১৪ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৯:১৬

হঠাৎ ব্যাংকিং খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে

ব্যাংকিং খাতে অলস টাকার পাহাড়ে এখন বরফ গলতে শুরু করেছে। ব্যাংকিং খাতে হঠাৎই বেড়ে গেছে ঋণ প্রবাহ। এক্ষেত্রে কোন নিয়মনীতি মানছে না অনেক ব্যাংক। এমন ১০টি ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত ছাড়িয়ে গেছে ৮৫ শতাংশের বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। সিনিয়র ব্যাংকাররা বলছেন, এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে বিপর্যয় ঘটতে পারে ব্যাংকিং খাতে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এটি আগ্রাসী ব্যাংকিং। ইতিমধ্যেই কয়েকটি ব্যাংককে চিঠি দিয়ে সতর্কও করা হয়েছে।


পুঁজিবাজারে ধস, জ্বালাও পোড়াওয়ের ঘটনায় গত কয়েক বছরে কমে গিয়েছিল ঋণের চাহিদা। দীর্ঘদিন উদ্বৃত্ত তারল্য নিয়েই বসে ছিল ব্যাংকগুলো। এর পর কমে আসে ঋণের সুদ হার। তবে আকস্মিকই বাড়তে শুরু করেছে ঋণ দেয়ার হার। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১০টি ব্যাংক তাদের আমানতের ৮৫ শতাংশেরও বেশি ঋণ হিসেবে বিতরণ করেছে। বেসরকারি খাতে তেমন চাহিদা না থাকার পরও এতটা ঋণ বিতরণ ভাবিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।


পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসরকারি এবি ব্যাংক, আইএফআইসি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার, ট্রাস্ট ব্যাংক, বিদেশী ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং সরকারি রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৮৫ শতাংশের বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। আর ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্যোসাল ইসলামী, এবি, দি সিটি ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং উইং বিধি বহির্ভূতভাবে ৯০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করেছে।


সিনিয়র এই ব্যাংকার জানান, ঋণ চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। তবে এর সাথে পাল্লা দিয়ে প্রসার ঘটেনি উদ্যোক্তা খাতের। আর এটাই ভাবনার বিষয়। এমন অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে ব্যাংক খাতে বিপর্যয় ঘটতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। তার মতে, ব্যাংকগুলোর নিয়মের মধ্যেই ব্যাংকিং করা উচিত।


গত ছয়মাস আগেও ব্যাংকিং খাতে চিত্র ছিল অনেকটা ভিন্ন। বিনিয়োগ না থাকায় সরকার দেশী-বিদেশীদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে নানাভাবে প্রচারণা চালাচ্ছিল। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য আলাদা সুযোগ সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছিল। দেশীও বিনিয়োগকারিদের জন্য কমানো হয়েছে ব্যাংক ঋণ। তার পরেও বিনিয়োগ হচ্ছিলো না। এর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন,সরকার যদি জ¦ালানি সুবিধা নিশ্চিয়তা দিতে পারলেই কেবল বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটানো সম্বব হবে।


সূত্র জানায়, গত বছর এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর বেশিরভাগই সরকারি বিভিন্ন বিল বা বন্ডে বিনিয়োগ করা। ফলে এগুলো থেকে ব্যাংকগুলো নামমাত্র মুনাফা পাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব অর্থকে অলস অর্থ বলতে নারাজ। তাদের হিসাবে অলস টাকার পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা জানান, ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব আমানতকারীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে বিধি অনুযায়ী এগুলো দেশের শিল্প বা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখার ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ আমানতের অংশ সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করে রাখতে পারে। এর বাইরে থাকা অন্য অর্থ সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা ব্যাংকের দায়িত্ব নয়। কিন্তু ব্যাংক বর্তমানে তাদের মূলদায়িত্ব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ থেকে সরে এসে সরকারি বিলবন্ডে বিনিয়োগ করছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণের চাহিদা কম থাকায় ব্যাংকগুলো এটি করতে বাধ্য হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জানিয়েছেন,ঋণ বেড়ে যাওয়া ভাল। তবে আমানতের ৮০ শতাংশের উপর ঋণ হলে তা অবশ্যই ঝুঁকি। বেশ কয়েকটি ব্যাংক এ ঋণের ঝুঁকিতে হয়েছে। এটি আসলে আগ্রসী ব্যাংকিং। যারা এ ধরনের ব্যাংকিং করছে আমরা তাদের চিঠি দিয়েছি। এতে তাদের ঝুঁকি কমবে।


