১২ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ১০:৫৫

বিআইবিএমের কর্মশালায় বক্তারা

বড় খেলাপিদের কাছে জিম্মি ব্যাংকিং খাত

সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ৪০ শতাংশ * বঞ্চিত ভালো গ্রাহক, ঋণ পাচ্ছে মন্দরা

বড় খেলাপিদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ অর্থই এসব খেলাপির কাছে আটকে আছে। এদের টাকা আদায়ে মামলা করতে হয়। কিন্তু সে মামলাও বারবার রিটের মাধ্যমে আটকে যাচ্ছে। এরপর কোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে বছরের পর বছর মামলাগুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফলে ব্যাংক কোনো টাকা পায় না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, বর্তমানে সোনালী ব্যাংকে ঋণ অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের হার ৪০ শতাংশ। এছাড়া ভালো গ্রাহকরা বঞ্চিত হলেও ঋণ পাচ্ছে মন্দ গ্রাহকরা।
মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত ব্যাংকিং খাতে ২০১৬ সালে ঋণ বিতরণের ওপর এক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। এতে সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেলাল আহমদ চৌধুরী, মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন, বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী, অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জি ও সোনালী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) সরদার নুরুল আমিন বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালের জুনের শেষে ১০ দশমিক ১ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জুনের পর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসবে। তিনি ব্যাংকারদের উদ্দেশে বলেন, ঋণ দেয়া ও আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন থাকতে হবে। বিশেষ করে ঋণ আবেদন পর্যালোচনা, ঋণগ্রহীতার গুণগত মান এবং সর্বোপরি ঋণ বিতরণে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ভালো গ্রাহকদের সহায়তা দিয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের সহয়তা অব্যাহত রাখতে হবে।
বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন, তারা ভালো গ্রাহ। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের গ্রাহককে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়। অথচ মন্দ গ্রাহকরা ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। যদিও মন্দ গ্রাহককে দেয়া ঋণ কোনো দিন ফেরত আসবে না, এটা সবাই জানে।
সোনালী ব্যাংকের এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, কয়েকটি বড় গ্রাহকের কাছে পুরো ব্যাংকিং খাত জিম্মি। এদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে মামলা করতে হয়। কিন্তু বারবার রিট করে সে মামলাও আটকে দেয়া হয়। তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংকে ঋণ অবলোপন এবং খেলাপির হার ৪০ শতাংশ। তবে প্রকৃত খেলাপি ১০ শতাংশের নিচে। বাকিরা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি। তিনি বলেন, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের পুরোটাই ইচ্ছাকৃত নয়। এখানে কিছু বাস্তব কারণেও খেলাপি আছে। এছাড়া খেলাপি শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, সব ব্যবসায় হচ্ছে। মূলত আমাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। দুটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক একজন ভালো ব্যবসায়ীকে ঋণ দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী বাবার মৃত্যুর পর ছেলে ব্যবসায় লোকসান দিয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক ব্যবসায়ী লোকসান গুনেছে। এসব কারণে কেউ কেউ খেলাপি হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে শুধু খেলাপিই সমস্যা নয়। ঋণ বিতরণ না করাও একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ ব্যাংকাররা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাদের সামান্য কারণে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংকাররা ভয়ে ঋণ দিচ্ছেন না। উল্লেখ্য, বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ঋণ বিতরণের হার মাত্র ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটির ৬২ ভাগ টাকা অলস পড়ে আছে।
বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী বলেন, মাত্র ৩৮ শতাংশ টাকা বিনিয়োগ করে সোনালী ব্যাংক চলতে পারে না। তিনি বলেন, বিদেশি ও কিছু বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু একই পরিবেশে কাজ করে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০ থেকে ৫০ শতাংশ হবে কেন? এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। ঋণের নয়, শুধু আমানতের সুদের হার কমিয়ে সঞ্চয়ে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। অর্থঋণ আদালতে লাখ লাখ মামলা ঝুলে আছে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতকে বাঁচাতে হলে অর্থঋণ আদালতের মামলা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। এছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণেও খেলাপি বাড়ছে। এটা শুভ লক্ষণ নয়।
পূবালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ব্যাপারে কোনো ধরনের দয়া দেখানোর দরকার নেই। তিনি বলেন, ভালো গ্রাহকদের ঋণ রিশিডিউল করা যেতে পারে। কিন্তু মন্দ গ্রাহকদের নয়। অর্থঋণ আদালতের মামলা নিষ্পত্তিতে বিশেষ বেঞ্চ তৈরির আহ্বান জানান তিনি। ব্যাংকারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ব্যাংকে চাকরি করতে এসেছেন, কিন্তু ঝুঁকি নেবেন না, তা হতে পারে না। তিনি বলেন, পুরো ব্যাংকিং খাতের ঋণ বিতরণের হার ৭১ শতাংশ। এটা কিছুতেই মানা যায় না। মেঘনা ব্যাংকের এমডি নুরুল আমিন বলেন, কোনো ব্যাংকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই তাকে গ্রেফতার করা ঠিক নয়। ব্যাংকের সব লোক খারাপ নয়। যদি তাই হতো তবে পুরো ব্যাংকিং পদ্ধতি ব্যর্থ হতো। কিছু লোকের অপরাধের দায় পুরো সেক্টর নেবে না।
বক্তারা বলেন, ব্যাংকিং খাতে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা চলছে। একজনের গ্রাহক অন্যজন ভাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এতে কেউ কেউ আগ্রাসী ব্যাংকিংও করছেন। খারাপ গ্রাহকরা এসে ব্যাংকিং খাতকে নিন্মমুখী করে ফেলছেন বলে অভিযোগ করেন তারা।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/04/12/116964/