বামে : আঙ্গরপোতা-দহগ্রামের যাতায়াত পথ (গোলচিহ্নিত) তিনবিঘা করিডোর ও ডানে : অমীমাংসিত মুহরির চর -ফাইল ফটো
১৬ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৮:১৬

ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য আসছে না উপেক্ষিতই থাকছে বাংলাদেশের স্বার্থ

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহুল অলোচিত সদ্য ভারত সফরের ফলাফল নিয়ে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। পাওয়া না পাওয়ার বিতর্কে জড়িয়েছে সরকারিজোট বনাম বিরোধীজোট। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই বিতর্কের ক্ষেত্রে নিট হিসেব হলো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে কোনভাবেই ভারসাম্য আসছে না। আর এতে বরাবর উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বার্থ। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত দিকগুলো নিয়ে স্পর্শকাতর অবস্থানে থাকায় বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়গুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা।
ভাষ্যকারদের মতে, ভারতীয় চাহিদাগুলো একের পর এক পূরণ হয়ে চলতে থাকলেও কোন না কোন অজুহাতে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ঝুলে থাকছে। ইতোমধ্যে হিমঘরে চলে যেতে বসেছে তিস্তার পানি বণ্টন, মুহুরীর চর ও তিনবিঘা করিডোর ইস্যুর সঙ্গে গঙ্গা ব্যারেজ ও রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ পুরনো অনেক বিষয়। বাণিজ্যক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা অব্যাহত থাকা, সীমান্তে বাংলাদেশীদের নির্মম হত্যাকাণ্ড চলতে থাকা, বিনা শুল্কে অথবা নামমাত্র শুল্কে একতরফা ট্রানজিট নেয়ার জন্য পরোক্ষ চাপ প্রয়োগ, সীমান্ত দিয়ে দেদারছে অবৈধ মাদকদ্রব্য ও অস্ত্রপাচার প্রভৃতিও রয়েছে। সরকারি পক্ষ বলছে, ভারতের কাছে কিছু চাইতে যাইনি, বন্ধুত্ব চেয়ে পেয়েছি। এর উত্তরে বিরোধীরা বলছে, আসলে সবই দিয়ে আসা হয়েছে, বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। বাংলাদেশের দাবি ও প্রয়োজনগুলোকে এযাবৎ কোন অগ্রাধিকার না দেয়ায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য আসছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে একতরফাভাবে কেবল ভারতের দাবিগুলোই পূরণ হয়ে চলেছে বলে ভাষ্যকারদের অভিমত। পুরাতন ও ঝুলে থাকা বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প। বিশ্লেষকরা বরাবরই জোর দিয়ে বলে আসছেন, সমতার ভিত্তিতে সমস্যাসমূহের সমাধানই হচ্ছে দু’দেশের স্বাভাবিক সম্পর্কের চাবিকাঠি।
অভিন্ন নদীর পানি সম্পর্কের বড় নিয়ামক : শেখ হাসিনা
ভারত সফরকালে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের দেয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিস্তা চুক্তি সই হলে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন রূপান্তরের নতুন পর্যায় অতিক্রম করবে। অভিন্ন নদীর পানির ভাগাভাগি দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতির বড় নিয়ামক।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য অনেকাংশেই সত্য হলেও ভারতের কাছ থেকে সে মোতাবেক সাড়া মেলেনি। গঙ্গার পানি নিয়ে একটা চুক্তি হলেও খরা মওসুমে দাবিকৃত পানি মিলছে না। প্রতিবছরই পানি না পাওয়ার চিত্র বিস্তৃত হচ্ছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি জমা হতে না দেয়ার ফলে বাংলাদেশে প্রয়োজন পরিমাণ দূরের কথা, ন্যূনতম পানিও পদ্মায় আসতে পারছে না। ফলে এই চুক্তি একটা ‘নাম কা ওয়াস্তে’ চুক্তিতে পরিণত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। অন্যদিকে তিস্তা নিয়ে মহাসমারোহে প্রচারণা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ‘মমতা প্যারাডক্স’-এর কাছে পরাজিত হলো। মমতাকে সামনে দাঁড় করিয়ে তিস্তাকে ঝুলিয়ে দেয়ার মধ্যে কেউ কেউ নাটকের দৃশ্য খুঁজছেন। জিয়াউর রহমানের আমলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু গঙ্গার পানি বাংলাদেশকে দিতে বাধা দিয়েও সফল হননি। তাহলে কি মমতা সফল হলেন? অন্যদিকে বরাক নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও কোন আলোচনা থেমে গেছে। এই প্রকল্প