তিনি আরও বলেন কিছু ব্যাংকের অলস টাকা পড়ে রয়েছে আর কিছু ব্যাংক আগ্রসী ব্যাংকিং করছে। দুটিই ব্যাংকিং খাতের জন্য ঝুঁকি। এ ঝুঁকি ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। তানাহলে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি আরও বাড়বে।
ঋণ প্রবাহ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে যমুনা ব্যাংকের সিইও নুরুর আমিন বলেন,ঋণ বেড়ে যাওয়া কোন অপরাধ নয়। তবে এটি ব্যাংকিং খাতের জন্য অবশ্যই ঝুঁকি। এটি অবশ্যই কমাতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ প্রবাহ বেড়ে গেলে ব্যাংকিং খাতের জন্য চিন্তার বিষয়। কিন্তু সল্প সময়ের জন্য ঋণ প্রবাহ বাড়তেই পারে।
জানা গেছে,চলতি বছরের শুরুর দিকেই ঋণের সুদ কমানো হয়েছে। একই সাথে কমেছে আমানতের সুদ হারও। এ নিয়ে সরকার ব্যাপক প্রচার করলেও বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি। কিন্তু হঠাৎ করে বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকে ঋণ প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় সঙ্কিত অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকে ঋন প্রবাহ বাড়লেও বিনিয়োগ তেমন বাড়েনি। তাহালে এ ঋণের টাকা কোথায় যাচ্ছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা তারল্যের পরিমাণ ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ আমানত হিসাবে (সিআরআর ও এসএলআর) এবং অন্যান্য খাতে জমা রাখার কথা কমপক্ষে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাবে অতিরিক্ত রয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাতে পড়ে থাকা মোট তারল্যের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা সরকারি বিল বা বন্ডে বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকগুলো। এসব অর্থের কিছু অংশ সরকার ঋণ হিসাবে নিয়েছে। কিছু অংশ মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে মুদ্রানীতির অংশ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে তুলে নিয়ে ভল্টে রেখে দিয়েছে। এর বিপরীতে কোনো আয় না হলেও ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত সুদ দিতে হচ্ছে। কেন না অলস টাকা ব্যাংকের ভল্টে পড়ে থাকলে সেগুলো বিভিন্নভাবে পাচার হয়ে যেতে পারে বা অনুৎপাদনশীল খাতে গিয়ে দেশের মূল্যস্ফীতির হার বাড়িয়ে দিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ধরনের ব্যবস্থাপনাকে অর্থনীতিবিদরা অলস টাকার ব্যয়বহুল ব্যবস্থাপনা হিসেবে অভিহিত করেছেন।


বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে সাড়ে প্রায় ১১ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ হার বেড়েছিল পৌনে ১০ শতাংশ। ওই এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে আমানত বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋনপ্রবাহ বেড়েছে সোয়া ১০ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণপ্রবাহ বাড়ে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। ওই সময়ে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৩ শতাংশ কমেছে, সমহারে বেড়েছে বেসরকারি খাতে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, আগের ঋণকে নবায়ন করে সেগুলোকে নতুন ঋণ হিসাবে দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া এই খাতে ঋণের একটি বড় অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। যা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়লেও তা অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না।


একই সময়ে ঋণের চেয়ে আমানত বেড়েছে প্রায় দশমিক ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর মুনাফা থেকে মূলধন বৃদ্ধি পাওয়া ও রিজার্ভ ফান্ড থেকেও বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ফলে বিনিয়োগের মাত্রা আরও না বাড়ালে অলস টাকার প্রবাহ কমবে না বলে মন্তব্য করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।


বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরের জুলাই মার্চ সময়ে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে গেছে। তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে এনে নিজেদের কাছে রাখতে শুরু করেছেন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ওই সময়ে ব্যাংকবহির্ভূত মুদ্রার পরিমাণ বাড়ে প্রায় ৯ শতাংশ। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ।

http://www.dailysangram.com/post/279799