১৭ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১০:১১

বাংলা নববর্ষ কোন্ পথে?

বাংলা নববর্ষের উৎপত্তি কেমন ছিল আর এর গন্তব্য এখন কোন পথে, তা নিয়ে সর্বমহলে একটি গম্ভীর আলোচনা হচ্ছে। বিশেষত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অতি আলোচিত মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করার প্রসঙ্গে বাক্-বিতণ্ডা হচ্ছে। জাতির একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠান নিয়ে এমন বিতর্ক কাম্য নয়। উপরন্তু, সকলের অংশগ্রহণমূলক অনুষ্ঠানকে একটি বিশেষ ধর্ম ও সম্প্রদায়ের আদলে রূপান্তরিত করার প্রয়াসও শুভ নয়। একটি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠানকে যতটুকু সম্ভব সামাজিক রাখাই শ্রেয়; পৌত্তলিকতা বা পৌত্তলিক সদৃশ অবয়ব দেওয়াটাও সুবিবেচনার কাজ নয় মোটেই। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই সেটা মূলস্রোতের মানুষদের ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, দর্শন ও আচার-আচরণের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করেই করতে হবে। এটিই সাধারণ সত্য এবং বাস্তবসম্মত বিষয়।
মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে ‘ফসলী সন’ হিসাবে বাংলা বছরের সূচনা হয়েছিল। আকবর বাদশাহ্র আমত্য ফতেহউল্লাহ সিরাজী গভীর অনুসন্ধান ও গবেষণা করে এদেশের চাষাবাদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি বছর প্রবর্তন করেন। খাজনা ও অন্যান্য কাজের সুবিধার্থে করা বর্ষক্রমই আজকের বাংলা বছর। এটাই ইতিহাসের ভাষ্য।
এখন প্রশ্ন হলো, কৃষক ও চাষের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি মহল কিভাবে বাংলা নববর্ষকে কিডন্যাপ করল? নগরের কতিপয় মধ্যবিত্ত পুরো বছর ইংরেজি সংস্কৃতির তাবেদারী করে কেবলমাত্র একটি দিন বাঙালি সাজার হাস্যকর চেষ্টার হেতু কি? কোনো দিনও পান্তা না খেয়ে, গামছা বা লুঙ্গি না পরিধান করে যারা জীবন কাটায়, তারা অকস্মাৎ একটি নাটকীয় আয়োজন করার পেছনে কারণ কি? কৃষক, শ্রমিক, কৃষি ব্যবস্থার কি উপকার হচ্ছে এসব ভূমিবিচ্ছিন্ন উদ্যোগে? এসব কথা না ভাবলেই নয়।
বাংলাদেশের কৃষক ঐতিহাসিকভাবেই সংগ্রামী ও পরিশ্রমী। ইংরেজ আমলের পুরোটা সময়ই কৃষক লড়াই করেছে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। ইংরেজ আর হিন্দু জমিদারদের কবল থেকে শুধু জমিই নয়, ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্যও লড়তে হয়েছে কৃষকদের। হাজি শরীয়তুল্লাহ, তীতুমীর বাংলার কৃষক সমাজের সংগ্রামী লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কলকাতাকেন্দ্রিক ইংরেজ ও হিন্দু জমিদারদের শোষণ ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদের চিহ্নই তো বাংলার সংস্কৃতি এবং নববর্ষের চেতনা। সে চেতনা কোথায় গেল?
বরং আমরা এখন কোন চেতনা দেখছি? যারা বলত, এরা বাঙালি নয়, মুসলমান, তারাই তো এখন মাথায় চেপে বসেছে। বাঙালি ও হিন্দু সংস্কৃতিকে একাকার করে দেখেছে কলকাতার নেতৃবৃন্দ ও লেখকগণ। বাঙালি মুসলমানদের বাঙালিত্বকে অস্বীকার করেছে। পরবর্তীতে ব্যর্থ হয়ে বাঙালি মুসলমানদের উপর নিজের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছে। আজকে যে ধারায় এবং পদ্ধতিতে বাংলা বর্ষবরণ হচ্ছে, সেটা দেখে জ্ঞানসম্পন্ন যে কোনো মানুষ বিচলিত হতে বাধ্য। ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরে শাখা, সিঁদুর, ধুতি, আবীর নারী-পুরুষদের ভাসিয়ে দিচ্ছে। এতে কোন বার্তা প্রচারিত হয়? বর্ষবরণের ছদ্ম¦াবরণে আসলে কি চালানো হয় বা হচ্ছে?
নিশ্চয় বাংলা নববর্ষ বাঙালির একান্ত উৎসব এবং এটি যথাযথভাবে পালিত হওয়ার দরকার আছে। দরকার আছে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চাহিদার আলোকে অনুষ্ঠানের বিন্যাস সাধন করার। কলকাতার উৎসব আর ঢাকার উৎসবের ধরন ও আয়োজন কখনোই এক হতে পারে না। ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ইতিহাস ও দর্শনের জন্যই সেটা হওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব হলে ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হতো না; একই থাকত। কিন্তু হিন্দু মহাসভা সর্বাগ্রে ভাগাভাগির দাবি করল এবং বলল, মুসলমানদের সঙ্গে থাকলে তাদের জাত যাবে। তারা চরম আন্দোলন করে বাংলাকে ভাগ করল। বাংলা বিভক্ত হল এবং পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা ন্যায্য হিস্যা হারালেন। এখন কলকাতার লুটেরা সংস্কৃতির কাছে আবার ধরনা দেওয়ার হেতু কি?