বন্ধের বিষয়ে ভারতীয় পক্ষ থেকে কোন ঘোষণা এযাবৎ পাওয়া যায়নি। বলা বাহুল্য, গঙ্গা-সংকটের কারণে বাংলাদেশের পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চল, তিস্তা-মহানন্দায় উত্তরাঞ্চল এবং টিপাইমুখের কারণে পূর্বাঞ্চলের সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে। শুধু ফারাক্কা নয়, সব অভিন্ন নদীতেই বাঁধসহ অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করে চলেছে ভারত। এর উদ্দেশ্য, পুরো পানি সম্পদকে তাদের অভ্যন্তরীণ সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যবহার করা। এই সঙ্গে যোগ হয়েছে বহুল আলোচিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। ভারত এই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এই কার্যক্রমের আওতায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বেসিনের ৩৭টি নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে এসব নদীর পানি ব্যাপকহারে প্রত্যাহার করে নেবে। এর ফলে ভাটির দেশ বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী পানিশূন্য হয়ে পড়বে। এই সর্বনাশা প্রকল্প নিয়ে দুই দেশের আলোচনার টেবিলে কোন আলোচনা উত্থাপনের প্রয়াস আদৌ দেখা যায়নি।
গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাতিল
এদিকে রাজবাড়ীর পাংশায় গঙ্গা ব্যারেজ করার যে প্রকল্প বাংলাদেশ গ্রহণ করেছিলো তা প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক বক্তব্য দেয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে তা প্রকাশ করেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি জানান, এখন বিকল্প খোঁজার জন্য শিগগিরই উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করে দেয়া হবে। পানিসম্পদমন্ত্রী বলেন, গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প পুনঃনিরীক্ষণ করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করবে, অন্য অপশন কী হতে পারে, তা দেখবে। এ কমিটি ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী যে পানি পাওয়া যাচ্ছে, সেটাও কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা দেখবে। পাংশায় গঙ্গা ব্যারেজ স্থাপনের প্রকল্প বাদ দেয়া হয়েছে কি না- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘ওটা পরিত্যক্ত বলতে পারেন। তিনি আরো বলেন, তবে গঙ্গা ব্যারেজ করা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কোথায়, কীভাবে করা হবে, সেটা নিয়েই হলো কথা। এ জন্যই বিকল্প ঠিক করার জন্য কমিটি করে দেয়া হচ্ছে। শিগগিরই এ কমিটি করা হবে।’ উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারত এই প্রকল্পের ব্যাপারে বরাবর আপত্তি জানিয়ে আসছিলো। গঙ্গা ব্যারেজ-এর স্থান নির্ধারণ এবং পদ্মার বর্তমান জীর্ণ দশায় এই প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়েও দেশের ভেতরে প্রশ্ন ছিলো। কিন্তু ভারত থেকে ঘুরে এসে এই প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা দেয়ায় এনিয়ে জনমনে খটকা লেগেছে। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি ভারতের আপত্তিই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে? প্রকল্প বাতিলের এই ঘোষণা আরো আগে কিংবা আরো পরেও তো দেয়া যেতো। এই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে গঙ্গা ব্যারেজের নতুন স্থান ও সম্ভাব্যতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার কথা বলা নিয়ে। প্রায় প্রতিটি অভিন্ন নদীতে যেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে কোন আলোচনা-সমঝোতা ছাড়াই ভারত উজানে একের এক প্রকল্প করে যাচ্ছে সেক্ষেত্রে ভাটিতে ‘গঙ্গা ব্যারেজ’-এর বেলায় কেন ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে সে জনমনে সে প্রশ্নও দানা বাঁধছে।
অপদখলে মুহুরীর চর
