ে দেখা যায়, বাসের মধ্যে গাদাগাদি করে যাত্রীরা ওঠানামা করছেন। এতে যাত্রীদের অনেকেই বিরক্ত প্রকাশ করছেন। তবে ভাড়া কম নেয়া হয়নি। আগের ভাড়া ২৫ টাকা থেকে ২৮ টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। ওই বাসের যাত্রী জাহিদ হাসান জানান, সিটিং সার্ভিস বন্ধ হলেও ভাড়া কমেনি। আগের ভাড়া দিয়েছি। কিছু বললে নয়-ছয় বলে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। মিরপুর থেকে মতিঝিলে আসে নিউভিশন, বিকল্প পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি বাস। ওই সব পরিবহনেরও একই অবস্থা। বাস ভাড়া নিয়ে যাত্রী-হেলপার মুখোমুখি অবস্থা। মিরপুর-১ থেকে শাহবাগের বাসভাড়া তালিকা অনুযায়ী ১৬ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু দিশারী পরিবহন নিয়েছে ২৫ টাকা।
এ দিকে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ভোগ কমানোর জন্য রাজধানীর আসাদগেট, আগারগাঁও (আইডিবি ভবনের সামনে), শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে, রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে ও যাত্রাবাড়ীর চাংপাই রেস্তোরাঁর সামনে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের সাথে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায়। রাজধানীর মিরপুর রোডে অভিযান চালায় বিআরটিএ ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি। সকালে অগ্রদূত পরিবহনের একটি বাস আগারগাঁওয়ে থামিয়ে বাসের মধ্যে ভাড়ার কোনো তালিকা না থাকায় এক হাজার টাকা জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুনিব রহমান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ২৩টি বাসের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা করেছেন। বাসগুলোর বিরুদ্ধে বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ যেমন করেছেন যাত্রীরা, তেমনি অনেক বাসে ভাড়ার তালিকা ছিল না। তিনি আরো জানান, কয়েকটি বাসের ওপরে ক্যারিয়ার পাওয়া গেছে। বাম্পার না খোলায় ৭টি লেগুনাকে জরিমানা করা হয়। এসব ঘটনায় ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। তবে মিরপুর থেকে শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে আসা নাসরিন সুলতানা অভিযোগ করেন, অন্য দিনের চেয়ে আজ বাসে সমস্যা হয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, সিটিং না থাকায় দেদারছে যাত্রী তুলছে বাসগুলো। সিট পূরণ হয়ে গেলেও গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হয়। বাসগুলো যেন বেশি যাত্রী না তোলে সেটিও দেখা দরকার। কিন্তু সে দিকে কেউ নজর দিচ্ছে না। এতে নারীদের ভোগান্তি বেশি হয়েছে। উঠতেও সমস্যা, নামতেও সমস্যা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির অভিযোগ, অস্বাভাবিক গলা কাটা ভাড়া আদায়ের ফাঁদ হিসেবে ব্যবহৃত সিটিং সার্ভিস, গেইট লক, সময় নিয়ন্ত্রণ, কম স্টপেজ সার্ভিস, স্পেশাল সার্ভিস প্রভৃতি বাহারি নাম ব্যবহার করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও দরজা বন্ধ করে বাস চলাচলের কারণে নগরীতে যাত্রী দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। এতে তীব্র সমালোচনার মুখে সরকার ও মালিক সমিতি ঘোষিত নির্দেশনা অনুযায়ী গতকাল থেকে কথিত এই সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা হলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠিক আগের মতো বহাল থাকায় যাত্রীদের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে।
এ দিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওস্থ সাতরাস্তার মোড়ে রাজধানীতে ‘সিটিং’ সার্ভিস বন্ধ এবং যানবাহনের বাম্পার অপসারণ ও অন্যান্য অনিয়ম বন্ধে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) অভিযান পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের বলেন, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরে না আসা পর্যন্ত রাজধানীতে ‘সিটিং’ সার্ভিস বন্ধ এবং যানবাহনের বাম্পার অপসারণ ও অন্যান্য অনিয়ম বন্ধে অভিযান চলবে। তিনি বলেন, আইনের মাধ্যমেই পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা সমাধান করে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা হবে। এখানে কাউকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। ‘সিটিং’ সার্ভিস বন্ধের ফলে যাত্রী হয়রানির আশঙ্কা আছে কি না’Ñ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সেতুমন্ত্রী বলেন, সবাই নিয়মের মধ্যে এলে কোনো সমস্যাই হবে না। যাত্রীদেরও ভোগান্তি রোধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মানুষের ভোগান্তি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজ করব।
গত ৪ এপ্রিল ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে সিটিং সার্ভিস প্রথা বাতিল করার ঘোষণা দেয়। এ ছাড়া যানবাহন থেকে অবৈধ সাইড অ্যাঙ্গেল খুলে ফেলা এবং সিটিং সার্ভিস বন্ধসহ পরিবহন খাতের সমস্যা সমাধানে করণীয় ঠিক করতে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপ (বিআরটিএ) ও মালিক-শ্রমিক নেতারা শনিবার এলেনবাড়ীতে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রোববার থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়াও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, ১৫ এপ্রিলের পর যাত্রীদের কাছ থেকে কোনোভাবেই অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া যাবে না। ভাড়ার তালিকা বাসের ভেতর দৃশ্যমান স্থানে টাঙিয়ে রাখতে হবে। ছাদের ওপরে ক্যারিয়ার, সাইড অ্যাঙ্গেল ও ভেতরের অতিরিক্ত আসন খুলে ফেলতে হবে। প্রতিটি বাস ও মিনিবাসে নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা আসন সংরণ করতে হবে। এক মাসের মধ্যে রঙচটা, রঙবিহীন, জরাজীর্ণ বাস মেরামত করে রাস্তায় নামাতে হবে। তবে অনেকেই এখনো সেগুলো মানছেন না।
মোটরযান আইন অনুসারে, সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই। চালকের আসনসহ মিনিবাসে ৩১টি আসন থাকবে। আর বিআরটিএ পরিবহন খাতের ২০টি বিষয়ে ব্যয়ের খাত বিশ্লেষণ করে বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/212726