১৬ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৮:১০

চীনকে ক্ষুব্ধ করা হচ্ছে

আত্মপক্ষ

|| এবনে গোলাম সামাদ ||

শেখ হাসিনা ভারত সফর করে ফিরলেন। ভারতে তিনি গিয়েছিলেন তিস্তার পানি পাবেন এই আশা নিয়ে। কিন্তু সেটা হলো না। এই সফরে লভবান হলো ভারত। বাংলাদেশ কার্যত পেলো না কিছুই। সারা বিশ্বে যেটা আলোচিত হয়ে উঠেছে, তা হলো বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত হওয়া। কেননা, এত দিন ভাবা হতো চীন বাংলাদেশের বড় বন্ধু। কিন্তু এখন আর সেটা মনে করা যাবে না। কেননা, বাংলাদেশ ঝুঁকে পড়ছে ভারতের দিকে। মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং কোনো দু’টি দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি নয়। কিন্তু এটা তখনই সম্পন্ন হয়, যখন দু’টি দেশ মনে করে কোনো ব্যাপারে তাদের স্বার্থ হয়ে উঠেছে অভিন্ন। এর আগে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় চীনের সাথে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রতিরক্ষা ব্যাপারে সমঝোতাস্মারক। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুরূপ সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর করলেন ভারতের সাথে। এতে চীন বৈরী না হলেও যে ক্ষুব্ধ হবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে চীন বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে বেশি। কেননা, সামরিক প্রযুক্তিতে চীন ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে সব দিকে। চীনা সমরসম্ভারের মান ভারতের থেকে অনেক উন্নত। চীনা সমর কৌশল ভারতের তুলনায় অনেক অগ্রসর। কিন্তু চীনকে ছেড়ে শেখ হাসিনা প্রতিরক্ষার ব্যাপারে কেন ভারতমুখী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন, সেটা নিয়ে তাই জনমনে সৃষ্টি হচ্ছে নানা জিজ্ঞাসা। জিজ্ঞাসা আরো জোরাল হচ্ছে, কেননা তিস্তার পানির ভাগ বাংলাদেশ পেতে পারল না। বাংলাদেশ আসলে পায়নি কিছুই। কেবলই অর্জন করেছে ভারতের প্রশংসা। কিন্তু এই কূটনৈতিক প্রশংসা বাস্তব ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কতটা শক্তিশালী হতে সাহায্য করবে, অথবা আদৌ করবে কি না, সেটা নিয়ে জাগছে সংশয়।
নদীর পানি নিয়ে কোনো আলোচনা হতে হলে এখন আর চীনকে বাদ দেয়া যাবে না। কেননা, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পানি আসে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। এক হিসাব অনুসারে ১৯৪২ সালে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে পানি এসেছে ২০০০০০০ কিউসেক। অন্য দিকে পদ্মা নদী দিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে ৯ জুন থেকে ২৯ আগস্টের মধ্যে পানি এসেছিল ৪৯৯৮৩৫ থেকে ১৫১৩৪২৩ কিউসেক। অর্থাৎ বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পানি আসে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে, পদ্মা নদী দিয়ে নয়।