সবাইকে নববর্ষের আয়োজনে যোগ দিতে বলা হচ্ছে। ভালো কথা। দেশের মানুষ দেশের আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আয়োজকরা কি জানেন না, মুর্তি বা প্রতীক পুজা ইসলামে নিষিদ্ধ? ইসলাম একেশ্বরবাদী ধর্ম। মুসলমানরা নিরাকার এক আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করেন। সেখানে মাথার উপর নানা মুর্তি, মুখোশ, প্রতীককে বহন করা কি করে সম্ভব হবে? ইসলামের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই আয়োজনে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা ও কৃষক সমাজেরই বা কি লাভ হবে?
বাংলা নববর্ষকে বাংলাদেশের কৃষক, কৃষিব্যবস্থার অনুকূলে নিতে হবে। নাগরিক সমাজের মধ্যস্থিত একটি কৃষি ও ধর্ম-বিচ্ছিন্ন অংশের কথিত আয়োজনকে সার্বজনীন তথা সকলের জন্য হিতকর এবং সকলের জন্য অংশগ্রহণের উপযুক্ত করতে হবে। নববর্ষের এইদিনে একদিনের জন্য বাঙালি না হয়ে বাংলার সংগ্রামী ঐতিহ্যকে ধারণ করতে হবে। বাংলার কৃষক সমাজকে যে আর্য, ব্রাহ্মণ্যবাদ, উত্তর ভারতীয় ও ইংরেজ আগ্রাসন মোকাবিলা করেই নিজের ধর্ম-সংস্কৃতি-অর্থনীতি ও রাজনীতিকে রক্ষা করতে হয়েছে, সেই মহান ঐতিহ্যকে পুনরুচ্চারণ করতে হবে। আজকেও আমরা যে আগ্রাসন ও হস্তক্ষেপের মধ্যে আছি, তাকেও চিহ্নিত করতে হবে। বস্তুতপক্ষে, বাঙালি মুসলিম সমাজের সংগ্রামী ঐতিহ্যই যে আমাদের শক্তির আসল স্তম্ভ, এই সত্যটিকে উপলব্ধি করে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে।
বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের বিরুদ্ধে বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। মসলিন চাষীদের হাতের আঙুল কেটে দেওয়া হয়েছে। চাবুক মেরে নীল চাষে বাধ্য করা হয়েছে। দাড়ি রাখলে বা টুপি পরিধান করলে খাজনা দিতে হয়েছে। মুসলিম নাম রাখতে দেওয়া হয় নি। বার বার চেষ্টা করা হয়েছে তাদের শির নত করানোর জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্বাসী বাঙালি মুসলমানগণ কখনোই এক আল্ল্হা ছাড়া আর কারো কাছেই শির নত করেন নি; মাথা নামান নি। এই সাহস, বিক্রম ও শৌর্য্যই বাংলাদেশের শক্তি। যে কোনো উৎসব ও আয়োজনে এই শক্তির কথাটিই সবচেয়ে সামনে রাখতে হবে।
দুঃখের বিষয় হলো, সামনে রাখা হচ্ছে তাদের, যারা আমাদের চিরায়ত ক্ষমতা ও শক্তিকে বিনষ্ট করতে চেয়েছে, তাদেরকে। রাজনৈতিক শক্তিতে এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে যারা তখন এবং এখনো আমাদের ক্ষতিই করছে, তাদেরকে সামনে নিয়ে নৃত্য করার মধ্যে তো শুভবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় না? ভূমি ও কৃষক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নগরের রাজপথে ও প্রান্তরে সাজানো আয়োজনের মাধ্যমে বাঙালি সাজার মধ্যেও তো কৃত্রিমতার গন্ধ থাকছে। মানুষ এসব নিয়ে কথা বলছে। আলেম সমাজ এবং সচেতন নাগরিকগণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। একটি জাতীয় অনুষ্ঠানকে সঠিক অর্থে ‘জাতীয়’ অবয়ব দিতে হলে সকলের বক্তব্যই মান্য করতে হবে। একদেশদর্শী বা পক্ষপাতী হয়ে সেটা করা যাবে না। এমনটি করা হলে বিচ্ছিন্নতা বাড়বে বৈ কমবে না।
অতএব বাংলা নববর্ষ নিয়ে বিত-ার অবসান হওয়া দরকার। কেউ যে মনে ক্ষোভ ও অপছন্দ নিয়ে উৎসব না করেন, সেটাই দেখতে হবে। সকলে যেভাবে চান, ইতিহাস ভেবে নির্দেশ করে, সেভাবেই সব কিছুকে সুসমন্বিত করতে হবে। জাতির একটি অনুষ্ঠানে একদল মাতামাতি করবে আর আরেকদল মুখ ফিরিয়ে রাখবে, তা কাম্য নয়। বরং সকলেই কিভাবে নিজ নিজ বিশ্বাস ও মর্যাদা নিয়ে একীভূত হতে পারেন, সেটাই বিবেচনা করা দরকার।
সংস্কৃতি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও মজবুত করে। জাতির মূল চিন্তার প্রকাশও ঘটে সংস্কৃতিতে। বাংলাদেশের জনগণ তথা মুসলিম বাঙালির সংস্কৃতির পুষ্টি সাধন করেই জাতিকে শক্তিশালী করা যাবে। অন্য পথে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতির পথ নয়, ঐক্যের পথের দিশা জাগাতে হবে বাংলা নববর্ষসহ সকল উৎসব ও আয়োজনে।

 

http://www.dailysangram.com/post/280082-