১৪ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৯:২৭

নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্পষ্ট করে বলেছেন, আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন কার্যকর করা হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলেছে, আইন কার্যকরে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। এখন শুধু বাস্তবায়নের অপেক্ষা। তবে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে এখনও। এগুলো সমাধান না করে এ আইন বাস্তবায়ন করা সমীচীন হবে না। যদি করা হয়, তাহলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চাপে পড়বে জনগণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংশয় ও শঙ্কায় আছেন ব্যবসায়ীরা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৭ এপ্রিল ভ্যাট আইন নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ডাকা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ সংশ্লিষ্টরা এতে অংশ নেবে। যেসব বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে, তা নিরসনের চেষ্টা করা হবে এ বৈঠকে। এর আগে ভ্যাট নিয়ে মার্চে একটি বৈঠক করা হয়। তবে কোনো সমঝোতা ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়।

সরকারের নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা গেছে, অভিন্ন হারে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে চান ব্যবসায়ীরা। যেসব শিল্প খাত রেয়াত সুবিধা নিতে পারবে না, সেসব খাতে বিদ্যমানের মতো বিশেষ ছাড় দিয়ে একাধিক হারে ভ্যাট দেওয়ার পক্ষে ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া একসঙ্গে না করে পর্যায়ক্রমে এ আইন বাস্তবায়ন চান তারা। এসব বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা হলে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীদের কোনো আপত্তি নেই। দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নতুন আইনে বার্ষিক ৩০ লাখ টাকা বিক্রয় পর্যন্ত ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ৩০ লাখ ১ টাকা থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হলে ৩ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হবে। অন্যদিকে, ৮০ লাখ টাকার বেশি বিক্রয় হলে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। এনবিআর বলেছে, এ প্রস্তাব কার্যকর হলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।

বিদ্যমান ভ্যাট আইনে পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজনের ওপর একাধিক 'হ্রাসকৃত' হারে ভ্যাট আদায়ে বিশেষ ছাড় রয়েছে। নতুন আইনে এ সুযোগ থাকছে না। এর পরিবর্তে সব ক্ষেত্রে 'অভিন্ন' অর্থাৎ, ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হবে। এ আইন প্রয়োগ হলে অর্থনীতি ও সামাজিকভাবে এর প্রভাব কী হতে পারে তা নিয়ে সমকাল কথা বলেছে ভ্যাট বিশেষজ্ঞ, শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। তারা বলেছেন, সব খাতে সমানহারে ভ্যাট আরোপের নিয়ম কার্যকর হলে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে। বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতি।

অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন চালুর উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও সংশয় প্রকাশ করে ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, আইনটি বাস্তবায়নে এনবিআরের অভ্যন্তরে ও মাঠ পর্যায়ে ভ্যাট অফিসে যে

ধরনের সক্ষমতা থাকা দরকার, তা নেই। এ ছাড়া হিসাব সংরক্ষণের বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে ব্যবসায়ীদেরও। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করে পর্যায়ক্রমে করার দাবি জানান তারা। এনবিআর বলেছে, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে উপকৃত হবেন সবাই। কারণ এ আইন ব্যবসাবান্ধব। এতে পণ্য ও সেবার মূল্য সংযোজনের প্রতিটি স্তরে রেয়াত বা ক্রেডিট সুবিধা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ব্যবসার খরচ কমবে।

১৯৯১ সালে দেশে প্রথমবারের মতো ভ্যাট প্রবর্তন হয়। এর ২০ বছর পর ২০১০ সালে নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এটি মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২ নামে পরিচিত। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বর্ধিত ঋণ সহায়তা বা ইসিএফ কর্মসূচির আওতায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার অন্যতম শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা হয়। সরকার অবশ্য ভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেছে, ১৯৯১ সালের আইনে ভ্যাট ব্যবস্থার অসংখ্য বিচ্যুতি রয়েছে। যার ফলে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না।

চার বছর আগে জাতীয় সংসদে ভ্যাট আইন পাস হলেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, অবকাঠামো সমস্যা, ব্যবসায়ীদের আপত্তিসহ নানা কারণে এতদিন আইনটি বাস্তবায়ন হয়নি। গত বছরের জুনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আগামী জুলাই থেকে এটি বাস্তবায়ন হবে। এরপর আইনটি বাস্তবায়নে নানা উদ্যোগ নেয় এনবিআর। গত ২৩ মার্চ অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধনের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী। অনলাইনে সেবা দিতে ১৬৫৫৫ একটি হান্টিং নাম্বার চালু করেছে এনবিআর। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ যেসব জেলায় ভ্যাট কমিশনারেট অফিস রয়েছে, সেখানে ১২টি ভ্যাট অনলাইন সাপোর্ট সেন্ট্রার (ভিওএসসি) বা সেবাকেন্দ্র চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে রাজধানীর মতিঝিল, উত্তরা ও মিরপুরে সেবাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে করা হয়েছে একটি। উল্লেখ্য, বর্তমানে এনবিআরের সংগৃহীত মোট রাজস্বের ৩৯ শতাংশ আসে ভ্যাট থেকে।

