১৩ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:২৩

আবাসিকে বন্ধ রেখে অবৈধ গ্যাস সংযোগকে বৈধতা দেয়ার হিড়িক

গ্যাসের নতুন আবাসিক সংযোগ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। অথচ এই সময়ের মধ্যে অবৈধ সংযোগের বৈধতা দেয়া হচ্ছে। গত এক বছরে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৫৯৯টি অবৈধ সংযোগের বৈধতা দিয়েছে বিভিন্ন গ্যাস কোম্পানি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০১০ সালের জুলাইয়ে বন্ধ করা হয় আবাসিকে গ্যাস সংযোগ। ২০১৩ সালের মে মাসে তা তুলে দেয়া হলেও ২০১৬ সালের মার্চ থেকে তা পুনরায় বন্ধ করা হয়। তবে মধ্যবর্তী সময়ে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় এক লাখ অবৈধ সংযোগ দেয়া হয়। এছাড়া কয়েক লাখ গ্রাহক নিজ উদ্যোগেই অবৈধ সংযোগ গ্রহণ করেন। এখন অবৈধ এসব সংযোগকে বৈধতা দিচ্ছে তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।

পেট্রোবাংলার সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এ ধরনের সাড়ে ১১ হাজার সংযোগকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। এর প্রায় পুরোটাই দিয়েছে তিতাস ও বাখরাবাদ। যদিও এ সময় কোনো নতুন সংযোগ দেয়া হয়নি। এছাড়া গত অর্থবছর দুই লাখ ৮৮ হাজার ৩৩৩টি সংযোগ দেয়া হয়। এর মধ্যে নতুন সংযোগ ছিল মাত্র ২৩ হাজার ৭৩৪টি। আর অবৈধ সংযোগকে বৈধতা দেয়া হয় দুই লাখ ৬৪ হাজার ৫৯৯টি।

পেট্রোবাংলার হিসাবমতে, নতুন সংযোগ বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের পর চলতি অর্থবছরে নতুন সংযোগ প্রদানে কোনো আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। ফলে নতুন কোনো সংযোগও এ সময় দেয়নি গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলো। তবে এ সময়ে অবৈধ সংযোগকে নিয়মিতই বৈধতা দেয়া হয়। এর মধ্যে ছয় হাজার ৯০৮টি অবৈধ সংযোগকে বৈধতা দেয় তিতাস। আর ছয় মাসে চার হাজার ১৯৭টি গ্যাস সংযোগকে বৈধতা দিয়েছে বাখরাবাদ।

পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি ৪১৯, সুন্দরবন গ্যাস বিতরণ কোম্পানি ২৬ ও জালালাবাদ গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি চারটি সংযোগ প্রদান করে ছয় মাসে। সব মিলিয়ে ১৫ হাজার ৫৪৩টি অবৈধ সংযোগকে বৈধতা দেয়া হয়। তবে কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এ সময় কোনো অবৈধ সংযোগকে বৈধতা দেয়নি।
তিতাসের কোম্পানি সচিব মোশতাক আহমেদ বলেন, ২০১৩ সালে নতুন সংযোগের পাশাপাশি অবৈধ সংযোগের বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে জ্বালানি বিভাগ। সে কমিটি জরিমানাসাপেক্ষে অবৈধ সংযোগকে বৈধতা দেয়ার সুপারিশ করে। এজন্য আবেদনের সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সে সময় যারা আবেদন করেছিল, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সংযোগ দেয়া হচ্ছে। এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া বিধায় এখনও সংযোগে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। তবে যারা আবেদন করেননি, সেগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হয়েছে। নিয়মিতই সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ চলছে।

