১৭ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১০:১৬

গণপরিবহনে গণভোগান্তি

রাজধানীর মোড়ে মোড়ে যাত্রীর চাপ। দীর্ঘ প্রতীক্ষা। একটি গাড়ি এলে তাতে উঠতে ঠেলাঠেলি। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। গণপরিবহন সংকটে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা গেছে রাজপথে। মোবাইল কোর্টের ভয়ে গতকাল এক-তৃতীয়াংশ যানবাহন রাস্তায় না নামায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পরিবহন শ্রমিক নেতারা বলেছেন, মোবাইল কোর্ট সিটিং সার্ভিসসহ নানা আইন লঙ্ঘনের দায়ে বহু পরিবহনকে জরিমানা করেছে। অনেক গাড়ি রেকার ও ড্যাম্পিংয়ে পাঠিয়েছে। এতে অনেক গাড়ি রাস্তায় নামানো হয়নি। ওদিকে রাজধানীতে গণপরিবহনের সিটিং সার্ভিস বন্ধে গতকাল মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা না আসা পর্যন্ত রাজধানীতে ‘সিটিং’ সার্ভিস বন্ধ এবং যানবাহনের বাম্পার অপসারণ ও অন্যান্য অনিয়ম বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট চলবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তেজগাঁওয়ের সাত রাস্তার মোড়ে মোবাইল কোর্ট পরিদর্শনকালে তিনি এ কথা বলেন।
গতকাল বিকাল ৫টা ১৫ মিনিট। কাওরান বাজার মোড়। ২০ মিনিট আগে থেকে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন সিটি ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র রাকিবুল ইসলাম। তার গন্তব্য গাবতলী। রাস্তায় গাড়ির ভিড় লেগে আছে। কিন্তু তার রুটের প্রতীক্ষার গণপরিবহন আসার নাম নেই। অবশেষে আধঘণ্টা পর ৫টা ২৪ মিনিটে ঠেলাঠেলি করে একটি বাসে উঠতে সক্ষম হলেন রাকিবুল। গাড়িতে উঠার আগে তিনি মানবজমিনকে বলেন, সকালেও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর গাড়ি পেতে হয়েছে। মাঝ রাস্তায় মোবাইল কোর্টও দেখেছি। ক্লাস শেষে এখন আবার একই সমস্যায় পড়তে হলো।
একই জায়গায় গাড়ির জন্য অন্তত ২০ মিনিট ধরে অপেক্ষা বসুন্ধরা শপিং মলের দোকান পিটারিং ল্যান্ডের কর্মচারি রনি মিয়ার। তার গন্তব্য উত্তরা হাউজ বিল্ডিংয়ে। শুধু রাকিব বা রনি নয় ওই সময় প্রায় আধঘণ্টায় কাওরান বাজার মোড়ে অফিস শেষ করে অন্তত কয়েকশ’ লোক সেখানে জড়ো হয়ে যান। একটা গাড়ি আসতেই তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন। কোনো মতো উঠে বা বাদুড় ঝোলা হয়ে দুর্ভোগ ও ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন।
এর আগে বেলা সাড়ে ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত মগবাজার, হাতিরঝিল প্রবেশ পথ, কাওরান বাজার মোড়, ফার্মগেট মোড়, খামারবাড়ি, আসাদ গেট এলাকায় গাড়ির জন্য মানুষের জটলা ও দীর্ঘ প্রতীক্ষা দেখা গেছে। প্রতিটি স্থানে ওই সময়ে চোখে পড়ে অর্ধশত থেকে কয়েকশ’ লোকের ভিড়। নিজের রুটের গাড়ি আসতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল অপেক্ষারত যাত্রীরা। দুপুরে ফার্মগেটে প্রায় ২০ মিনিট ধরে অপেক্ষা করেন যাত্রী দেবেজ। উত্তরায় যাওয়ার গাড়ি ধরার প্রতিযোগিতায় নিজের অজান্তেই তিনি একপর্যায়ে ফার্মগেট মোড় ফেলে বেশ খানিকটা দক্ষিণে চলে যান।
জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, গাড়ির জন্য কখন যে মোড় ফেলে এত আগে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি।
কাওরান বাজার থেকে স্বাধীন পরিবহনের একটি গাড়িতে চড়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সিটিং সার্ভিংস তুলে দেয়ার কথা বলা হলেও যথেষ্ট যাত্রী তুলতে সহকারীর অনীহা। বাইরে যাত্রীর ভিড় থাকলেও দরজা অর্ধখোলা। আদায়ও করা হচ্ছে সিটিং সার্ভিসের বাড়তি ভাড়া। গাড়িটি খামার বাড়ি মোড় অতিক্রম করতেই থামে। যথারীতি গাড়িতে উঠে পড়েন এক চেকার। খুঁজেন যাত্রীর তালিকা। সিটিং সার্ভিসের বাড়তি ভাড়া আদায় ও চেকারের বিষয়টি তুলে প্রতিবাদ জানান যাত্রীরা। তখন ওই চেকার নাম প্রকাশ না করে বলেন, আসলে বেশি ভাড়া আদায়ের জন্য নয়। কত টাকা আয় হচ্ছে বা দিন শেষে মালিক কত টাকা ভাড়া আদায় করবে তা জানার জন্যই যাত্রী গণনা হচ্ছে। একপর্যায়ে যাত্রীদের তোপের মুখে দ্রুত কাজ শেষ করে নেমে পড়েন তিনি। এ সময় আবদুর রহমানসহ একাধিক যাত্রী বলেন, সিটিং সার্ভিস তুলে দেয়া হলেও এরা আগের মতোই বেশি ভাড়া আদায় করছে। ভাড়া তোলার সময় এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে সহকারী হারুনুর রশিদের বচসাও চোখে পড়ে।
