১৪ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৯:৩১

ঝুঁকিতে বিদ্যুৎ খাত

দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চাকা সচল রাখার প্রধান শর্তই হলো বিদ্যুৎ-জ্বালানির পর্যাপ্ততা। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহ করতে না পারায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি নিজস্ব নির্ভরতা অপরিহার্য। অথচ রেন্টাল, কুইক-রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর বিদ্যুৎ নির্ভরতা যেন বেড়েই চলছে। দেশের বিদ্যুৎ খাতে ভারতের অতিমাত্রার এই প্রভাব সরকারের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা। এই অবস্থা মোকাবিলায় এখন থেকেই আগাম কর্মকৌশল নির্ধারণ করা না হলে বিদ্যুৎখাত পুরোপুরি ভারত নির্ভর হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন তারা।

ইতোমধ্যেই ভারত থেকে প্রতিদিন ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনা হচ্ছে। আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। যে কোন সময় আন্তঃগ্রীড সংযোগের মাধ্যমে আরও ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হবে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আরও ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে।
এর পাশাপাশি ভারতের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী আদানি ও রিলায়েন্সের কাছ থেকে ২ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। প্রতিষ্ঠান দু’টির কাছ থেকে যে বিদ্যুৎ ক্রয় করা হবে তা দেশীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের তুলনায় অনেক বেশি দাম পড়বে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদানি ও রিলায়েন্স প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রস্তাব করেছে প্রায় সাত টাকা। দেশে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের তুলনায় এই দাম অনেক বেশি।
এমনিতেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভাড়াভিত্তিক অস্থায়ী ব্যবস্থা নিয়ে সরকার দিশেহারা। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরকারকে চড়াদামে বিদ্যুৎ ক্রয় করতে হচ্ছে। আর ভাড়াভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করতে হচ্ছে লোকসানী মূল্যে জ্বালানি তেল ও গ্যাস। এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে না তুলে দেশের বিদ্যুৎখাতকে অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরশীল করা হলে তা সরকারের জন্য মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করবে।

এমনিতেই দেশের বিদ্যুৎ সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার ‘কুইক রেন্টাল’ তথা জরুরি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে তা বড় সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আশঙ্কা রয়েছে, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভর্তুকি বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা হিসাবে না পোষালে এসব কোম্পানি যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া, সরকার বদল হলে কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের ভবিষ্যত কী হবে সে বিষয়টিও স্পষ্ট নয়।
যদিও কুইক রেন্টালের বিষয়ে জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা পেতে সংসদে ইনডেমনিটি আইন পাস করা হয়েছে। ফলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাথে জড়িতরা থেকে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভারতের প্রতিষ্ঠান আদানি ও রিলায়েন্সের ক্ষেত্রেও একই সুরক্ষা দেয়া হবে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, আদানি ও রিলায়েন্সের কাছ থেকে সরকারকে অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ ক্রয় করতে হবে। এই কর্মকর্তার মতে, এই দু’টি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের দেশের বাইরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বড় ধরনের কোন অভিজ্ঞতা নেই। তদুপরি. এই দু’টি প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কেনাবেচার বিষয়টিও এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রæত সরবরাহ (বিশেষ বিধান)’ শীর্ষক বিশেষ আইনের আওতায় এবং আদানি ও রিলায়েন্সের অযাচিত (আনসলিসিটেড) প্রস্তাবের ভিত্তিতে।
প্রসঙ্গত, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রæত সরবরাহ (বিশেষ বিধান)’ শীর্ষক আইনটি ২০১০ সালে সরকার তিন বছরের জন্য করেছিল। পরে একাধিকবার তার মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সাল পর্যন্ত বহাল করা হয়েছে। এই আইনের আওতায় প্রচলিত দরপত্র-প্রক্রিয়া ছাড়াই কোনো কোম্পানিকে আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দিতে পারে সরকার। এ নিয়ে কখনো কোনো আদালতেরও শরণাপন্ন হওয়া যাবে না।
জানা গেছে, নিজ দেশের বাইরে বিদ্যুকেন্দ্র স্থাপন করতে হলে যে অভিজ্ঞতা অপরিহার্য বলে প্রচলিত প্রক্রিয়ায় গণ্য করা হয়, আদানি ও রিলায়েন্সের ক্ষেত্রে তা করা হচ্ছে না। আদানি ভারতে প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র্র স্থাপন করলেও বিদেশে বিদ্যুকেন্দ্র স্থাপনের কোনো অভিজ্ঞতা তাদের নেই।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, আদানি ভারতে তাদের মালিকানাধীন কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে উৎপাদিত মোট ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ করার প্রস্তাব দিয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চালন লাইন আদানিই নির্মাণ করবে।

