১২ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ১০:৫৪

পিআইসি-পাউবো মিলে ভাগাভাগি

‘যদি বলি ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি টাকা নিয়েছেন তাহলে তিনি আমার ওপর হামলা চালাবেন’ * পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে এই কাজ বাস্তবায়ন খুবই জটিল হয়ে গেছে -নির্বাহী প্রকৌশলী

দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের উজানধল গ্রামের একটি বাঁধের নাম ‘তুফানখালী বাঁধ।’ উপজেলার বরাম হাওর রক্ষায় বাঁধটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বাঁধ সংস্কারে বরাদ্দ দেয়া হয় ৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৪ টাকা। বাঁধের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) চেয়ারম্যান ছিলেন ইউপি সদস্য লাল মিয়া। তিনি বাঁধ সংস্কারে ৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা তুলে নেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৫ মার্চ পর্যন্ত তার কাজের পরিমাণ রেকর্ড করে ৫৫ পার্সেন্ট। কিন্তু বাস্তবে এই লাল মিয়া সাড়ে চার লাখ টাকায় ধল গ্রামের ওয়ারিছ মিয়ার কাছে কাজটি বিক্রি করে দেন। চুক্তিতে নেয়া এই মাটির শ্রমিক যেনতেনভাবে বাঁধটিতে কোনোরকম মাটি ফেলে কাজ শেষ করার প্রস্তুতি নেন। এর মধ্যেই উজান থেকে নেমে আসা পানি বাঁধ ভেঙে বরাম হাওরে প্রবেশ করে। তলিয়ে যায় হাজার হাজার হেক্টর বোরো ফসল।
লালমিয়া মেম্বারের কাছ থেকে তুফানখালী বাঁধে মাটি ভরাটের কাজ সাড়ে চার লাখ টাকায় চুক্তিতে নেয়ার কথা স্বীকার করেন ধল গ্রামের ওয়ারিস আলী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘৫৫ জন লেবার নিয়ে কাজ করে আমার লোকসান হয়েছে।’
জানা গেছে, ২০ কোটি টাকার ২৩৯টি প্রকল্পের প্রতিটিতেই প্রকল্প চেয়ারম্যানরা এভাবেই চুক্তিতে মাটি ভরাটের কাজ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া করে। তারা বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব নিয়ে পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় মোটা অংকের টাকা লোপাট করেন। পাউবোর রেকর্ডপত্রে মাটির কাজের পার্সেন্টিজ বাড়িয়ে দিয়ে নেপথ্যে সহযোগিতা করেন পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী, এসডি ও সার্ভেয়াররা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৫ মার্চের আগেই পিআইসি চেয়ারম্যানদের পরিশোধ করা হয় সাড়ে ৯ কোটি টাকা। পরে আরও প্রায় তিন কোটি টাকাসহ মোট ১২ কোটি ৭২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এই টাকার অর্ধেকই ভাগাভাগি করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প চেয়ারম্যান এবং পাউবোর কর্মকর্তারা কিভাবে ভাগাভাগি করলেন তার একটি হিসাব পাওয়া যায় জগন্নাথপুর উপজেলার হলদিপুর চেলাউরা ইউনিয়নের মেম্বার রণধীর দাসের কাছ থেকে। মঙ্গলবার মুঠোফোনে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘৫ লাখ তিন হাজার টাকা বরাদ্দের ৬০ ভাগ (তিন লাখ ১ হাজার ৮শ’ টাকা) পেয়েছি। এর মধ্যে ১৫ পার্সেন্ট (৪৫ হাজার ২৭০) টাকা ঘুষ হিসেবে পাউবোর কর্মকর্তারা কেটে রেখেছেন।’
রণধীর মেম্বারের দেয়া এই তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে ২৩৯টি পিআইসিতে ১২ কোটি ৭২ লাখ টাকা বিল দিয়ে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পাউবোর কর্মকর্তারা।
এদিকে এক প্রশ্নের জবাবে রণধীর দাস বলেন, নলুয়ার হাওর রক্ষা বাঁধে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সুজাত মেম্বারের কাজটি। কিন্তু অত্যন্ত নিন্মমানের কাজ হওয়ায় এই বাঁধটি দিয়ে পানি প্রবেশ করে বিশাল নলুয়ার হাওর তলিয়ে যায়।