কারণ জানতে চাইলে হারুনুর রশিদ বলেন, মালিকের ৩০টি গাড়ি আছে। আজ ২৪টি রাস্তায় নেমেছিল। যাত্রীদের এমন সমস্যার কারণে তা থেকেও কয়েকটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
সকালে তালতলা থেকে ফার্মগেটের উদ্দেশ্যে গাড়ি ধরতে গিয়ে অন্তত আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় প্রাপ্তবয়স্ক রুমীকে। অবশেষে এক বাসে চড়েন। নেয়া হয় আগের ভাড়া ২০ টাকা। সিটিং বাসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য গাড়িটিকে আটকান জাতীয় সংসদের সামনে বসা মোবাইল কোর্ট। এরপর যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া ফেরত দিতে বাধ্য করা হয়। পরে ওই গাড়িতে রেকার দেয়ার কথা বলা হলে তিনি দ্রুত নেমে অন্য গাড়ি ধরে ফার্মগেট যান। ওই স্বল্প দূরত্বের জন্যও তাকে গুণতে হয় ১০ টাকা।
দুপুরে কাওরান বাজারে কথা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের সার্জেন্ট জাবেদ আলীর সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, মোবাইল কোর্টের শাস্তি ও মামলা এড়ানোর জন্য ৩০ থেকে ৪০ ভাগ গাড়ি রাস্তায় নামেনি বলে মনে হচ্ছে। এজন্য সকাল থেকেই সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।
কাকরাইলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) এর সামনেও বিআরটিএ এর ভ্রাম্যমাণ আদালত-২ পরিচালিত হয়। বাসে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে জরিমানা ও মামলা করা হয়। দুপুরে ভ্রাম্যমাণ আদালত ২ এর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম ওই আদালত চালান। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ওই মোবাইল কোর্টে ৩০টি মামলা হয়েছে। এর বেশির ভাগই সিটিং সার্ভিস ও গেটলক সংক্রান্ত। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ এর ৩৯ ও ৪০ ধারায় অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ায় মামলাগুলো করা হয়। এর পাশাপাশি মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ীও গাড়ির ফিটনেস, ব্লু-বুক, ড্রাইভিং লাইসেন্স ঠিক না থাকায় এবং বাম্পার ও অ্যাঙ্গেল থাকার কারণে মামলা হয়েছে।
ওই মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঢাকায় কোনো সিটিং সার্ভিস অথবা গেটলক বা বিরতিহীন বলতে কিছু থাকবে না। ভাড়া আদায় হবে বিআরটিএ-এর নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের খবর পেয়ে রাস্তায় গাড়ি কমে গেছে জানিয়েছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ।
এদিকে গতকাল একসঙ্গে ৫ স্পটে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানো হয়। এগুলো হলো, আসাদগেট, আগারগাঁও, বিমানবন্দর রোড, যাত্রাবাড়ী ও আইইবির সামনে।
সকালে সাত রাস্তার মোড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি বলেন, বাম্পার অপসারণ ও অন্যান্য অনিয়ম বন্ধে এ অভিযান শুরু হয়েছে। আইনের মাধ্যমেই পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা সমাধান করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে। এখানে কাউকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
সিটিং সার্ভিস বন্ধের ফলে যাত্রী হয়রানির আশঙ্কা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বলেন, সবাই নিয়মের মধ্যে এলে কোনো সমস্যাই হবে না। যাত্রীদের ভোগান্তিরোধেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মানুষের ভোগান্তি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজ করবো।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=61778&cat=2/