রিলায়েন্সের প্রস্তাবনায় বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে মোট তিন হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র করবে কোম্পানিটি। এর মধ্যে প্রথমটি হবে ৭৫০ মেগাওয়াটের। এই কেন্দ্রটির জন্য রিলায়েন্স সরকারের কাছে দীর্ঘ মেয়াদে গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়েছে। পাশাপাশি মহেশখালীতে একটি স্বতন্ত্র ভাসমান টার্মিনাল (ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ) স্থাপন করে এলএনজি আমদানি করে তা দিয়ে ২ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা তাদের।
গত বছরের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে আদানি ও রিলায়েন্সের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) আলাদা দুটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। সেই সূত্র ধরে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোম্পানি দুটির একাধিক বৈঠক হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কোম্পানি দুটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছে।
এদিকে ভারতীয় মিডিয়া সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ভারতে বিদ্যুৎ ঘাটতি হচ্ছে ৫০ হাজার মেগাওয়াট। আর আগামী ২০৩০ সালে ভারতের বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৯ লাখ ৫০ হাজার মেগাওয়াট। এই সময়ে ভারতের বিদ্যুৎ ঘাটতি ২ লাখ মেগাওয়াটের ওপরে দাঁড়াবে। এই ঘাটতি মোকাবেলায় ভারত নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করবে। নেপাল ও ভুটানের মোট সম্ভাব্য পানিবিদ্যুতের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার মেগাওয়াট। অন্যদিকে ভারতের নিজস্ব সম্ভাবনাময় অব্যবহৃত পানিবিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ মেগাওয়াট। মিয়ানমারের সম্ভাব্য পানিবিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার মেগাওয়াট। মিয়ানমার থেকেও ভারত বিদ্যুৎ নেয়ার পরিকল্পনা করেছে।

এক্ষেত্রে ভারত চাইলে নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে বাংলাদেশের নির্মিত আন্তঃগ্রীড ব্যবহার করতে পারবে। বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই গ্রীড ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশের চারদিকে পাটনা, গয়া, কলকাতা, আসাম, দিনাজপুর (ভারত), হাওড়া, জামশেদপুর সংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎ দিতে পারবে। নতুবা ভারতকে এ পানিবিদ্যুৎ নিতে যে গ্রীড নতুন করে বানাতে হবে তা শুধু ব্যয় বহুলই হবে না, এ গ্রীড এতো দীর্ঘ হবে যে তাতে সিস্টেমলসসহ ভল্টেজ ড্রপ হবে। আর আর্থিক ও কারিগরী দিক থেকেও তা লাভজনক হবে না বলে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
কাজেই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি করার মধ্যে দিয়ে যে আন্তঃগ্রীড চালু করা হয়েছে-তা ভারতের জন্যই সবচেয়ে বেশি সুফল বয়ে আনবে। ভারত এ কারণেই ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ব্যয় করা কোটি কোটি টাকায় নির্মিত এবং ভবিষ্যতে নির্মাণ করা হবে এমন গ্রীড দিয়ে, এ দেশকে করিডোর বানিয়ে বিদ্যুৎ নিতে চায়। আর এতে ভারত এক অংশ থেকে আরেক অংশকে বিদ্যুৎ সংযোগে যুক্ত করতে আগ্রহী বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সাবস্টেশন হয়ে ৫শ’ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা থেকে ১শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়েছে। আগামী ২০১৭ সালের মধ্যে আরও ৬শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসবে। এ ছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে ২০১৩ সালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি হয়েছে। এই কেন্দ্রটি নির্মাণে দুদেশের অংশীদারিত্বের কথা বলা হলেও বাস্তবে এ কেন্দ্রের পুরো নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতেই থাকবে। ভারতের এক্সিম ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হবে। এ নিয়ে পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করলেও সরকার নির্দিষ্ট স্থানেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে অনঢ়।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর চলমান ভারত সফরেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে এক্সিম ব্যাংকের সাথে ঋণচুক্তি, ত্রিপুরা থেকে আরো ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি, নেপাল ও ভূটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি, বাংলাদেশ-ভারত-ভুটান-নেপাল চতুর্দেশীয় বিদ্যুৎ গ্রীড, ঝাড়খন্ডে অবস্থিত আদানি গ্রæপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সঞ্চালন লাইন করা এবং ভারতের রিলায়েন্সের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা হবে।
ভারতের ত্রিপুরার সূর্য মণিনগর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিশালগড় মহকুমার কৈয়াঢেপা সীমান্ত হয়ে বর্তমানে প্রতিদিন ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে। এই পথে আরও ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। এর দাম নিয়ে এতদিন দুই দেশ সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। এখন তা ঠিক হয়েছে। প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ৫ রুপি ৫৪ পয়সা। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ছয় টাকা ৩১ পয়সা। আর ভারতের আদানি গ্রæপ ঝাড়খন্ড প্রদেশে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ বাংলাদেশে প্রতি ইউনিট ছয় টাকা ৯৩ পয়সা দরে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। যা অনেক বিশে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে, ভারতের নতুন আইন অনুযায়ী- নেপাল থেকে বাংলাদেশে সরাসরি বিদ্যুৎ আমদানির কোন সুযোগ রাখেনি দিল্লী। নতুন আইনে ভারত কাউকে বিদ্যুতের ট্রানজিট দেবে না। তবে নেপাল বা ভূটান থেকে ভারত বিদ্যুৎ কিনে তা আবার বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করতে পারবে। যেহেতু ভারতের ভূমি ব্যবহারের বিকল্প নেই তাই ভারতের মাধ্যমেই বাংলাদেশ নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আদানির প্রস্তাবটি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বোর্ড সভা অনুমোদন করেছে। সেটি এখন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য আসবে। আর রিলায়েন্সের ৭৫০ মেগাওয়াটের প্রস্তাবটিতে মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/74765