১৫ মার্চ স্বাক্ষরিত নির্বাহী প্রকৌশলীর অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, পিআইসি চেয়ারম্যান হিসেবে সুজাত মিয়া নলুয়ার হাওরের ডুমাইখালী ক্লোজার এলাকায় মেরামত কাজ করতে বরাদ্দ পান ১৪ লাখ ১৫ হাজার ৮০৭ টাকা। ১৫ মার্চ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি রেকর্ড করা হয় ৭৫ পার্সেন্ট। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু কাজ হয়েছে তা জানতে যোগাযোগ করা হয় স্থানীয় চিলাউরা গ্রামের বাসিন্দা ও এলাকার হাওর উন্নয়ন পরিষদের সেক্রেটারি শহীদুল ইসলাম বকুলের সঙ্গে। মঙ্গলবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘সুজাত মেম্বার পিআইসির চেয়ারম্যান হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ এই বাঁধের সংস্কার শুরু করলে জানতে পারি নিন্মমানের কাজ হচ্ছে। পরবর্তীকালে সুজাত মিয়াকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে সন্তোষজনক কোনো জবাব পাইনি। একপর্যায়ে গ্রামের বেশ কয়েকজনকে নিয়ে জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার শরণাপন্ন হই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরেজমিন এলাকায় এসে শতভাগ কাজ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। ১৫ মার্চ পর্যন্ত কত পার্সেন্ট কাজ দেখেছেন- জানতে চাইলে বকুল বলেন, ‘এক থেকে দেড় লাখ টাকার কাজের বেশি কিছুতেই হবে না।’ সুজাত মেম্বারের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭৫ পার্সেন্ট কাজ হয়েছে।
এ বিষয়ে বকুল বলেন, ‘পাউবো কর্মকর্তাদের অগ্রগতি প্রতিবেদনের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তারা কমিশন পেয়ে পার্সেন্টিজ বাড়িয়ে দিয়ে বছরের পর বছর ধরে হাওরবাসীর সর্বনাশ করছেন। তিনি বলেন, ‘পানি উন্নয়নের লোক দিয়ে হাওর উন্নয়ন হবে না। অবিলম্বে এই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে।’
নির্বাহী প্রকৌশলীর প্রতিবেদনে দেখা যায়, তার বরাদ্দের অর্ধেক টাকা পরিশোধ করা হয়ে গেছে। সুজাত মেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়। সরেজমিন দেখা যায়, দিরাই উপজেলার বৃহৎ হাওরের একটি ‘বরাম হাওর’। পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কায়ই ভেঙে যায় বাউল শাহ আবদুল করিমের স্মৃতিবিজড়িত নিজ গ্রাম ধলের তুফানখালীর বাঁধ। এরপর আর শত চেষ্টা করেও এলাকার মানুষ এই বাঁধ টিকাতে পারেননি। মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে যায় প্রত্যন্ত হাওর অঞ্চলের কৃষকের সোনালি ফসল। সেই সঙ্গে তাদের স্বপ্নও বানের পানির সঙ্গে ভেসে যায়। স্থানীয় সংসদ সদস্যের মনোনীত লালমিয়া নামে এই মেম্বারের টাকার ভাগাভাগিতে তছনছ হয় হাওরাঞ্চল।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যাদেশ আনার সময়ই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা প্রত্যেক পিআইসির চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ১৫ পার্সেন্ট সিকিউরিটি মানি হিসেবে আদায় করেন। পিআইসির কার্যাদেশ আনতে এমন সিকিউরিটি মানির প্রয়োজন হয় কিনা জানতে চাইলে পাউবোর সিলেটের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো পিআইসি থেকে টাকা আদায় করা যাবে না। এটা অপরাধ। অবশ্যই এটা তদন্ত করা হবে।’