যোগাযোগ করা হলে প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান সমকালকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে সরকারের এক জায়গায় মতভেদ রয়েছে। আইএমএফকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী। তারা হিসাব ঠিকমতো সংরক্ষণ করেন না। ফলে রেয়াত সুবিধা পাবেন না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ আইন কার্যকর করা কঠিন হবে।

৪ এপ্রিল ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এনবিআরের সদস্য (ভ্যাটনীতি) ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এ আইনে পণ্য ও সেবার প্রতিটি স্তরে রেয়াত বা ক্রেডিট সুবিধা অর্থাৎ, কাঁচামাল সরবরাহের জন্য যা খরচ হবে, তা বাদ দিয়ে মূল্য সংযোজনের ওপর ভ্যাট আদায় করা হবে। এতে করে সামগ্রিকভাবে ব্যবসার ব্যয় কমবে।

বিশেষজ্ঞরা যা বললেন :সাবেক ভ্যাট কমিশনার আবদুল কাফি সমকালকে বলেন, আইনটি বাস্তবায়নে ভ্যাট বিভাগ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে ধরনের সহায়ক পরিবেশ ও সক্ষমতা দরকার তা নিশ্চিত হয়নি। এফবিসিসিআইর পরামর্শক ভ্যাট বিশেষজ্ঞ মঞ্জুর আহমেদ বলেন, নতুন আইন কার্যকর হলে রেয়াত গ্রহণে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হবে। কারণ আমাদের দেশের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ক্ষুদ্র ও মাঝারি। তারা হিসাব সংরক্ষণ সঠিকভাবে করেন না। এ ছাড়া ভ্যাট বিভাগে দুর্নীতি রয়েছে। নতুন আইন প্রণয়নে এসব বিষয় সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় আনা হয়নি। ফলে এ আইন বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য :রাজধানী ফকিরাপুলের মুন্নী রেস্টুরেন্টে বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের গ্রাহক খেতে আসেন। এ হোটেলে খাবার বিলের সঙ্গে বর্তমানে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে নামিদামি হোটেলের মতো মুন্নী রেস্টুরেন্টেও ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। এই হোটেলের ম্যানেজার মোস্তফা সমকালকে বলেন, ভ্যাট বাড়লে সঙ্গত কারণে খাবারের দাম বাড়বে। এতে করে ভোক্তার ওপর চাপ আসবে। জানা গেছে, সারাদেশে বর্তমানে ৫৫ হাজার হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে। এর মধ্যে ৯০ ভাগই মুন্নী রেস্টুরেন্টের মতো ছোট ও মাঝারি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, বেশিরভাগ হোটেল-রেস্টুরেন্টে ভ্যাটের চালান প্রচলন নেই। নতুন ভ্যাট আইনে লেনদেনের প্রতিটি স্তরে চালান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে ভ্যাট আদায়ে জটিলতা বাড়বে।

বাংলাদেশ সুইট ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মাধব চন্দ্র ঘোষ সমকালকে বলেন, বাংলাদেশে ৮৫ ভাগই খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী। পণ্য কেনা-বেচার সময় এ স্তরে ভ্যাটের চালান দেওয়ার রেওয়াজ মানা হয় না। চালান না দেখাতে পারলে রেয়াত পাওয়া যাবে না। ফলে খরচ বাড়বে। তখন বাধ্য হয়ে মিষ্টির দাম বাড়াতে হবে। এতে জনগণের ওপর চাপ আসবে। বর্তমানে মোটরগাড়ি ওয়ার্কশপ সার্ভিসের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হয়। ১ জুলাই থেকে হবে ১৫ শতাংশ। ফলে এ খাতে ব্যবসার খরচ বাড়বে। জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক আবদুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, সারাদেশে ১০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) শিল্প আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে আধুনিক পদ্ধতিতে হিসাব সংরক্ষণ রাখা হয় না। নতুন আইন কার্যকর হলে এসএমই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চাপ বাড়বে :নতুন আইনে মৌলিক খাদ্য, নির্ধারিত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহন সেবা, গণস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কৃষি, মৎস্য চাষ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম, অলাভজনক সংস্কৃতি সেবাসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে অব্যাহতি বহাল রেখে বাকি সব ক্ষেত্রেই আমদানি, উৎপাদন, খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে অভিন্ন অর্থাৎ, ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসবে। এতে করে বাড়তি খরচের চাপে পড়বে জনগণ।

http://bangla.samakal.net/2017/04/14/285107