|| মো. তোফাজ্জল বিন আমীন || প্রাক ইসলাম যুগে আরবরা ছিল মূর্তি পূজারীর অনুসারণী। তারা পাথর মাটি ও অন্যান্য বস্তু দিয়ে দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করত। এসব মূর্তিকেই তারা পূজা করত। ওই সব মূর্তি পূজা যে কতটা অর্থহীন ছিল তার বর্ণনা কুরআনে ইব্ররাহীম (আঃ) এর কাহিনীতে জানা যায়। সকল আম্বিয়ায়ে কেরামগণ মূর্তি পূজা ধ্বংস করার জন্যে প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু আজকে একশ্রেণীর মুসলমান মূতি পূজার পক্ষে মায়াকান্না করছে যা সত্যিই বেদনাদায়ক। মুসলিম সমাজের সংস্কৃতির স্বরূপ কী, কোনটি মুসলমানের করণীয় আর কোনটি বর্জনীয় তা মুসলমানদের জানা প্রয়োজন। আমরা মনে করি প্রতিটি মুসলমানের কালেমার অর্থ অনুধাবন করা একান্ত প্রয়োজন। কালেমা আমাদেরকে শিরক বিদাত থেকে মুক্ত থাকার নির্দেশ প্রদান করে। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে এমনিতে উদ্বেগ উৎকন্ঠার শেষ নেই। ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিরাপদে ঘরে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের সবাই থাকে দুচিন্তায়। এমন এক কঠিন সময়ে দেশের প্রধান বিচারালয়ের সামনে গ্রীক দেবীমূতি স্থাপন করা হয়েছে। মূর্তি স্থাপন করার পর তা অপসারণের জোর দাবি আলেম-ওলামা ও ইসলামী দলগুলো জানিয়েছে। কিন্তু মূর্তি স্থাপনের পক্ষে বাম-ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা শুধু সাফাই গেয়েছে বিষয়টি এমন নয়, তারা ভাস্কর্য অপসারণে মনঃক্ষুণœ হয়ে বিষোদগার করছে। মহান আরশের অধিপতির কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া যে দেরীতে হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মূতি অপসারণের পক্ষে একমত পোষণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর্য সরানোর দাবিতে একমত হলেও তার দলের কিছু অনুজ নাখোশ। আমরা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
গত মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমী মাদরাসার আলেমদের সঙ্গে এক সাক্ষাতে বলেন, সুপ্রিমকোর্টের মূল ভবনের সামনে নির্মিত গ্রিক দেবী থেমিসের মূতি সরানোর ব্যাপারে আমি আপনাদের সাথে একমত। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের সামনে যে গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে তা আমি নিজেও পছন্দ করি না। কারণ, গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি আমাদের এখানে আসবে কেন? এটা তো আমাদের দেশে আসার কথা নয়। আর গ্রিকদের পোশাক ছিল একরকম, সেখানে মূর্তি বানিয়ে আবার শাড়িও পরিয়ে দেয়া হয়েছে। এটাও একটা হাস্যকর ব্যাপার হয়েছে। এই অভিমত জানানোর পাশাপাশি তিনি এও জানিয়েছেন, ‘এটা কেন করা হলো, কারা করল, কিভাবে এলো তাও আমি জানি না। তিনি আলেমদের আশ্বস্ত করে অতঃপর বলেছেন, ‘ইতিমধ্যেই আমাদের প্রধান বিচারপতিকে আমি এই খবরটা দিয়েছি এবং শিগগিরই আমি তার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বসব। আলোচনা করব এবং আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা এখানে থাকা উচিত নয়।
প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যে বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের মনে দাগ কেটেছে। শুধু বামপন্থীরা কষ্ট পেয়েছে তা কিন্তু নয়! একটি জাতীয় দৈনিকেরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ঐ পত্রিকাটি কিছু দিন আগে একটি রিপোর্ট করেছে বসন্তবন্দনার। গত বৃহস্পতিবার প্রথম পৃষ্ঠায় রাজনীতিতে অশনি সংকেত শিরোনামে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন দিয়েছে যার মর্ম হচ্ছে, এই বুঝি ইসলাম এলো, আর দেশ গোল্লায় গেলো। বিশেষ প্রতিনিধির একটি প্যারায় সরকার কর্তৃক পাঠ্যপুস্তকের কিছু সংশোধন আর কওমী মাদরাসাকে স্বীকৃতি দেয়ার সাথে পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি, চট্রগ্রামে দেয়ালের আলপনা পোড়া মবিল দিয়ে ঢেকে দেয়ার একটি ঘটনাজুড়ে দিয়ে রাজনীতিতে অশনি সংকেত আবিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। কিছু সেকুলার বুদ্ধিজীবী অনবরত বুঝাতে ব্যস্ত ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন এদেশে যা কিছু আছে তাই অসাম্প্রদায়িক। একটা জিনিস বোঝা দরকার যে লোক সংস্কৃতি সব দেশেই থাকে। কিন্তু সে