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলোচিত বিরোধপূর্ণ ভূমি মুহুরীর চর। পরশুরাম উপজেলার বিলোনীয়া সীমান্তে মুহুরী নদীর পাশে এ চরের অবস্থান। এর কর্তৃত্ব নিয়ে বহুবার বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে লড়াই হয়েছে। এ চর দখলে নিতে মরিয়া ভারত। কিন্তু এই ইস্যুটিও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে অনালোচিত ও অমীমাংসিত থেকে গেলো। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ঘোষণায় স্থান পায়নি এটি। উল্লেখ করা যেতে পারে, দীর্ঘদিনেও বিরোধপূর্ণ মুহুরীর চরের আড়াই কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করা যায়নি। ভারত এর ৬৬ একর জমি জবর দখলের মাধ্যমে ভোগ করে আসছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ জরিপ অধিদফতর-এ সীমানা চিহ্নিত করতে জরিপ পরিচালনা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। গত প্রায় দুই দশকে এই চর নিয়ে অসংখ্যবার দুই দেশের সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। হতাহতের ঘটনা ঘটেছে অনেক। বাংলাদেশের জমির মালিকদের জমি-সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র থাকলেও বিএসএফ-এর বাধার কারণে এসব জমিতে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। অপরদিকে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মুহুরী নদীতে ভারত স্পার ও গ্রোয়েন নির্মাণ করেছে। এর মাধ্যমে নদীর গতিধারাকে ভারত ক্রমান্বয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সুকৌশলে বিলোনীয়ার পাশে নিজ কালিকাপুর গ্রামের মুহুরী নদীর বাঁকে চরের অংশটি মূল চরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ কারণে ক্রমাগত উত্তর অংশে ভারতের দিকে চরের সৃষ্টি হয়ে নদীর মোহনা বাংলাদেশের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে। এছাড়া মুহুরী নদীর পাশে ভারত সীমান্তের ওপারে ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়া থেকে ৪০ ফুট প্রশস্ত নতুন সড়ক তৈরির কাজে সম্পন্ন করেছে। কৌশলে মুহুরীর চরের অধিকাংশ এলাকা ও তৎসংলগ্ন ভূভাগ নিজের এলাকাভুক্ত করে নিচ্ছে ভারত। ফলে পরশুরামের বিলোনীয়া ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছে। মুহুরির চর নিয়ে বিরোধ মীমাংসার জন্য দুই দেশের কর্মকর্তারা কয়েক দফা বৈঠক করলেও সমাধান আসেনি। বাংলাদেশের কাছে স্থল সীমান্ত চুক্তির আওতায় মুহুরির চর হস্তান্তরে আপত্তি জানিয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সরকার। পশ্চিমবঙ্গের মমতা সরকারের মতো এখানেও ত্রিপুরার সরকারের ডিঙ্গাতে চাচ্ছে না কেন্দ্রীয় সরকার।
আজো মেলেনি তিনবিঘা
১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ৭.৩৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দক্ষিণ বেরুবাড়ীর সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা ভারতের কাছে হস্তান্তর ঠিকই সম্পন্ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেরুবাড়ি ছেড়ে দিয়েও তিনবিঘা করিডোরের মালিকানা মেলেনি আজো। বাংলাদেশের দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় অবাধ চলাচলের জন্য ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৫৮ মিটার প্রস্থের তিনবিঘা করিডোর বাংলাদেশকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার চুক্তি রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জনৈক ব্যক্তির মামলার দোহাই দিয়ে এই তিনবিঘা বাংলাদেশকে হস্তান্তর করা হচ্ছে না। ২০১১ সালে তিনবিঘা করিডোর ২৪ ঘন্টার জন্য খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হলেও এর মালিকানা ও সার্বভৌমত্ব ভারতের হাতেই রেখে দেয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকরা স্বাধীনভাবে এই পথ ব্যবহার করতে পারেন না। ছিটমহলগুলো বিনিময়ের সময় ভারতের পার্লামেন্টে সীমান্ত বিল পাস হলেও এর আওতার বাইরে রাখা হয় তিন বিঘা। দুই দেশের মধ্যে অবিরাম বন্ধুত্ব রচনার কথা শোনা গেলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি অধরাই থেকে যাচ্ছে।
এশিয়ার মৃত্যু উপত্যকা
