১৬ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৮:১১

অর্জনে-বিসর্জনে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর

|| সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা || প্রধানমন্ত্রীর সদ্য সমাপ্ত ভারত সফর, প্রতিরক্ষা সহ বিভিন্ন বিষয়ে অজ্ঞাত সংখ্যক চুক্তি-সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অর্জন-বিসর্জন নিয়ে বেশ কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। কৌতুহল এ জন্যই বলছি যে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত প্রায় সকল চুক্তির বিষয়বস্তুই অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। তাই কানাঘুষার ডালপালাটা বেশ দীর্ঘ হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফর এবং সফরকালে বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বিষয়েও জনগণ কিন্তু এখনও অনেকটাই অন্ধকারেই রয়ে গেছেন। গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত অস্পষ্ট ধারণাটাই শুধু তাদের পুঁজি।
মূলত আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তির আগে সংশ্লিষ্ট দেশের সংসদে আলোচনা হওয়ার কথা। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এই ট্রাডিশন অনুসরণ করা হয়। কিন্তু আমরাই বুঝি এর ব্যতিক্রম। বিষয়টি সংসদে আলোচনা তো দূরের কথা সরকারি দলের শীর্ষনেতাদের অনেকেই ছিলেন এ বিষয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য থেকে এমনটিই মনে করা যায়। আর সরকার তো এ বিষয়ে জনগণের মতামতের কোন তোয়াক্কায় করেনি। যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজে বিরল ঘটনাই বলতে হবে।
ভারত প্রাদেশিক সরকারের আপত্তির কারণে তিস্তা চুক্তি করতে পারেনি বলে ফলাও করে প্রচার করছে। যতদোষ মমতার ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা দায়মুক্ত থাকার চেষ্টা করছেন। যদিও তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তরিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন বোদ্ধামহল। তারা মনে করেন, কেন্দ্রীয় সরকারই মমতাকে দিয়ে খেলছেন। যাহোক দৃশ্যত মনে হচ্ছে, মমতার আপত্তির কারণেই আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে কোন প্রকার অর্জন ছাড়াই দেশে ফিরতে হয়েছে। অথচ সরকার সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, উদ্বেগ-উৎকন্ঠাকে উপেক্ষা এবং দেশের সকল শ্রেণির মানুষকে অন্ধকারে রেখে প্রতিরক্ষা চুক্তির মত স্পর্শকাতর চুক্তি করে ফেললো-তার গ্রহণযোগ্যতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় স্বাভাবিক। মূলত অন্ধকারে আর প্রাসাদ অভ্যন্তরে যা সংঘঠিত হয় তা কখনো ইতিবাচক হওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না। ইতিবাচক হলে তা তো জনসমক্ষেই করা হতো। যেহেতু তা একতরফা এবং বিশেষ পক্ষকে আনুকল্য দেয়ার জন্য তাই বিষয়টি নিয়ে দেশের মানুষকে পরিকল্পিতভাবেই অন্ধকারের রাখা হয়েছে। এ নিয়ে কোন সন্দেহ করা চলে না।
যদিও সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সফরে মাল্টিসেক্টরাল বা বহুমুখী সহযোগিতায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতাকে একটি কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা, সাইবার সিকিউরিটি, সিভিল নিউক্লিয়ার বা বেসামরিক পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহার এবং মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহযোগিতার বিষয়টি। উল্লিখিত চারটি খাতে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে সহযোগিতায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে বলা হচেছ, বিষয়টি নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন শীর্ষ বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। চুক্তিটি সম্পাদনে দ্রুত ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে নতুন অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তারা ভাবছেন, এখন বিষয়টির আশু সমাধান ভারতের ঘাড়েই বর্তে থাকলো। সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে সরকার পক্ষের বক্তব্য হলো, হত্যা বন্ধে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। যা তাদের যুক্ত বিবৃতিতে স্থান পেয়েছে। সীমান্ত হত্যার ঘটনা এড়ানোর জন্য শীর্ষ নেতৃত্ব কাজ করবেন বলেও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এ সফরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৈষম্য নিরসনে আলোচনার দ্বার খুলেছে উল্লেখ করে বলা হয়, এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার পাওয়া গেছে। তাই তারা মনে করছেন, যে কোনো সংকট বা সমস্যার সমাধান রাতারাতি বা একদিনে আসবে না। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সমস্যা বা সংকট সমাধানে উভয়ের পক্ষ থেকে যে আন্তরিকতা দেখানো হয়েছে, আলোচনার দ্বার খোলা হয়েছে। এটি আমাদের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসবে বলেও আমার বিশ্বাস।
বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীনতার ৪ দশকেরও অধিককাল ধরে ভারতে শুধু বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখিয়েই আসছে। কিন্তু উল্লেখ করার মত আমরা কিছুই পায়নি। তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের কথা ছিল বিগত কংগ্রেস সরকারের আমলে। কিন্তু বিজিপি সরকারের মেয়াদও প্রায় শেষ হতে চলেছে কিন্তু ভারত এখনো কথামালার ফুলঝুড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে আবারও প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হলো। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মত কোন কিছু আমরা এখনো দেখতে পাচিছ না। সরকার সংশ্লিষ্টরা তিস্তাচুক্তি নিয়ে তাড়াহুড়ার দরকার নেই বললেও অতি তড়িঘড়ি করে জনগণকে অন্ধকারে রেখে অন্যসবচুক্তি করা হলো তাদের কাছে এর কোন সদুত্তর আছে বলে মনে হয় না। ভারতের অনুকূলে চুক্তিগুলো কেন বিদ্যুৎগতিতে করা হলো সে প্রশ্ন তো এখন সকল শ্রেণির মানুষের মুখে মুখে। আর তিস্তাচুক্তিকে কেনই বা ট্রামকার্ড হিসাবে ব্যবহার করা হলো না?
আমরা তিস্তার পানির নায্য হিস্যা আদায় করতে পারিনি কিন্তু দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সাথে সাংঘর্ষিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করে বসলাম। মূলত বিষয়টি আমাদের দেশের রাজনীতির দেউলিয়াপনা ছাড়া কিছু নয়। সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদার চেয়ে ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার কলাকৌশল যদি দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয় তাহলে সে রাজনীতি কখনো গণমানুষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। মূলত আমাদের এই দুর্বলতার সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। আসলে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে কয়টি চুক্তি ও কয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে তার সঠিক হিসাব এখনো মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। চুক্তির ভেতরে কি আছে তাও অজানা। তবে এ চুক্তি-সমঝোতা দেশের ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা বোঝা যায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে তারা এর কোন প্রতিবাদও করতে পারছে না।
মূলত প্রতিবেশী দেশ ভারতের বন্ধুত্ব নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধাবাদী চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। দেশের স্বাতন্ত্রতা, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, দেশপ্রেমী সেনাবাহিনী, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতি অনিশ্চয়তা দেশের স্বাধীনচেতা মানুষেরা বেশ উদ্বিঘ্ন। ভারত পরীক্ষিত বন্ধু দাবি করা হলেও দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ ভারতের বন্ধুত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তারা মনে করছেন, ভারত ৪৫ বছরেও বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে পারেনি। বরং বাংলাদেশের রাজনীতিকদের নতজানু ও অতি দাসপ্রবণ মানসিকতার সুযোগ নিচ্ছে ভারত। প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে তার ষোল কলায় পূর্ণ হয়েছে। মূলত কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদি’র চাতুর্যপনাকে বিশেষ সম্মান হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ কোনোভাবেই তিস্তা চুক্তির সঙ্গে অন্য কোনো চুক্তিকে মেলাতে চায় না। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে তিস্তার পানি আমাদের পাওনা। ২০১১ সালে মনমোহন সিং ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তির কাগজপত্র চূড়ান্ত ছিল। ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এসে অচিরেই তিস্তা চুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন। তারপরও তিস্তা ঝুলিয়ে রাখা বন্ধুত্বের কোনো নিদর্শন হতে পারে না।
