১৭ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১০:১০

আন্তঃসংসদীয় সম্মেলন যে বার্তা দিয়ে গেল

দেখা অদেখা

|| সালাহউদ্দিন বাবর ||

ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন ছিল। বাংলাদেশ স্বাগতিক দেশ হিসেবে এই সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারায় ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। আইপিইউ সম্মেলন ছিল বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মধ্যে বৃহত্তম। সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিরা যে বক্তব্য-বিতর্ক করেছেন এবং যে প্রস্তাব ও কর্মসূচি সংবলিত ঢাকা ঘোষণা এসেছে, তার গুরুত্ব সমধিক। সম্মেলনের এ সামগ্রিক আলোচনা, প্রস্তাব, কর্মসূচি থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু অনুধাবন ও রপ্ত করার রয়েছে। দলিল-দস্তাবেজে বাংলাদেশ একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ বটে, কিন্তু এর প্রকৃতি ও কার্যক্রম নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত, সম্মেলনে গৃহীত চার দফা প্রস্তাব ও পাঁচ দফা কর্মসূচির পর্যালোচনা করে এখানে বাংলাদেশের যে ঘাটতিগুলো রয়েছে তা পূরণ করার ক্ষেত্রে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। তা না হলে এত বড় সম্মেলন থেকে আমাদের আত্মশুধরানোর কোনো সুযোগ হবে না। সম্মেলন থেকে আমরা কিছু অর্জন করতে ব্যর্থ হব। তাতে এত বড় আয়োজন বাংলাদেশের জন্য নিষ্ফল হবে। স্মরণ করা যেতে পারে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে সংগঠনের রোম সম্মেলন থেকে এর সদস্যভুক্ত হয়। পাঁচ দিনব্যাপী এবারের সম্মেলনে ১৩২ দেশের ৪৫ জন স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ সদস্যসহ মোট এক হাজার ৩৪৮ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
সম্মেলনে অনুষ্ঠিত আলোচনায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে সদস্য দেশগুলোর কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, এই সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি শোচনীয়। স্বাধীনতার পর থেকেই সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ধরে দেশের রাজনীতির অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল। তবে এ যাত্রা বারবার বিপদগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল প্রধানত ক্ষমতাসীন দলগুলোর গণতন্ত্র চর্চার সঙ্কট, রাজনীতিবিদদের অগণতান্ত্রিক আচরণ, অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, ক্ষমতার লোভ প্রভৃতি বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কলুষিত করেছে। এই কলুষিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার অমসৃণ পথচলাকে দেশের জনগণ সব সময় নিরীহ দর্শকের মতো দেখে যাচ্ছে। এসব কারণেই বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতি পুনরুজ্জীবনের পর দুই যুগ কেটে গেলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায়, সব সরকারই অধিকার সীমিত করতে আইনি ও আইনবহির্ভূত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। নির্বাচন তথা জনগণের ভোটদানের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া জবাবদিহিতার বিষয়টি সব সময়ই মরীচিকার মতো ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এসব অন্তরায় অবশ্যই ক্ষতিকর।
শুধু এসব সমস্যাই নয়, গণতন্ত্রের যে মূল চেতনাÑ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তাকেও ধ্বংস করা হয়েছে। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে সরকারের মালিকানাধীন চারটি পত্রিকা রাখা হয়েছিল। এসব পত্রিকায় কেবল ক্ষমতাসীনদের প্রচারমূলক সংবাদ ছাপা হতো। জনগণের মানবাধিকার রহিত করা হয়। সভা-সমাবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশে দুই দফা সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে, রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ জারি হয়েছে। এসব কার্যক্রম ছিল গণতন্ত্রবিরোধী। এ ছাড়া সংসদ আরো আঘাতের মুখোমুখি হয়েছে। একাধিকবার সংসদ তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে দেয়া হয়েছে। সম্মেলনে বৈধ সরকারের ওপর কোনো বেআইনি হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুই দফা সামরিক শাসন জারি করে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব বিষয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মেলনে তোলা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি।