সূত্র জানায়, অবৈধ সংযোগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ করছেন অনেকেই। তাদের মতে, গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা অবৈধ সংযোগ দিচ্ছেন। পরে সেগুলো বৈধতা দিতে পেছনের তারিখে (ব্যাকডেট) আবেদন জমা দেখানো হচ্ছে। আর এসব অবৈধ সংযোগকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। নতুন সংযোগ বন্ধ থাকায় এ ধরনের তৎপরতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে মোটা অংকের ঘুষ লেনদেন হচ্ছে। আর যারা ঘুষ দিচ্ছেন না, তাদের কোনোক্রমেই গ্যাস সংযোগ মিলছে না।
নাম না প্রকাশ করা শর্তে একজন ভুক্তভোগী জানান, তার বাসায় তিতাসের বৈধ সংযোগ রয়েছে। এর আওতায় দুটি দ্বিমুখী ও একটি একমুখী চুলা রয়েছে। ২০১৬ সালের পর আরও চারটি দ্বিমুখী চুলা বাড়ানোর আবেদন করা হয়। ডিমান্ড নোট ইস্যুর পর সরকারি সব ফিও জমা দেন তিনি। এরপর সরকারিভাবে গ্যাস সংযোগ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এখন আর তার বর্ধিত চুলায় গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। বিল বই না থাকায় এসব সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে বাহানা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান। তিনি বলেন, নতুন সংযোগ বন্ধের পাশাপাশি বিদ্যমান সংযোগেও চুলার সংখ্যা বৃদ্ধি স্থগিত করেছে মন্ত্রণালয়। এজন্য সব ধরনের সংযোগ বন্ধ রয়েছে।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে,২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিতাস ১১ হাজার নতুন সংযোগ দেয়। অথচ এ সময় এক লাখ ২১ হাজার ৯০৮টি অবৈধ সংযোগকে বৈধতা দেয়। একই সময় বাখরাবাদ নতুন আবাসিক সংযোগ দেয় দুই হাজার ৯৮০টি। আর ৮৭ হাজার ৮০০ অবৈধ সংযোগকে বৈধতা দেয়া হয়। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি কোনো নতুন সংযোগ না দিলেও ৩৯ হাজার অবৈধ সংযোগকে বৈধতা দেয়।

এছাড়া জালালাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানি সাত হাজার ৭২৪টি, পশ্চিমাঞ্চল সাত হাজার ৯৮৮টি ও সুন্দরবন ১৭৯টি সংযোগকে বৈধতা দেয়। যদিও কোম্পানি তিনটি এ সময় যথাক্রমে ছয় হাজার ৯৭৪টি, দুই হাজার ৭৪৮টি ও ৩১টি নতুন সংযোগ দেয়। সব মিলিয়ে দুই লাখ ৬৪ হাজার ৫৯৯টি অবৈধ সংযোগকে গত অর্থবছর বৈধতা দেয়া হয়। যেখানে নতুন সংযোগ দেয়া হয় ২৩ হাজার ৬২১টি।

এদিকে গত এক মাসে সারাদেশে ত্রিশ হাজার ৩০টি অবৈধ চুলার গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এছাড়া ৩টি বাণিজ্যিক, ১টি সিএনজি, ৮২ দশমিক ২২ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস পাইপলাইনও বিচ্ছিন্ন করা হয়। চলতি বছরের মার্চ মাসে তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন এন্ড ট্রান্সমিশন কোম্পানি এ সংযোগ বিচ্ছিন করে। তিতাস জানায়, অবৈধ সংযোগ বন্ধে নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল কোট পরিচালনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে গত মাসে ১৮টি অভিযানের মাধ্যমে এই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, গ্যাসের বৈধ সংযোগ বন্ধ রেখে এর সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। এজন্য অবৈধ সংযোগ বেড়েই চলেছে। আবার এগুলোকে বৈধতাও দেয়া হচ্ছে। এতে সাধারণ গ্রাহক প্রতারিত হচ্ছেন। আর অবৈধ সংযোগ উৎসাহিত হচ্ছে। তাই দ্রুত সব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম চালানো উচিত। পাশাপাশি অবৈধ সংযোগকে বৈধতা দেয়ার প্রক্রিয়াও বন্ধ করা উচিত।

http://www.dailysangram.com/post/279667