ব্রহ্মপুত্র নদের উৎস হলো তিব্বতের মানস সরোবর (সাধারণত কোনো নদী হ্রদ থেকে উৎপন্ন হলে বাংলা ভাষায় তাকে বলে ‘নদ’। যেমন সিন্ধু নদ, ব্রহ্মপুত্র নদ, নীল নদ। আসলে নদ ও নদীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। গঙ্গাকে আমরা নদ বলি না, কেননা গঙ্গার উৎস হলো হিমালয়ের একটি তুষার নদী। তিস্তাকেও নদী না বলে অনেকে বলছেন নদ। কেননা তিস্তার উদ্ভব হয়েছে সিকিমে, তুষার গলা পানি জমে সৃষ্ট একটি হ্রদ থেকে। তিস্তা নদীর নাম সিকিমি ভাষায় দিস্তাং।)। ব্রহ্মপুত্র নদের তিব্বতি নাম হলো, সাং-পো। চীন সাং-পো নদীর ওপর ব্যারাজ বানিয়েছে। চীন যদি ইচ্ছে করে তবে সে ভারতে সাং-পো নদীর পানি আসতে সৃষ্টি করতে পারে বিরাট বাধা। সে এ রকম কিছু করলে ব্রহ্মপুত্রে আসবে না আর আগের মতো পানি। বাংলাদেশ পড়বে আরো একটা পানি বিপর্যয়ের মধ্যে। তিব্বত থেকে সাং-পো নদী এসেছে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে। তখন নদীটার নাম হয়েছে ‘ডিহিং’। ডিহিং নদী যখন আসামের সমতল ভূমিতে এসেছে, তখন নাম পেয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ।
আসামে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে ১২০টি উপনদী। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার নদীর পানি নিয়ে আলোচনায় ডাকতে চাচ্ছে না চীনকে। যদিও ব্রহ্মপুত্র হলো চীন থেকে আসা নদী। আর তা দিয়েই বাংলাদেশে প্রতি বছর আসে সবচেয়ে বেশি পানি। ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে বাংলাদেশে মিলিত হয়েছে তিস্তা নদী। যেহেতু ব্রহ্মপুত্র নদের একটা বিশেষ উপনদী হলো তিস্তা, তাই আন্তর্জাতিক প্রথানুসারে তিস্তার পানি সম্পর্কেও চীনের থাকতে পারে একটা বক্তব্য। কিন্তু ভারত সেটা মানতে রাজি নয়। আর আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশ সরকার নদীর পানি নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে চীনকে একটা পক্ষ করতে রাজি হচ্ছে না। ভাবছে, চীনকে প্রতিপক্ষ করলে ভারত সরকার নদীর পানি বণ্টনে হয়ে উঠবে আরো অনড়। কিন্তু যেকোনো আন্তর্জাতিক সালিসে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি পেতে হলে চীনকে একটা পক্ষ করতেই হবে।
ধলেশ্বরী নদী ব্রহ্মপুত্রের একটা শাখা নদী। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা হলো ব্রহ্মপুত্র নদের প্রশাখা নদী। বুড়িগঙ্গার পাশে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা অবস্থিত। আমরা ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর যথেষ্টভাবেই নির্ভরশীল। যমুনা বা নতুন ব্রহ্মপুত্র পদ্মার সাথে মিলিত হয়েছে গোয়ালন্দে। এই মিলিত ধারাকেও বলা হয় পদ্মা। যমুনায় কম পানি এলে গোয়ালন্দের কাছে পদ্মার পানি অনেক দ্রুত বয়ে যেতে থাকবে। কেননা, তা বাধা পাবে না যমুনার স্রোতে। পদ্মা যেতে চাইবে শুকিয়ে। কিন্তু আমরা যেন ভাবতে চাচ্ছি না ব্রহ্মপুত্র নিয়ে। ভাবছি পদ্মা আর তিস্তা নিয়ে। কিন্তু অচিরেই ব্রহ্মপুত্র হয়ে উঠতে পারে আমাদের নদী সমস্যার মূলবিন্দু।
হাসিনা সরকার ভারতকে দিচ্ছে অতি গুরুত্ব। কিন্তু বিশ্ব তা দিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ গুরুত্ব চীনকে দিচ্ছে, তা দিচ্ছে না ভারতকে। কিন্তু আমরা যেন ভারতকেই চীনের চেয়ে মনে করছি অনেক বড় শক্তি। চীন বিশ্বের কোনো দেশ থেকে সমরাস্ত্র কিনছে না। কিন্তু ভারত এখনো কিনছে। আর সেই ভারতের কাছ থেকে আমরা চাচ্ছি সমরাস্ত্র কিনতে। অথচ ভারতের সমরাস্ত্র মোটেও উন্নতমানের নয়। চীন কেবল পরমাণুবোমা বানাতে সক্ষম নয়, সে বানাতে সক্ষম হাইড্রোজেন ও নিউট্রন বোমাও। চীনের পারমাণবিক প্রযুক্তি ভারতের চেয়ে রয়েছে অনেক উন্নত পর্যায়ে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ সরকার যেন নিতে চাচ্ছে না এটা ধর্তব্যের মধ্যেই, যা বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে একটা মহা বিপর্যয়েরই মধ্যে।