ভারতের কংগ্রেস সরকারের আমলে সীমান্তে বিএসএফ পাখির মতো মানুষ হত্যা করে। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়ানক আকার নেয় যে, বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক ব্রাড এ্যাডাম তাঁর এক প্রতিবেদনে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে ‘এশিয়ার মৃত্যু উপত্যকা’ বলে বর্ণনা করেন। তিনি বিএসএফকে ঠাণ্ডা মাথার খুনীও বলেন। এক রিপোর্টে বলা হয়, বিএসএফ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা, নির্যাতন এবং অপহরণ-অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানীকে খুব কাছ থেকে ঠাণ্ডামাথায় গুলী করে হত্যার ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী বেসামরিক লোক খুন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন ও মানবাধিকারের কোনো তোয়াক্কা করেনি তারা। সংশ্লিষ্টদের মতে, সীমান্ত অতিক্রম করছে বলে কাউকে মেরে ফেলার বিধান পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। সীমান্ত অতিক্রমের অপরাধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজ নিজ দেশের আইনের হাতে ন্যস্ত করাই হচ্ছে বিধান। দেখামাত্রই গুলী করে মেরে ফেলা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। কিন্তু বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হবার পরেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে মনে করছেন না পর্যবেক্ষকরা। এখনো প্রায়ই সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশীদের নিহত ও নির্যাতীত হওয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে।
ট্রানজিটের জন্য চাপ
ভারত তার ভূখণ্ডের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যাবার জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একটি ‘করিডোর’ পেতে দীর্ঘদিন থেকেই নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে আসছে। কিন্তু এই ‘করিডোর’কে আন্তর্জাতিক রূপ দেবার জন্য ‘ট্রানজিট’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ বিষয়ে অনেকটা এগিয়ে গেলেও বেশ কিছু প্রশ্নের এখনো সমাধান হয়নি। এসব প্রশ্নের সমাধান না করে তাড়াহুড়ো করে কিছু করা হলে তা ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেবার’ সামিল হবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। সুত্রগুলো বলছে, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিতে অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে রেলপথে ব্যয় হবে সবচেয়ে বেশী- প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। সড়কপথে ৯ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা, নৌপথে ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নে ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা, মংলা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ২ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন স্থলবন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হবে বাকি ৪৮৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে, ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ কি পাবে বা কত আয় হবে সে হিসাবও করা হয়নি। কোনো দেশই দরকষাকষি, অনুসন্ধান, মূল্যায়ন এবং নিরাপত্তাজনিত প্রস্তুতি ছাড়া এ ধরণের প্রকল্পে প্রবেশ করে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রমের সুযোগ নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল। কিন্তু বিষয়গুলো কেবল সুবিধাভোগী দেশের সুবিধা অনুযায়ীই করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
একতরফা ব্যবসা-বাণিজ্য
ভারতের একতরফা ব্যবসা-বাণিজ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে দাঁড়াতেই দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ আছে। যা ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অবিশ্বাস বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে আমদানী-রফতানীর তারতম্য প্রায় ১৫০ গুণ। দু’দেশের মধ্যে এই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি এক ব্যাপক ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ভারতের কাছে বাংলাদেশ বাণিজ্য সুবিধা, বিশেষ করে সে দেশের বাজারে পণ্যের প্রবেশাধিকার চাইলে ভারত জুড়ে দেয় নানা শর্ত। বাংলাদেশ অবশ্য শর্ত মেনেও নেয়। কিন্তু ভারত তার ওয়াদা আর রক্ষা করে না। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশকে শর্ত দেয় যে, ৬১ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে রেল ও সড়ক ট্রানজিট দিতে হবে। ভারত চাইছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ)। আর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলে ভারতের জন্য বাংলাদেশের বাজার একেবারেই উন্মুক্ত হয়ে যাবে। অপরদিকে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মুখে পড়বে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের পাট, বস্ত্র তথা তৈরি পোশাক শিল্প ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশের কাঁচাপাট দিয়ে ভারতের শিল্প চলে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য নানা চক্রান্ত চলছে বলে অভিযোগ আছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশী পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনেক বাধা সৃষ্টি করে রাখা হচ্ছে। শুল্ক-অশুল্ক বাধার পাশাপাশি পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বিরাট একখানা সেনসেটিভ লিস্ট ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে বাংলাদেশের সামনে। তবে ভারতীয় পণ্যের বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে এমন বাধা নেই। ভারতীয় পণ্যের জন্য বাংলাদেশের বাজার উন্মুক্ত হয়ে থাকছে।
অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান
বাংলাদেশে অবৈধ মাদক ও অস্ত্রের প্রধান অনুপ্রবেশস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত। বিভিন্ন সময় দু’দেশের সীমান্ত বৈঠকে এনিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হলেও এই পাচার তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদক এবং দেশীয় অস্ত্র চোরাচালানের সাথে জড়িত রয়েছে কয়েকশ’ চোরাকারবারী। শুধু বাংলাদেশে ফেনসিডিল পাচার করার জন্য ভারত সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ফেনসিডিল কারখানা। বিএসএফের হাতে কখনো কোন মাদক ব্যবসায়ী গুলীবিদ্ধ হওয়ার তথ্য নেই কারো কাছেই। দেশে বেশিরভাগ মাদকই আসে বেনাপোল, যশোরের হরিদাসপুর, সাতক্ষীরার তালা ও কলারোয়া, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ এলাকা, কুষ্টিয়ার জীবননগর, কুমিল্লার আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, দিনাজপুরের হিলি, কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী ও সিলেটের জাফলং দিয়ে। বর্তমানে দেশে ৩২ ধরনের মাদক পাওয়া যায়। মাদক ছাড়াও সীমান্ত ডিঙিয়ে অবাধে আসছে বেআইনি অস্ত্র। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশের ১৮টি জেলার ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অস্ত্র আমদানী ঘটে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুযোগে সীমান্ত পয়েন্টগুলো দিয়ে অবাধে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আসার সুযোগ পায়। হাতবোমা, চকলেট বোমা, টু-টু বোর, রিভলবারের চালান আসে মুড়ি-মুড়কির মতো। আরজিএস গ্রেনেড, একে-৪৭ রাইফেল, নাইন এমএমের মতো মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্রও অবাধে ঢুকে পড়ছে।
রামপাল প্রকল্প
দেশের ভেতরে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠতে থাকলেও ভারতের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা-পর্যালোচনার জন্য টেবিলে রাখা হয়নি। এসংক্রান্ত প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়ে কোন বিতর্ক থাকার কথা নয়। কিন্তু তা যখন দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হয় তবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। এমনই এক প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক প্রবল হয়েছে। আর এর সঙ্গেও ভারতের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সুন্দরবনের নিকটবর্তী রামপালে এই প্রকল্প হওয়ার বিষয় পাকাপোক্ত হওয়ায় দ্বিবিধ প্রশ্ন উঠেছে। একদিকে পরিবেশগত সংকট অন্যদিকে বিদ্যুতের মূল্য বাংলাদেশের জন্য বিপুল বোঝা হয়ে দাঁড়ানোর জন্য। বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের কোন টানাপড়েন না থাকলেও এর ক্ষতিকারক দিক বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয়কর হবার আশংকায় তা আলোচনায় উঠে আসছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

http://www.dailysangram.com/post/279936-