দেশের সংস্কৃতি বলতে কেবল লোক-সংস্কৃতিকে বোঝায় না। তার চেয়ে উঁচু স্তরের সংস্কৃতিও একটা থাকে। সেই সংস্কৃতি দেশের মানুষের মননশীলতার প্রতীক ও রাষ্ট্রসত্তার ভিত্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আমাদের এখানকার এই ভিত্তিটা হচ্ছে ইসলাম। এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে যে কথা তিনি বলে গেছেন তা পাঠকদের প্রতি অনুরোধ রইল পড়ার। এ দেশ, এই মাটি, এই মানচিত্র মুসলিম জাতীয় চেতনার ফসল এবং তারই ফলশ্রুতিতে আজ আমরা এই ভূখণ্ডের অধিকারী। নতুবা আমরা ভারত সাম্রাজ্যেরই একটি অঙ্গরাজ্য ছাড়া কিছু হতাম না। সরকারের সাথে আলেম-ওলামাদের সম্পর্ক দেখে একশ্রেণীর নীতিহীন সাংস্কৃতিক বোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের গায়ে আগুন ধরেছে।
ধর্মনিরেপক্ষতার ধ্বজাধারী বোদ্ধাদের গ্রীক মূতির জন্যে এত মায়া কেন? তাঁরা মনে করেন গ্রীক দেবী মানব জাতিকে ন্যায়বিচার ও নৈতিকতা পালনের নির্দেশ প্রদান করে। তার মুখ নিঃসৃত বাণী স্বর্গীয় আইন হিসেবে বিবেচিত। ওই সব পন্ডিত নামের চেতনাবাদীর নিকট প্রশ্ন হলো, থেমিস বাংলাদেশের বিচারের প্রতীক হবে কেন? আর গ্রীক মূর্তি স্থাপন সুপ্রিম কোর্টের সামনেই বা কেন করা হলো। ন্যায়বিচারের জন্যে গ্রীক মূর্তির ভাস্কর্ষ স্থাপন করার কোন মানে হয় না। কেউ যদি ভাস্কর্য বানাতে চায় তা নিজের বাসায় অথবা অধিকারভুক্ত স্থানে তা স্থাপন করলে কেউ আপত্তি করবে না। ন্যায়বিচার যদি গ্রীক দেবীর মূর্তি নিশ্চিত করতে পারতো তাহলে বিচারের বাণী নিভৃতে কাদঁতো না। গ্রীক মূর্তি স্থাপন করার আগে কি সুপ্রিম কোর্টে ন্যায়বিচার হয়নি? সেই ১৯৪৮ সাল থেকে ন্যায়বিচারের সর্বস্বীকৃত প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা সুপ্রিম কোর্টে শোভা পাচ্ছে। যে কেউ মনে করতেই পারে যে দাঁড়িপাল্লাকে সরিয়ে দেয়ার জন্যই এই গ্রীক মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। ৯২ শতাংশ মুসলমানের বিশ্বাস, চিন্তা ও ঐতিহ্যে মূর্তির কোন স্থান নেই। এদেশের হাজারো মানুষ মনে করে কল্পিত কোনো দেবী বা মূর্তি মানুষের ভালো বা মন্দ কিছুই করতে পারে না।
নাস্তিক্যবাদীরা সরকারের ভালো উদ্যোগকে গ্রহণ করতে পারছে না বলেই বিরূপ মন্তব্য করছে। এদেশের আলেম-ওলামার সাথে সরকারের সখ্যতা গড়ে উঠুক তারা তা চায় না এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তারা ইসলাম শব্দটিকে সহ্য করতে পারে না। হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাদের মুখ বা কলম থেকে একটু টুঁ শব্দ উচ্চারিত হয় না। যে কারণে প্রধানমন্ত্রীর ভালো একটি উদ্যোগকে স্বাগত না জানিয়ে উল্টো সাম্প্রদায়িকতার জুজুর ভয় দেখাচ্ছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ের এসব ঘটনাপ্রবহ এবং হেফাজতের সঙ্গে আপস অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অসাম্প্রদায়িক শক্তির হাত সংকুচিত করবে। তাঁর ভাষ্যমতে যারা পয়লা বৈশাখ-এর বিরুদ্ধে কথা বলছে তারা জাতির শত্রু। ভাস্কর্য অপসারণ গ্রহণযোগ্য নয় বলে দাবি করেছেন মুনতাসীর মামুন। তাঁর মতে, পাঠ্যক্রম পরিবর্তন, কওমী মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি, ভাস্কর্য অপসারণ, প্রাচীর চিত্র মুছে ফেলা, মঙ্গলযাত্রার প্রতি হুমকি একই সূত্রে গাঁথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক ও তাদের দাবি মেনে নেয়ার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উসকে দেয়া হয়েছে এমন মন্তব্যই করেছে সরকারের শরিক ১৪ দল ও বাম দলগুলো। বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক অজয় রায় বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্য সরিয়ে নিলে এর বিরুদ্ধে তরুণ শক্তিকে আন্দোলনে নামতে হবে। ভাস্কর্ষটি ন্যায়ের প্রতীক, এটা কোনো সাধারণ মূর্তি নয়। এটি থাকার প্রয়োজন আছে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেবেন আদালত।’’ বামপন্থীরা ইসলামের বিরুদ্ধে ছিল সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে। তারা সমাজ সংস্কৃতির মোড়কে ইসলাম ধর্মকে সাংঘর্ষিক হিসেবে জাতির সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী অবিলম্বে ওই মূর্তি সরিয়ে দিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান ঘটাবেন, এমনটাই প্রত্যাশা করছে দেশের ১৬ কোটি মানুষের।