১৬ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৮:২৩

থমকে গেছে বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি

বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ (সোলার হোম সিস্টেম) কর্মসূচির অগ্রগতি থমকে গেছে। একসময় প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের সংযোগ স্থাপন করা হলেও এখন তা আট হাজারে নেমে এসেছে।
এই অবস্থার জন্য মূলত তিনটি কারণ দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সংযোগের সম্প্রসারণ, দুর্নীতির কারণে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির (কাবিখা) অধীনে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন বন্ধ এবং খোলাবাজারে নিম্নমানের প্যানেল।
বাড়িভিত্তিক সৌর বিদ্যুতের কর্মসূচি দেশের প্রত্যন্ত এলাকার বিদ্যুৎ-সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর রাতের আঁধারকে আলো ঝলমল করেছে। এটি পৃথিবীর অন্যতম দ্রুত সম্প্রসারণশীল সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি হিসেবেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এই কর্মসূচির অধীনে ইতিমধ্যে প্রায় ৪১ লাখ বাড়ি সৌরবিদ্যুতের আওতায় এসেছে। প্রায় দুই কোটি মানুষ এই বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছেন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ।
সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচির সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে সরকারি মালিকানাধীন ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)’। ইডকলের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে প্রায় অর্ধশত বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) তালিকাভুক্ত ‘অংশীদার সংগঠন (পিও)’ হিসেবে মাঠপর্যায়ে এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে শুরু থেকে কাজ করেছে।
কর্মসূচির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ইডকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ মালিক প্রথম আলোকে বলেন, গ্রিডের সম্প্রসারণ তো এর অন্যতম কারণ বটেই। তবে গ্রিড সম্প্রসারণ তো হবেই। এ ছাড়া কিছু বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় কর্মসূচির অগ্রযাত্রা থমকে গেছে। তাঁরা চেষ্টা করছেন এ অবস্থা থেকে কর্মসূচিকে বের করে আনতে। তিনি বলেন, কর্মসূচির বিশৃঙ্খলা নিরসনের জন্য এখন পিওদের এলাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাঁরা এখন জোর দিচ্ছেন দ্বীপাঞ্চলের মতো বিচ্ছিন্ন এলাকায় সৌরবিদ্যুতের ক্ষুদ্র (মিনি) গ্রিড স্থাপন এবং সৌরবিদ্যুচ্চালিত সেচ পাম্পের ব্যবহার বাড়ানোর ওপর। এখন পর্যন্ত নয়টি ক্ষুদ্র গ্রিড চালুও হয়েছে। ২৫টি বাস্তবায়নাধীন। আর চলতি বোরো মৌসুমে সৌরবিদ্যুচ্চালিত সেচ পাম্প চলছে ৬০০-এর বেশি।
বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি সরকারিভাবে শুরু হয় ২০০৩ সালে। তখন লক্ষ্য ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার বাড়িকে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা। কিন্তু তিন বছরেই সে লক্ষ্য অর্জিত হয়। এরপর দ্রুত বাড়তে থাকে এর চাহিদা। সৌরবিদ্যুতে পড়াশোনা, টেলিভিশন দেখা, নৈশ বিদ্যালয় চালানো, গ্রামীণ হাটবাজারে অনেক রাত পর্যন্ত কেনাবেচা সম্ভব হওয়ায় মানুষের জীবনধারায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের ওপর একটি গবেষণা চালায়। তাতে বলা হয়, দেশে প্রায় এক কোটি বাড়িতে এই ব্যবস্থা স্থাপনের সুযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় কর্মসূচি আরও দ্রুত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয় ইডকল।
থমকে যাওয়ার তিন কারণ
বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচি থমকে যাওয়ার অন্যতম কারণ ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব বাড়ি বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনার সরকারি পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো, বিশেষ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সংযোগ সম্প্রসারণ করছে। আরইবি গ্রামাঞ্চলে প্রতি মাসে গড়ে তিন লাখ নতুন সংযোগ দিতে থাকে। এতে এমন অনেক এলাকা গ্রিডের বিদ্যুতের আওতায় আসে, যেখানে বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচির আওতায় আনার কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল। গ্রিডের বিদ্যুৎ যাওয়ায় সেখানকার মানুষ সৌরবিদ্যুৎ নিচ্ছেন না।
দ্বিতীয়ত, সরকার একপর্যায়ে বাড়িভিত্তিক সৌর বিদ্যুতের সম্প্রসারণ দ্রুততর করতে এই কর্মসূচিকে কাবিখার সঙ্গে যুক্ত করেছিল। এতে কাবিখার বরাদ্দের একাংশ দিয়ে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল কিনে বিদ্যুৎবিহীন বাড়িতে স্থাপনের বিধান করা হয়। এই কার্যক্রমের দায়িত্ব ছিল জনপ্রতিনিধিদের ওপর। এই উদ্যোগের মাধ্যমে যেসব প্যানেল গ্রাহকদের দেওয়া হয়, তার প্রায় সবই নিম্নমানের। এ ছাড়া গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ নেওয়ার অভিযোগও ওঠে। ফলে মানুষ সৌর বিদ্যুতের বিষয়ে আগ্রহ হারায়। শেষ পর্যন্ত সরকার এই কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়। এতেও কর্মসূচির গতি শ্লথ হয়।
তৃতীয়ত, বাড়িভিত্তিক সৌর বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় কিছু ব্যবসায়ী নিম্নমানের প্যানেল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করেন। নিম্নমানের প্যানেল এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গ্যারান্টি না পাওয়ায় আগ্রহী মানুষেরাও সৌরবিদ্যুতে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। ফলে খোলাবাজারে প্যানেল বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে, বর্তমানে ইডকলের তত্ত্বাবধানে যেসব প্যানেল স্থাপন করা হচ্ছে, তাতেও শর্ত হিসেবে প্রি-পেইড মিটার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করার সরকারি পরিকল্পনার ব্যাপক প্রচার হচ্ছে। ফলে বাড়িভিত্তিক সৌরবিদ্যুতে কত গ্রাহক আকৃষ্ট হবেন, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1146801/