রূপগঞ্জ : শীতলক্ষ্যা নদীর পানি আলকাতরার মতো হয়ে গেছে। এতে করে নদীর দুই পাড়ে বসবাসরত লোকজন নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে -সংগ্রাম
১২ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ১০:৪৭

ঢাকার পয়োবর্জ্যে বালু নদের পানি পচে আলকাতরা!

“বালু গাঙের (নদ) পচা পানি আমাগো জীবনডা শ্যাষ কইরা দিছে। গাঙততন মাছ ধইরা বেইচ্যা আগে সোন্দরমতন সংসার চালাইবার পারতাম। আর অহন মাছতো দূরের কতা তিতপুডিও নাই। যেই পচা আইলো, আমাগো কফালও খাইলো।” ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ নাসিরাবাদ ইউনিয়নের দাসেরকান্দি এলাকার বিলুপ্তপ্রায় জেলে সম্প্রদায়ের সন্তান রবীমোহন দাস।
এ ক্ষোভ কেবল তার একার নয়। বালু, নড়াই ও দেবধোলাই নদের তীরবর্তী লাখ লাখ মানুষের। হাতিরঝিলে স্বচ্ছ পরিষ্কার পানি থাকলেও রামপুরা স্যুয়ারেজ দিয়েই বালু নদে প্রবাহিত হচ্ছে পচা পানি। ঢাকার উপকণ্ঠ ও রূপগঞ্জের কোল ঘেঁষে প্রবাহমান এককালের খরস্রোতা বালু নদ এখন দূষণ-দখলে মৃতপ্রায়। নয়ন জুড়ানো রূপ তার ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছিল দুই যুগ আগে। নদে এখন মাছ নেই। বেড়েছে মশা ও কীট-পতঙ্গের উপদ্রব। কমে গেছে ফসলের উৎপাদন। সংকট দেখা দিয়েছে তীরবর্তী এলাকার মানুষের খাবার পানির। বেড়েছে রোগবালাই। দূষিত পানির কটু গন্ধে এলাকার মানুষের দুর্ভোগও বেড়েছে। বিপন্ন হয়ে গেছে প্রাণ-পরিবেশ। বিপর্যস্ত মানুষের জীবন।
রাজধানী ঢাকার পয়োবর্জ্য ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য পড়ে এ নদের পানি এখন আলকাতরার মতো কালো হয়ে গেছে। তাই স্থানীয়রা একে ‘পচা’ পানি বলে। ঢাকার ডেমরা, নাসিরাবাদ, বেরাইদ, ডুমনি ও রূপগঞ্জের লাখ লাখ মানুষের অভিশাপ বালু নদের পচা পানি। এ পচা পানি এখন ধীরে ধীরে শীতলক্ষ্যা নদের বিশাল অংশে ছড়িয়ে পড়ছে। পচা পানির প্রবাহ বন্ধ না হলে বিশাল জনগোষ্ঠী হুমকির মধ্যে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
যেভাবে দূষণ : সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শীতলক্ষ্যার মোহনা ডেমরা থেকে বালু নদের শুরু। ডেমরা এলাকা থেকে বালু নদ টঙ্গীতে গিয়ে তুরাগ নদের সঙ্গে মিশেছে। বালু নদ থেকে আবার ছোট দুটি নড়াই ও দেবধোলাই ঢুকেছে ঢাকার রামপুরায়। এ ছোট নদ দুটি দিয়ে ঢাকার মিরপুর, পল্লবী, উত্তরা, গুলশান, তেজগাঁও, সবুজবাগ, মতিঝিলসহ বিশাল এলাকার শিল্প ও পয়োনালার বর্জ্য এসে রামপুরা ব্রিজের নিচ দিয়ে বালু নদে পড়ছে। বছরের পর বছর আবর্জনা পড়তে পড়তে এর পানি এখন বর্জ্য হয়ে গেছে। ঢাকা ওয়াসার একটি সূত্র জানায়, বালু নদের মোট দৈর্ঘ্য ২২ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে দৈনিক ১০ লাখ ঘনমিটার পয়োবর্জ্য, ৫৬ কোটি ঘনমিটার বর্জ্য মেশানো পানি, বিভিন্ন কলকারখানার ৪৫০ ঘনফুট বর্জ্য প্রতিদিন এ নদে পড়ছে। এ ছাড়া বালু, নড়াই ও দেবধোলাইয়ের ওপর রয়েছে হাজারের বেশি ঝুলন্ত পায়খানা। এসব থেকে আরো ৫০০ ঘনফুট পয়োবর্জ্য নদের পানিতে মিশছে।
আটকে গেছে জীবনযাত্রা : সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, বালু নদের পচা পানি লাখো মানুষের জীবনযাত্রাকে আটকে দিয়েছে। একসময় এ নদের পানি খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করতো স্থানীয়রা। এখন খাওয়াতো দূরের কথা পানিতে হাত রাখাও দায়। নদ তীরবর্তী বালুরপাড়, দাসেরকান্দি, বাবুরজায়গা, গৌড়নগর, ধীৎপুর, পশ্চিমগাঁও, দক্ষিণপাড়া, পাতিরা, ইছাপুরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে মানুষের দুর্ভোগ আর ভোগান্তির চিত্র। নদ তীরবর্তী এসব এলাকার বৌ-ঝিরা বলেন, “একসময় এ গাঙের পানি খাইবার পারা যাইতো। এহন পানিতে হাত দিলে চুলকায়। তারপরেও পানির অভাবে এই পচা পানিতে থালা-বাসন ধুতে অয়। অনেকে গোসলও করে। কথা হয় বালুরপাড় এলাকার গৃহবধূ সুমি বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ পানির চাইতে আলকতরাও ভালা। এতো কালা কুৎসিত পানি কোথাও দেখি নাই। পানির অভাবে থালাবাসন পচা পানিতেই ধুতে হয়।
কৃষিতে বিপর্যয় : সরেজমিনে দেখা যায়, নদের একপাড়ে রূপগঞ্জ। অন্যপাড়ে ঢাকার খিলগাওয়ের নাসিরাবাদ, ডেমরা, বেরাইদ ও ডুমনী ইউনিয়ন। নদের উভয় তীরজুড়ে ফসলের ক্ষেত। একসময় এসব জমিতে অধিক ফসল ফলত। দক্ষিণপাড়া এলাকার বর্গাচাষি ফারুক মিয়া বলেন, আগে বিঘায় ধান পাইতাম ৩৫ থেইক্যা ৪০ মণ। আর অহন অয় ১৫ কি ১৬ মণ। স্থানীয় কৃষকরা জানান, বিকল্প উৎস না থাকায় জমিতে তারা বালু নদের পচা পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। এ পানি জমিতে পড়ার সাথে সাথে ধান গাছের চারার গোড়া পঁচে যায়। পঁচে গিয়ে যা টিকে তা-দিয়েই আশা থাকে কৃষকদের। এ বিষয়ে রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার মুরাদুল হাসান বলেন, পানিতে প্রচুর কার্বন-ডাই অক্সাইড থাকায় ধান গাছের গোড়া পঁচে যায়।
বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট : সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, নদের আশপাশের এলাকাগুলোতে অগভীর নলকূপ একেবারেই নেই। পানি থেকে তীব্র কটু গন্ধ আসায় সবাই নলকূপ ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। নাসিরাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দাদের জন্য ছয়টি পাম্প বসানো হয়েছে বিশুদ্ধ পানির জন্য। এভাবে বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে পাম্প বসিয়ে পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কথা হয় ত্রিমোহনী এলাকার ট্রলারের মাঝি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাগো এলাকায় পানির খুবই অভাব। পাম্পের পানির মধ্যেও পচা গন্ধ কয়। খাইতে গেলেও বমি আহে। রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা: মাহমুদুল আক্তার বলেন, বালু নদের পচা পানির কারণে অসুস্থ হয়ে প্রায়ই লোকজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। তবে চর্ম ও ডায়রিয়া রোগী বেশি আসে এসব এলাকা থেকে।
মশা-মাছির যন্ত্রণা : স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মশা-মাছির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে নদপাড়ের লাখো মানুষ। দিনের বেলায়ও মশা থেকে নিস্তার নেই তাদের। রক্ষা নেই মশারি খাটিয়েও। মশা-মাছি নিধনে নেই সরকারি কোনো উদ্যোগ। পচা পানির কারণে মশার উপদ্র্ব বেড়েছে। নগরপাড়া এলাকার ইউপি সদস্য মাসুম আহম্মেদ বলেন, অন্তত মশা থেকে সবাই যদি বাঁচতে পারতো তাহলে শান্তি পেতো। পচা পানি এসব এলাকার মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।
জেলেপল্লীর দুর্দিন : সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বালু নদের তীরঘেঁষে রয়েছে তিনটি জেলেপল্লী। দাসেরকান্দি, চরচনপাড়া ও ফকিরখালীর দেড় শতাধিক জেলে পরিবার এখন নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। বছরের ছয় মাস তাদের কাটাতে হয় অর্ধহারে-অনাহারে। তাই তাদের পরবর্তী পেশা বদলাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বালু নদের পচা পানি। পচা পানি তাদের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। পচা পানির কারণে নদে এখন মাছের পরিবর্তে ভয়ংকর কীট-পতঙ্গ বাস করছে। দাসেরকান্দি জেলেপল্লীর ষাটোর্ধ্ব নরেশ চন্দ্র রাজবংশী বলেন, পচা পানি আমাগো শেষ কইরা দিছে বাজান। গাঙো মাছ কইত্তে থাকব কন। পানি তো বিষ অইয়া গেছেগা। ম্যাচের কাটি পানিতে ফালাইলে আগুন ধইরা যায়। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমির কুমার বসাক বলেন, বালু নদের পানিতে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই অক্সাইড ও মনো অক্সাইড রয়েছে। তাই কোনো জীব বা প্রাণী এ অবস্থায় বাঁচতে পারে না।
দূষণ রোধ হয়নি : জানা গেছে, বালু নদের দূষণ রোধ করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছে। পচা পানি নিয়ে ২০০১ সালের ১১ মার্চ ও ২০০২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ত্রিমোহনীতে দুইবার মহাসমাবেশ হয়েছিল। ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, পচা পানি রোধে বালু, নড়াই ও দেবধোলাই নদের দুই ধারের লাখো মানুষকে বাঁচাতে ৮০০ কোটি ব্যয়ে বিশাল শোধনাগার নির্মাণ করার কথা রয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এ প্রকল্প লাল ফিতায় বন্দি রয়েছে। এ বিষয়ে শীতলক্ষ্যা-বালু বাঁচাও আন্দোলনের নেতা কলামিষ্ট ও গবেষক মীর আব্দুল আলীম বলেন, ‘পচা পানি’ রোধ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত : বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বালু নদের পচা পানি নিয়ে বিভিন্ন সময় এলাকাবাসী আন্দোলন করেছে। ঢাকা শহরের পয়োবর্জ্য বালু নদে পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে ওয়াসার বিরুদ্ধে মামলাও দাযের করা হয়েছিল। তবে সরকারের কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। পচা পানির প্রবাহ বন্ধ না হলে বিশাল জনগোষ্ঠী হুমকির মধ্যে পড়বে।

http://www.dailysangram.com/post/279583-