১৩ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:২০

ঢাবিতে মারাত্মক অব্যবস্থাপনায় চলছে শিক্ষা কার্যক্রম

নেই পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ

বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শ্রেণিকক্ষ সঙ্কট বর্তমানে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সম্প্রতি অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বিভাগ বৃদ্ধি, শ্রেণিকক্ষ বণ্টনে কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম নীতি এ সঙ্কটের মূল কারণ বলে দাবি শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের। এ কারণে চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যেই চলছে ঐতিহ্যবাহী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম। এতে ভোগান্তির অন্ত নেই শিক্ষার্থীদের। সেই সাথে কাস নিতে হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষকেরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি মাত্র শ্রেণিকক্ষ নিয়ে চালু করা হয়েছে নতুন বিভাগ। এ ছাড়াও শ্রেণিকক্ষের অভাবে একই রুমে গাদাগাদি করে কাস করেন শিক্ষার্থীরা। এতে বিঘিœত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। অপরিকল্পিতভাবে বিভাগের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিকল্লিতভাবে কক্ষ বণ্টন না করায় দিন দিন এ সঙ্কট আরো জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

ঢাবিতে শ্রেণিকক্ষের সবচেয়ে বেশি সঙ্কট কলা অনুষদে। ১৯২১ সালে ঢাবি প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত যতগুলো বিভাগ আছে তার অন্যতম কলা অনুষদভুক্ত দর্শন বিভাগ। বিভাগটিতে শ্রেণিকক্ষ সঙ্কটের মাত্র চরম আকার ধারণ করেছে। শ্রেণিকক্ষের অভাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোর্স শেষ করা সম্ভব হয় না। গত ৪ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটায় কলাভবনের ১০২২ নম্বর রুমে দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাস নিচ্ছিলেন কোর্স শিক্ষিক মন্দিরা চৌধুরী। একটু পরেই অন্য একটি বর্ষের শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত কাসের সময় হওয়ায় পাঠদান সম্পন্ন করার আগেই তাদের শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে দিতে হয়। পরে অন্য একটি শ্রেণিকক্ষে কাসের বাকি অর্ধেক শেষ করতে হয় তাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন এ বিভাগের প্রতিটি বর্ষে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও শ্রেণিকক্ষের সঙ্কটে তারা শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে না। মাত্র একটি কাসরুম নিয়ে অ্যাকাডেমিক পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে ঐতিহ্যবাহী এই বিভাগটি। বিভাগের একমাত্র শ্রেণিকক্ষ লেকচার থিয়েটার ভবনের ৩১০ নম্বর কক্ষটি। পরবর্তীতে বিভাগের সেমিনার কক্ষকে (কলা ভবনের ২০২৮ নম্বর) শ্রেণিকক্ষ বানিয়ে সেখানে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হলেও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনায় তা যথেষ্ট নয়। ১২০ জনের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এ শ্রেণিকক্ষে দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর কাস করা সম্ভব হয় না। কেউ কেউ খুব গাদাগাদি করে বসতে পারলেও কাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকে। ফলে তারা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার যথার্থ সুযোগ থেকে। রুমটিতে শিক্ষকের মঞ্চের চারপাশে গোল হয়ে বসতে হয় অনেককে। কাসের বাইরে ও দরজায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকে। লেকচার থিয়েটার ভবনের ৩১০ নম্বর রুমের আকার অপেক্ষাকৃত বড় হলেও সেখানে সাউন্ড সিস্টেম ছাড়া কাস নেয়া সম্ভব হয় না। কাসের অতি মান্দাতার আমলের স্পিকারগুলো শিক্ষকের কথার ভার বহন করতে অপারগ। তাই প্রায় সময়ই স্পিকার ছাড়া শিক্ষকের কণ্ঠের জোরে কাস চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু তাতে পেছনের সারির বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই লেকচার শুনতে পান না। বিভাগটিতে সম্প্রতি সেকশন চালু করা হলেও নানা রকম প্রতিবন্ধকতায় শিক্ষকদের পক্ষে আলাদা কাস নেয়া সম্ভব হয় না। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাদ্দাম হোসাইন বলেন, বিভাগে সেকশন করা হলেও সময় সঙ্কীর্ণতার কারণে এবং একই বিভাগের দু’টি সেকশনে ভিন্ন ভিন্ন কাস নিতে শিক্ষকদের সমস্যা হওয়ায় সেকশনের কার্যকারিতা হারাচ্ছে।