সিকিউরিটি মানির নামে টাকা হাতিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুছ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৬ এপ্রিল যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘আমি বরাম ও চাপটির হাওরে বাঁধ নির্মাণে ২টি পিআইসির চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার প্রতি কাজ থেকে সিকিউরিটি মানির কথা বলে ২০ হাজার টাকা নেয়া হয়।’ একই অভিযোগ করেন তাড়ল ইউনিয়নের মেম্বার রাশেদ মিয়া। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘বোয়ালিয়া বাঁধের প্রকল্প চেয়ারম্যান ছিলাম আমি। ১৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকার মধ্যে ৯ লাখ ৬৬ টাকা আনতে ভ্যাট ও সিকিউরিটি মানি নেয়া হয়েছে।’ কত টাকা নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে রাশেদ মেম্বার বলেন, ‘এই টাকাটা খাতায় লেখা আছে। এখন আমি বাইরে।’ তিনি বলেন, ‘আমি যদি এখন সত্য কথা বলি তাহলে আমাদের বিপদ হয়ে যায়। এখন যদি বলি সেক্রেটারিও (ইউনিয়র যুবলীগ সভাপতি) টাকা নিয়েছে তাহলে তিনি আমার ওপর হামলা চালাবেন। যদি বলি পানি উন্নয়ন বোর্ড টাকা নিয়েছে, তাহলে পরবর্তী বিলে আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন। তাই জিম্মি আমরা। এ জন্য মুখ খুলতে পারতেছি না।’
বরাম হাওরের তুফানখালী বাঁধ ও বোয়ালিয়া বাঁধের কাজ কতটুকু সম্পন্ন ছিল তার খোঁজ করতে গিয়ে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিনের প্রতিবেদনে নজর দেয়া হয়। এতে দেখা যায়, ‘তুফানখালী বাঁধে ইউপি সদস্য লাল মিয়া ৫৫ ভাগ এবং রাশেদ মিয়া ৭০ ভাগ কাজ সম্পন্ন করেন।’ বাস্তবে ১৫ মার্চের আগে এই দুটি বাঁধে কোনো কাজই হয়নি। পানির ঢল নামতে শুরু করলে তাড়াহুড়ো করে মাটি কাটতে শুরু করেন পিআইসির চেয়ারম্যানরা। এমন দুর্নীতি-অনিয়মের খবর পেয়ে ২ এপ্রিল জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম ধল গ্রামের তুফানখালী বাঁধে হাজির হন। এ সময় তিনি পিআইসি চেয়ারম্যান লাল মিয়াকে ডেকে ভর্ৎসনা করেন। পরে অতিরিক্ত লোকজন নিয়ে ওই বাঁধে কাজ শুরু করা হয়। এর পরদিনই বরাম হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। হাহাকার শুরু হয় এই অঞ্চলে। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত সুনামগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, ‘বাঁধ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে তদন্তের আওতায় আনতে হবে। হাওরের মানুষের ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করার দাবি জানান তিনি।
পিআইসির দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন হাওরে বাঁধের ভাঙা অংশ মেরামত। আর ঠিকাদারদের দেয়া হয় নতুন বাঁধ তৈরি ও বাঁধ উঁচুকরণের কাজ। নীতিমালা অনুযায়ী কাজের নির্ধারিত সময় ছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এবার পিআইসির চেয়ারম্যানদের কার্যাদেশ দেয়া হয় প্রায় এক মাস পর।
পিআইসি চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবোর সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘এই কাজটা যদি নির্দিষ্ট কোনো সংস্থা বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে দেয়া যায় সে প্রস্তাব করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। না হয় সেনাবাহিনীকে দিয়ে এই কাজটা করা যেতে পারে। তাতে এলাকায় কাজ হবে এবং শৃঙ্খলা থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে এই কাজ বাস্তবায়ন খুবই জটিল হয়ে গেছে।’ এর কারণ জানতে চাইলে, এই নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, এতগুলো বাঁধ নির্মাণ এলাকা সার্ভে করারও লোক নেই। আগে যে সার্ভেয়ার ছিল তাদের প্রমোশন দিয়ে এসও বানানো হয়েছে। তারা চলে গেছেন। বর্তমান জনবল দিয়ে বাঁধ এলাকা সার্ভে করবে, না পানির লেভেল লিখবে, নাকি স্টিমেট করবে? এ এক বিশাল জটিল অবস্থা।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/04/12/116961/