অরুণাচলে চীন দাবি করছে ৩০ হাজার বর্গমাইল এলাকা তার নিজের বলে। ভারতকে ম্যকমোহন লাইন থেকে সরে থাকতে হচ্ছে সাড়ে ১২ মাইল দূরে। অন্য দিকে লাদাখে চীন দখল করে নিয়েছে ১২ হাজার বর্গমাইল এলাকা, যা ভারত চীনের কাছ থেকে পুনর্দখল করতে পারছে না। যাকে একসময় বলা হতো আকসাই চীন, তা-ও এখন রয়েছে চীনের দখলে। আকসাই চীনের মধ্য দিয়ে চীন বানিয়েছে জিংজিয়াং (সিংকিয়াং) প্রদেশে যাওয়ার জন্য একটি মহাসড়ক। ভারত এই মহাসড়ক নির্মাণে দিতে পারেনি বাধা। সম্প্রতি চীন পাকিস্তানের গোয়াদারে গড়ে তুলেছে পাকিস্তানের সম্মতিতে একটি বিরাট নৌঘাঁটি। এসব কিছুকে বিবেচনায় না নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকছে ভারতের প্রতি। আর তাই তা নিশ্চই চীনকে করছে ক্ষুব্ধ। চীনকে ক্ষুব্ধ করে বাংলাদেশের কূটনীতি লাভবান হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা, চীন এখন এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি। আর ভারত আছে চীনের থেকে সব দিক থেকেই পিছিয়ে। ভারত ও চীনের মধ্যে কোনো দিক থেকেই তুলনা হতে পারে না। যদি তা হতে পারত, তবে ভারত চীনের কাছ থেকে তার হারানো ভূখণ্ড দখল করে নিতে পারতো। কিন্তু তা সে পারছে না। ভারত হয়তো অরুণাচলে তার সামরিক শক্তি বাড়াতে চাচ্ছে। আর এই জন্য সে চাচ্ছে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সেখানে সৈন্য, সমরসরঞ্জাম ও রসদ পরিবহনের সুযোগ। আর এই কারণেই বোধ হয় হতে পারল প্রতিরক্ষা সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষরিত। আমরা বাইরের লোক, ভেতরের কথা কিছুই জানি না। তবে এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর আমাদের মনে সৃষ্টি করছে নানা জিজ্ঞাসা। যার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না সরকারিভাবে।
বাংলাদেশে যেমনই হোক, একটা পার্লামেন্ট আছে। পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে এ রকম গুরুতর সিদ্ধান্ত কেন নেয়া হচ্ছে সেটাও হচ্ছে না আমাদের বোধগম্য। সব গণতান্ত্রিক দেশেই বৈদেশিক নীতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। হয় বিতর্ক। কিন্তু বাংলাদেশে তা হতে পারছে না। যদিও বাংলাদেশ সরকারের দাবি, বাংলাদেশে বিরাজ করছে উদার বহুদলীয় গণতন্ত্র। শেখ মুজিব দেশবাসীকে অন্ধকারে রেখে ঝুঁকে পড়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার মনে হচ্ছে ঝুঁকে পড়তে চাচ্ছে ভারতের প্রতি। সোভিয়েত ইউনিয়ন সে সময় যতটা শক্তিশালী ছিল, তাতে শেখ মুজিবের তার প্রতি ঝুঁকে পড়ার কিছুটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ভারত তেমন একটা শক্তি নয়। তাই তার প্রতি বাংলাদেশের এই আকর্ষণের কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া সহজ হচ্ছে না।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/212325