বিতর্কিত বর্তমান দশম সংসদের নাজুক অবস্থা এক গবেষণাপত্রে তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমান সংসদে কোরাম সঙ্কটে মোট ব্যয়িত সময়ের পরিমাণ ছিল ১২ শতাংশ। কোরাম সঙ্কটে মোট ৪৮ ঘণ্টা ২৬ মিনিট বেশি ব্যয় হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ৪৭ কোটি ২০ লাখ ৩৩ হাজার ২০৪ টাকা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। জরিপে বলা হয়েছে, বিভিন্ন আলোচনা পর্বে সংসদীয় আচরণবিধি লঙ্ঘন করে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে, যা মোট ব্যয়িত সময়ের ১৫ শতাংশ। অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার বন্ধে স্পিকারের কার্যকর ভূমিকায় ঘাটতি রয়েছে। সংসদে আইন প্রণয়নে মোট অধিবেশনের সময়ের মাত্র ১৬ শতাংশ ব্যয়িত হয়েছে বলে জরিপে এসেছে। জরিপ অনুযায়ী, সংসদীয় কমিটিগুলোর প্রতি মাসে একটি করে বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। সংসদের বাইরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ে দুই হাজার ১০১ বার আর সংসদের ভেতরের প্রতিপক্ষকে নিয়ে ৪৩৩ বার বিভিন্ন কটূক্তি ও আক্রমণাত্মক শব্দ ও অশ্লীল শব্দের ব্যবহার হয়। বিধি অনুযায়ী, অধিবেশন চলাকালে শৃঙ্খলা রক্ষা করার ক্ষেত্রে স্পিকারের কার্যকর ভূমিকার ঘাটতি রয়েছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, সংসদীয় কমিটিতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, বিধি অনুযায়ী কমিটির সভা না হওয়া, কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের সময়সীমা, বাধ্যবাধকতা না থাকা এবং সদস্যের কার্যবিবরণী ও কমিটি প্রতিবেদনগুলোর উন্মুক্ততা এবং অভিগম্যতার ঘাটতি ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ লক্ষণীয়। এ ছাড়া কমিটির সভাপতি ও সদস্য নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রভাব এবং কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে। কমিটি সদস্য নির্বাচনের সময় তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা দেখা হয় না। কমিটি সভাপতি ও সদস্য নির্বাচনে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় সরকারি দলের এবং দলীয় প্রধানের প্রাধান্য লক্ষণীয়। দেশ-বিদেশে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর বিস্তারিত সংসদে আলোচনা না হওয়া সংসদীয় কার্যক্রমের পরিপন্থী। সংসদ অধিকতর কার্যকর করতে ও সংসদে জনগণের দৃশ্যমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে বিরোধী দলের স্পষ্ট অবস্থান, কমিটিগুলোর সুপারিশ আমলে নেয়া ও সংসদের ওপর সরকারের আধিপত্য হ্রাস করা উচিত। টিআইবির পর্যবেক্ষণ থেকে যা দৃশ্যমান হচ্ছে, তাতে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের হাল অবস্থাগুলো জানা গেল। এসব দুর্বলতা নিয়েই আইপিইউ সম্মেলনে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ।
বিভিন্ন গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সঙ্কটের ক্ষেত্রে কয়েকটি সূচক নির্ধারিত হয়েছে। যেমনÑ ক. প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের অনুপস্থিতি, খ. উচ্চমাত্রার দুর্নীতি, গ. জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি, ঘ. গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতি; ঙ. নাগরিক অধিকার পরিস্থিতির দুর্বলতা; চ. গণতান্ত্রিক আচরণের অনুপস্থিতি; ছ. আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা। দেশের রাজনীতি কখনোই ঐকমত্যের জায়গায় পৌঁছতে পারেনি। সর্বশেষ জাতীয় সংসদের নির্বাচন যেভাবে হয়েছে। সেই তথাকথিত নির্বাচনে বিজয়ী পক্ষের কোনো অনুতাপ নেই। পরিস্থিতি পাল্টানোর কোনো অভিপ্রায়ও লক্ষ করা যায়নি। তারাই এখন দেশ চালাচ্ছেন।
দেশে এত বড় আন্তঃসংসদীয় সম্মেলন হলো। কিন্তু সেই সম্মেলনে বাংলাদেশের কেউই বললেন না যে, অতীতের মতো বাংলাদেশে এখনো সংসদীয় গণতন্ত্র সঙ্কটের মুখোমুখি। সংসদীয় গণতন্ত্রকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়েছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষমভাবে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অপারগতা। যে কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদ তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সমর্থ হচ্ছে না। জাতীয় সংসদের গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক হিসেবে স্পিকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, বিরোধী দলের সংসদ বর্জন অথবা সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থতা, সরকারি দলের কর্তৃত্বের মনোভাব এবং নির্বাচন কমিশনের যথাযথ ভূমিকা পালনে অসামর্থ্যতা। এই চিহ্নিত ব্যর্থতাগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা রক্ষায় বাধাগ্রস্ত করছে। যা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানিকীকরণে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগ, রাজনৈতিক সংগঠন, সমাবেশ, প্রচারণা ইত্যাদি রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে এসব অধিকার স্বীকৃত। আর এই সাংবিধানিক অধিকার পালন করতে গিয়ে নাগরিক জীবনের জন্য হুমকির পরিবেশ সৃষ্টি হোক, সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ কথাও ঠিক যে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যেসব অধিকারের নিশ্চয়তা সংবিধানে রয়েছে তা পালনে বিরোধী দলগুলো অহরহ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তা ছাড়া স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত অনেক জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন নানা দোষে দুষ্ট। নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বড় দলগুলোর টানাপড়েন, অপপ্রচার, কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার নির্বাচনপ্রক্রিয়া এতটাই কলুষিত করেছে যে কোথাও জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটছে না।
সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ায় নির্বাচনে পরাজয় বরণকারী শক্তি ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। এমন পরিস্থিতিতে পাঁচ বছর অন্তর অনুষ্ঠিত নির্বাচন ভোটারদের কাছে শাসক দলের জবাবদিহির কার্যকর প্রতিষ্ঠান সংসদকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
সংসদীয় ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সব ক্ষেত্রেই এর বিশেষ গুরুত্ব থাকা দরকার। কিন্তু সংসদের অকার্যকারিতার ফলে সংবাদমাধ্যমেও সংসদ হয়ে পড়েছে গুরুত্বহীন। এতে সংবাদমাধ্যমে জনগণ জানতে পারছে না সংসদে কী হচ্ছে। তাদের প্রতিনিধিরা তাদের স্বার্থে কী করছেন। চলতি দশম সংসদেও চূড়ান্তভাবে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে আছে। কোনো বিরোধী দল না থাকায় সংসদে সরকারের জবাবদিহিতা নেই। এক সময় জাতীয় দৈনিকগুলোতে নিয়মিত সংসদের কার্যক্রমের সারসংক্ষেপ প্রকাশিত হতো। চলতি সংসদসহ বিগত কয়েকটি সংসদ যেমন নিয়মরক্ষার জন্য অধিবেশনে মিলিত হয়েছে, তেমনি সংবাদপত্রগুলো মাঝে মধ্যে কিছু প্রকাশ করে সংসদের অস্তিত্ব জানান দেয়। সংসদের এই হালের মধ্য দিয়েই ঢাকায় আন্তঃসংসদীয় সম্মেলন হয়ে গেল। এই সম্মেলন হওয়ায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের দায়িত্ব অনেক বেড়েছে; কিন্তু তার সূচনা ও প্রস্তুতি তো দৃশ্যমান হতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক সমাজের জন্য একটি অঙ্গীকার আসতে হবে। আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে এখন বাংলাদেশ এটি দেশের জন্য মর্যাদার বিষয়, সাথে সাথে বাংলাদেশের দায়িত্বও বেড়েছে। এই ইউনিয়নের যে সম্মেলন হয়ে গেল তার সিদ্ধান্ত এবং যে প্রস্তাবগুলো নেয়া হয়েছে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে ঘাটতিগুলো রয়েছে তা পূরণ করা এখন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। একটি প্রবাদ এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’। বাংলাদেশ প্রথমে নিজে কাজগুলো করে অন্য সদস্যদেশকে এ নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। তার আগে নয়। বাংলাদেশ যদি এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা না রাখে তবে সব আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের নেতৃত্ব নিয়ে কথা উঠবে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মানবাধিকার পরিস্থিতি শোচনীয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানবাধিকার অনেকটাই রুগ্ণ আর অপ্রতিষ্ঠিত একটি বিষয়। কিন্তু আইপিইউ সম্মেলন থেকে এবার সব সদস্য দেশকে মানবাধিকার সংরক্ষণ করার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার আকাক্সিত মাত্রার চেয়ে যোজন যোজন দূরে বললেও ভুল করা হবে না। বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং কিছু বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের অবস্থান অনেকটা নড়বড়ে এবং তাদের কার্যক্রম এরই মধ্যে বেশ কিছু বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। যদিও