বাংলাদেশের মানুষকে অতিমাত্রায় ভারত বিরোধী মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষ কোন অবস্থাতেই কোন দেশেরই বিরোধী নয় বরং ভারতের নেতিবাচক আচরণের কারণেই এদেশের অধিকাংশ মানুষই ভারত বিরোধী হয়ে উঠেছেন। খোদ ভারতের সৃষ্ট ক্ষতকে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণের উপর কোনভাবেই চাপিয়ে দেয়ার কোন যৌক্তিকতা থাকে না। আসলে ভারত বাংলাদেশের জনগণের আবেগ-অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। তাই ভারতকে ভাবতে হবে তারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য কি করতে পারে। যা করলে এ দেশের মানুষ মনে করবে ভারত আগ্রাসী নয়। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতকে আরো উদার হতে হবে।
তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের দরকষাকষির কোন যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না। এতে বাংলাদেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট ভারতেরই বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যাতে ভারত বিরোধী কার্ড ব্যবহার করতে না পারে সে জন্যই দিল্লীকে তাদের সনাতনি বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে এসে বাংলাদেশকে কিছু দিতে হবে। শুধু নেব কিছুই দেব না এটা হয় না। ভারত নিজেই ২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছে ইসরাইল থেকে। বিশ্বের ১০ অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ভারত নেই। যারা নিজেরাই বিদেশ থেকে অস্ত্র কেনে তাদের কাছে আমাদের অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তির প্রয়োজন আছে কিনা ভাবতে হবে। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক। কিন্তু বন্ধুত্ব হতে হয় সমমর্যাদার, অভিভাবকত্বের নয়। বিগ ব্রাদার ভাব দেখানো মোটেই সঙ্গত নয়।
দুই দেশের যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলো নিয়ে রাখঢাকই আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে। কারণ, এতে একতরফাভাবে ভারতেরই স্বার্থ রক্ষা হয়েছে, বাংলাদেশের বেলায় পুরোটাই অশ^ডিম্ব। বস্তুত বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংকট নিরসন করেছে। অন্যকোনো দেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের ঘাটতি পড়লে কি আমাদের পররাষ্ট্র নীতি পাল্টিয়ে ভারতের পক্ষে থাকতে হবে? এ সম্পর্কে খোলাসা হওয়া দরকার। ’৭১-এ চুক্তি ছাড়াই ভারত আমাদের সহায়তা করেছে; এখন চুক্তির প্রয়োজন পড়লো কেন? আসলে আস্থার ঘাটতি দূর করতে হবে। আর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা হবে; অন্য দেশের প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে নয়। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাববার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আসলে ভারত ৪৪ বছরেও বন্ধুত্বের নিদর্শন পেশ করতে পারেনি। ভারত বন্ধুত্ব নয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে সব সময় সরব থাকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর প্রতিদান হিসেবে প্রতিরক্ষাসহ অনেকগুলো চুক্তি করেছে বলে মনে করছেন তথ্যাভিজ্ঞমহল। আমাদের শাসক শ্রেণির দুর্বলতা, মেরুদ-হীনতার সুযোগ নিচ্ছে ভারত। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব যতই উচ্চতায় দাবি করা হোক না কেন মূলত সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ। কারণ, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভারতকে বিশ্বাস করে না। সরকারের দুর্বলতার কারণে চুক্তিগুলো চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা সড়ক পথে নেপাল-ভুটানে যেতে চাই। ভারত পথ দেয় না। অথচ তারা ট্রানজিট নিয়েছে। ’৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বৈরীতার সম্পর্ক।
অভিজ্ঞমহল মনে করছে, প্রথমত এ সফরে বাংলাদেশের বড় প্রত্যাশাই পূরণ হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টনে চুক্তি হয়নি, এটা দেশবাসীর সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা বা চাওয়া ছিল। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা রয়েছে, তা নিরসনে ঢাকার তরফে পাটের এন্টি ডাম্পিং এবং তৈরি পোশাকের শুল্ক প্রত্যাহার-এ দু’টি বিষয় উত্থাপন করা হয়েছিল। শীর্ষ বৈঠকে আলোচনায় এ নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে, কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার মিলেনি। প্রধানমন্ত্রীর সফরে ঢাকা-দিল্লী যেসব চুক্তি এবং সমঝোতা সই হয়েছে তার প্রায় সবই ভারতের অনুকূলে দাবি করে তারা বলছেন, ওই সব চুক্তি-সমঝোতায় বাংলাদেশের তেমন প্রাপ্তি নেই।