ঢাবির প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগের অন্যতম হলো- আরবি বিভাগ। শিক্ষার্থীবহুল ঐতিহ্যবাহী এই বিভাগের আছে মাত্র দু’টি শ্রেণিকক্ষ : কলাভবনের ৪০০১ ও ৪০৪৬ নম্বর কক্ষ। জানা যায়, কক্ষ সঙ্কটের কারণে বিভাগে কোনো কম্পিউটার ল্যাব নেই। নামমাত্র একটি সেমিনার রুমে পড়ালেখার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। শ্রেণিকক্ষ সঙ্কটের কারণে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাস দুপুরের পরে শুরু হয়। শ্রেণিকক্ষ ফাঁকা না পাওয়ায় মাঝে মধ্যে অন্য বিভাগের কক্ষে কাস করতে হয়। শ্রেণিকক্ষের সঙ্কটের বিষয়ে বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম বলেন, একই সময়ে একই রুমে সিনিয়র ও জুনিয়র শিক্ষার্থীদের কাস থাকায় অনেক সময় ছাত্রছাত্রীদের কথাকাটাকাটি করতে দেখা যায়। ফলে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হয়।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থীদের সমস্যাও প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। দু’টি কাসরুম নিয়ে এ বিভাগের কার্যক্রম পরিচালিত হয় বলে বিভাগীয় সূত্রে জানা যায়। প্রতিটি বর্ষে দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর এই বিভাগে সেকশন করে কাস নেয়া হলেও অনেক সময়ই কাস নেয়ার জন্য শ্রেণিকক্ষ নির্দিষ্ট থাকে না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শেখ আহমেদ নুরুল্লাহ জামী বলেন, কাস রুটিনে স্থান নির্দিষ্ট না থাকায় কাস করার জন্য প্রায় সময়ই ঘুরতে হয় কলাভবনের এদিক-ওদিক। কখনো লোকপ্রশাসন, ইসলামিক স্টাডিজ, ইংরেজি বিভাগের কাসরুমে দৌড়াতে হয়। এভাবে অনেক সময় কাস মিস হয়ে যায়।

শুধু দর্শন, আরবি ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগেই নয়, কলা অনুষদভুক্ত প্রায় বিভাগেই শ্রেণিকক্ষের সঙ্কট প্রবল আকার ধারণ করেছে। সঙ্কটের কারণে মাত্র একটি করে শ্রেণিকক্ষ নিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নৃত্যকলা ও যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ। নৃত্যকলা বিভাগের একমাত্র শ্রেণিকক্ষটি হলো কলাভবনের ১০৩৩ এবং যোগাযোগ বেকল্যের ২০৮৯ নম্বর কক্ষ। বছরান্তে নতুন শিার্থী ভর্তি করায় বিভাগগুলোতে শ্রেণিকক্ষের সঙ্কট আরো বাড়বে।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্র শুরু করলেও কাস করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণিকক্ষ পাচ্ছে না সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স স্টাডিজ বিভাগ। বিভাগের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মিডটার্ম পরীক্ষা শুরু হলেও এখন পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন রুমে গিয়ে শর্তসাপেক্ষে কাস করতে হয় তাদের। দিনের পর দিন ডিন অফিসে জানিয়েও তার কোনো সমাধান হয়নি। ফলে কখনো কলাভবনের যখন যেটায় ফাঁকা থাকে সেটাতেই কাস করতে হয়।
কলা অনুষদ সূত্রে জানা যায়, কলাভবনে শ্রেণিকক্ষ সঙ্কটের মূল কারণ হলো অন্যান্য অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর কার্যালয়সহ অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম এখানেই পরিচালিত হচ্ছে। কিছু কিছু বিভাগ কলাভবন থেকে চলে গেলেও তাদের কক্ষগুলো তারা এখনো ছেড়ে যায়নি। নিজেদের অ্যাকাডেমিক ভবন থাকা সত্ত্বেও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ১৫টি বিভাগের ছয়টি এখনো কলাভবনে। কলাভবন থেকে কার্যালয় স্থানান্তর করলেও সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করেনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ। এ ছাড়া সম্প্রতি চালু হওয়া সমাজবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ এবং জীববিজ্ঞান অনুষদভুক্ত মনোবিজ্ঞান বিভাগের অফিস ও কাস কার্যক্রম চলে কলাভবনেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম নীতির কারণে কলা অনুষদে শ্রেণিকক্ষের সঙ্কট প্রবল হলেও বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে তা নেই। সেখানে বাড়তি শ্রেণিকক্ষ অন্যান্য বিভাগের কাস নেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে যথাযথ বণ্টনের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষ সঙ্কট কাটিয়ে ওটা সম্ভব বলে মনে করেন ঢাবির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

শ্রেণিকক্ষের সঙ্কটকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কট উল্লেখ করে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ে মারাত্মক একটা শ্রেণিকক্ষ সঙ্কট চলছে। বিশেষ করে কলাভবনের কথা বলতে পারি। বিজ্ঞান অনুষদেও এ সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, বছরান্তে বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করায় তাদের জন্য শ্রেণিকক্ষের সঙ্কুলান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তা শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশাল প্রতিবন্ধক। তবে শ্রেণিকক্ষের সঙ্কট নিরসনের জন্য সব বিভাগে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাস নেয়া, বড় আকারের অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং তৈরি এবং বিভাগগুলোর মধ্যে শ্রেণিকক্ষ সমন্বয় করে কাস নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
এমিরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এটা অনেক পুরনো সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালযের দালান-কোঠা তৈরির সময় এ বিষয়গুলো ধারণা করা হয়নি। শিক্ষার্থীদের এ দুরাবস্থা থেকে মুক্ত করতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
সঙ্কটের কথা স্বীকার করে ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শ্রেণিকক্ষের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য কলাভবনের সংস্কার কাজ চলছে। এতে কিছুটা হলেও সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা যাবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/211883