সাংগঠনিকভাবেই এই কমিশন যথেষ্ট দুর্বল। প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী সময়ে ভালো কিছু উদ্যোগের জন্য প্রশংসিত হয়েছিল কমিশন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্তে দ্বিমুখী অবস্থানের জন্য বিতর্কিত হয়। বেসরকারি যেসব সংস্থা কাজ করছে, তাদের কাজ অপ্রতুল ও চাপের মুখে। তার পরও তারা প্রশংসাযোগ্য কিছু কাজ করেছে, বিশেষ করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় শক্ত অবস্থান গ্রহণ। তবে প্রায়োগিক অর্থে তারা অনেকটাই সফল, এমন কথা বলা যায় না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলো, অধিকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং আরো কিছু সংস্থা বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছে।
বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রশ্নটি এলে স্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টি চলে আসে কতগুলো বিষয়ের ওপর। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বা সমালোচিত বিষয় হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে অহরহ। তাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করা তাদের মৌলিক মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু তা লঙ্ঘিত হচ্ছে। আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব যথাযথ কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এই বিধান সরকারবিরোধীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে না। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এখন হয়রানিমূলক মামলা ও জেল-জুলুম করা হচ্ছে। এভাবে গণতন্ত্র ও সংসদীয় ব্যবস্থা সচল হতে পারবে না।
আইপিইউ সম্মেলন নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার অভিমত হচ্ছে, দেশে একদলীয় নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ সর্বোত্তম সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। দেশে মানবাধিকার পুরোপুরি ভূলুণ্ঠিত। বর্তমান সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। গুম, খুন, গ্রেফতার, রাজনৈতিক মিথ্যা মামলায় জনগণের নির্বাচিত বর্তমান ও সাবেক প্রতিনিধিরা জর্জরিত। তাই আইপিইউ সম্মেলন প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন। বিএনপির পক্ষ থেকে এই সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, সংসদে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নেই। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বকারী সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সংসদীয় রাজনীতির এই মহাসম্মেলনে বাংলাদেশের জনগণের প্রকৃত কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। সংসদ সদস্য নামে যারা এই সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করছেন, তারা সবাই ভুতুড়ে ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
আইপিইউর সদ্যসমাপ্ত সম্মেলন যে বার্তা রেখে গেল, তার প্রধান বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে বৈষম্য দূর করা, রাজনীতিকে কালো টাকামুক্ত রাখা, মানবাধিকার সুরক্ষা করা। আগামীতে এই বার্তা স্মরণে রেখে বাংলাদেশকে অগ্রসর হতে হবে। বাংলাদেশ এই ফোরামের নেতৃত্ব পেয়েছে। এখন এর গুরুত্ব উপলব্ধি এবং সেই আলোকে প্রতিবন্ধকতাগুলোর সুরাহা করা জরুরি। যে বার্তা পাওয়া গেছে তাকে সফল করতে সরকারের একলা চলো নীতি কার্যকর হবে না। বৃহত্তর ঐক্যের মাধ্যমে চিহ্নিত দুর্বলতাগুলো দূর করে দেশের রাজনৈতিক জীবনে যে নেতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার পরিবর্তন করতে হবে। এ জন্য একচ্ছত্র কর্তৃত্ব করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে সহযোগিতা সৌহার্দ্যরে পথ রচনা করতে হবে।
আরেকটি বিষয় এখন উল্লেখ করা প্রয়োজন, সম্মেলনে বাংলাদেশের যে প্রতিনিধিদল ছিল একান্তভাবে সরকারি দলের। বিরোধী দলের কোনো প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল না। এমন একটি সম্মেলনে স্বাগতিক দেশের বিরোধী দলের কোনো প্রতিনিধিত্ব না থাকা অবশ্যই সৌন্দর্যের জন্য হানিকর। দশ বছর ধরে বস্তুত বাংলাদেশের সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই। এটি নিশ্চিত যে, সম্মেলনে আগত অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিরা স্বাগতিক দেশের কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি স্বাভাবিকভাবে নেননি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/212615