মূলত প্রতিরক্ষা খাতে দুই দেশের সহযোগিতা আগেও ছিল। এখন এটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসা হলো। প্রতিরক্ষা বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো সমঝোতার বিষয়ে যা প্রকাশ করা হয়েছে, তার বাইরে গোপন কিছু আছে কি-না তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি। তিস্তাকে বাদ দিয়ে অন্য নদীর পানি বণ্টনের আলোচনার যে প্রস্তাব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দিয়েছেন তা এক নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছে বলেই মনে হয়। মমতার ওপর যে আস্থা রাখা যায় না, এটা মমতা নিজেই আবার প্রমাণ করলেন। তিস্তা নিয়ে এখন আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
ভারতের সংবিধানের ২৫৩ অনুচ্ছেদ মতে, যেকোনো দেশের সঙ্গে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার যেকোনো চুক্তি করতে পারে। এখন বিষয়টি নিয়ে মমতা নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আমাদের দরকষাকষি বাড়াতে হবে। সংবিধান প্রদত্ত ওই ক্ষমতাবলে কেন্দ্র যেন চুক্তি সইয়ে রাজি হয় সে জন্য দরকষাকষি করতে হবে। কিন্তু সরকার তো একতরফাভাবে সবকিছুই ভারতের অনুকুলে সোপর্দ করেছে। তিস্তাচুক্তি নিয়ে ভারত সরকারের পক্ষে বড় বড় কথা বলা হলেও আগামী দিনে তিস্তাচুক্তি সম্পাদনের কোন সম্ভবনা আপাত দেখা যাচ্ছে না। আর ভবিষ্যতে কি হবে তা সময়ই বলে দেবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, অর্জন-বিসর্জন নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এ সফরে প্রধানমন্ত্রীর অতিমাত্রায় সম্মান প্রদর্শন ছাড়া আর কোন প্রাপ্তি আছে বলে মনে হয় না। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ভারত সফরকে ফলপ্রসূ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘সফরটা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। সম্পূর্ণ তৃপ্তি আছে। তৃপ্তিতে কোন সন্দেহ নেই।.... হতাশ হবার কিছু নেই। হতাশ হবার মতো কোন কিছু ঘটেনি’। তবে প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে দেশটির আতিথেয়তায় অত্যন্ত খুশি হলেও সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তিস্তাচুক্তি না হওয়ায় হতাশ হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলটি। তাই সরকার পক্ষ মুখে যে কথাই বলুক না কেন এ সফরে জনগণের ভাগ্যের যে শিকে ছেড়েনি তা মোটামোটি দিব্যি দিয়েই বলা যায়।
আর একথার প্রমাণ মেলে সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর বিবিসি বাংলার সাথে সাক্ষাৎকারের বক্তব্য থেকে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার মনে হয় মোটামুটি ভালোই হয়েছে। ভারত তার প্রত্যাশার ৯০ শতাংশই পেয়েছে। কানেক্টিভিটি, ট্রেন, ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্টসহ ভারত যা প্রত্যাশা করেছিলো চুক্তি ও সমঝোতার ফলে সবই এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। অন্যদিকে তিস্তা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি অন্য অভিন্ন নদী নিয়েও আলোচনার পথ তো খোলা রয়েছেই।’ কিন্তু এ সফরে বাংলাদেশ কি পেয়েছে তা নিয়ে কোন কথা বলেন নি। শুধু তিস্তাচুক্তি নিয়ে আলোচনার পথ খোলা রাখা হয়েছে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। ভাবটা এ রকম যে, ভারত যে তিস্তার পানি নিয়ে আলোচনার পথটা রুদ্ধ করে দেয়নি এটিই বাংলাদেশের জন্য অনেক কিছু। আমাদের চাইবার মতো আর কিছু নেই।
সার্বিক দিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে অর্জন নয় বরং বিসর্জনের সফর হিসাবেই দেখছেন। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জাতীয় ঐক্য সময়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। রাজনীতিতে ভিন্নমত-ভিন্নপথ থাকবেই। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে আমাদেরকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং দেশ ও জাতির স্বার্থকেই সবার উপরে স্থান দেয়া জরুরি। অন্যথায় আমাদের জাতিস্বত্ত্বা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। smmjoy@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/279929-