১২ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ১০:৩৭

জঙ্গিবাদ দমনে পরিবারের ভূমিকা

|| মিজানুর রহমান || সারা বিশ্ব আজ কেঁপে উঠেছে জঙ্গিবাদের হামলায়। ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, তুরস্ক বা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের থাবা; আর ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তো তা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ শকুনীদের নখের আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত। এই দেশের সুখ নষ্টে তারা নানা ষড়যন্ত্র করছে। আর জঙ্গিবাদ তারই এক অনবদ্য অংশ মাত্র। গত বছর এবং চলতি বছরের তিন মাসে দেশের অনেক জায়গায় জঙ্গিরা তাদের অপতৎপরতার জানান দিয়েছে। ১ জুলাই ২০১৬তে উচ্চ সতর্কতার এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজানের সেই হামলা বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা সারা বিশ্বের কাছে হেয় করে দিয়েছে। বিদেশী নাগরিকদের হত্যার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক চাকা রফতানি খাতকে পঙ্গু করাও ছিল এ হামলার অন্যতম কারণ। হলি আর্টিজানের রক্তের দাগ না শুকাতেই শোলাকিয়ার ঈদের নামাযে হামলা। এখানের টার্গেটটা ছিল ব্যাপক প্রাণহাণী করা। কিন্তু সেটি বাস্তবে রূপ নিতে দেয়নি আমাদের সাহসী আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকায় র্যাব ক্যাম্পে পুরুষের আত্মঘাতি বোমা হামলা। ইতালী ও জাপানের নাগরিক হত্যা। যাজক ও পূরোহিত হত্যা ইত্যাদি আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে বারংবার। অতিসম্প্রতি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অনেকগুলো জঙ্গি দমন অভিযান চালিয়েছে। সেগুলো হলো, রাজধানীর কল্যাণপুর, সিলেটের আতিয়া মহল, মৌলভীবাজার, টঙ্গী, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডু ইত্যাদি জায়গায়। আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. আবদুর রব খান মনে করেন, জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের সদস্য সংখ্যা ক্রমাগত বাড়াচ্ছে।
জঙ্গিবাদের সংজ্ঞার দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই যে, জঙ্গি একটি ফার্সি শব্দ। উর্দুতেও এর প্রচুর ব্যবহার আছে। উর্দু আর ফার্সিতে শব্দটা লড়াই বা যুদ্ধ অর্থে ব্যবহার হয়। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ আর জঙ্গি মানে যোদ্ধা, লড়াকু। যেমন স্বাধীনতা যুদ্ধকে উর্দু ফার্সিতে জঙ্গে আজাদি বলা হয়, আর স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের বাংলায় মুক্তিযোদ্ধা বলে আর উর্দু ফার্সিতে বলে জঙ্গিয়ে আজাদি। ফার্সি আর উর্দুতে জঙ্গি একটি সম্মানিত শব্দ। যারা অন্যায় অত্যাচার আর জুলুম নির্যাতনের বিপক্ষে এবং ন্যায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করে তাদের সম্মানের চোখে দেখা হবে সেটাই স্বাভাবিক। যেমন ’৭১ সালে যারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলেন তারা আমাদের কাছে অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। আমাদের গৌরব। তারা বাংলায় মুক্তিযোদ্ধা আর উর্দু ফার্সিতে জঙ্গি। এই অর্থে জঙ্গি একটি সম্মানিত শব্দ। তুরস্কের জঙ্গি রাজবংশের শেষ শাসক, বায়তুল মুকাদ্দাসের পুনরুদ্ধারের স্বপ্নদ্রষ্টা, ন্যায়পরায়ণ শাসক নূর উদ্দিন জঙ্গিকে এখনও মুসলমানরা সম্মানের চোখেই দেখেন। কারণ যেভাবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা অন্যায়ের বিপক্ষে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলেন তিনিও অন্যায়ের বিপক্ষে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলেন। মতিঝিলে পীর জঙ্গি নামে একটি মাজারও আছে। অসংখ্য লোককে দেখা যায় নিজের কল্যাণের জন্য পীর জঙ্গির মাজারে যেতে। হয়তো বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বা গণমাধ্যমে শব্দটিকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যারা ইসলামের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষ হত্যা করে ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তারা হতে পারে সন্ত্রাসী বা আতঙ্কবাদী। জঙ্গির মতো এ রকম একটা সম্মানসূচক উপাধি তাদের সাথে কস্মিনকালেও মানানসই নয়। বরঞ্চ এটি সেই সম্মানসূচক শব্দের অপমানই বটে। সে যাই হোক যেহেতু এই শব্দটি নেতিবাচক বিষয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আমি সেই শব্দ ব্যবহার করেই লিখবো।
জঙ্গিবাদের উত্থান সম্পর্কে আমরা খোঁজ নিলে জানতে পারি যে, ইসলাম মানে শান্তি এবং প্রকৃত ইসলামে অশান্তি, মানুষ হত্যা ও বর্বর হামলার স্থান নেই। তবে কেন অনেক মুসলমান সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের পথে গেল এবং যাচ্ছে? দেশে দেশে কিছু দেশীয় উগ্রবাদী ও জঙ্গি থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি তৎপরতার মূল উৎপত্তিস্থল আফগানিস্তান, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ। যুগ যুগ ধরে পশ্চিমা শাসন-শোষণ ও বঞ্চনার শিকার এই অঞ্চলের মানুষেরা। এই শতাব্দীর শুরুর দিকে নেতৃত্ব পরিবর্তনের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং তাদের সহযোগী কিছু দেশ যুদ্ধ চালায় আফগানিস্তান এবং ইরাকে। কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ মনে করেন, 'ইসলাম ধর্মের বিকৃত ও মনগড়া ব্যাখ্যাদানকারী উগ্রবাদীদের প্ররোচনা ও পরিকল্পনা রয়েছে এগুলোর পেছনে। আধুনিকতার নামে বেলেল্লাপনা নয়, স্বেচ্ছাচারিতা নয়, কূপম-ুকতা নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা নয়, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা উচিত। আজ দেশের প্রগতিশীলতার নামে অনেকেই এই বিভাজনটি ভুলে যান। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইতঠঔঢপাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি মতবিরোধ, ভারতে কাশ্মীর সমস্যা এবং হিন্দুত্ববাদ, আর বাংলাদেশে এটাকে রাজনৈতিকভাবে জামাতে ইসলামী বা এই ধরনের দলগুলোর সাথে প্রগতিশীল রাজনীতির যে একটি বিরোধ, এইগুলোর মধ্যে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে।’
জঙ্গিবাদের এ বিষবাস্প কি দিন দিন ছড়াবে? এর কি কোনোই সমাধান নেই? অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবীগণ মনে করেন রাষ্ট্রীয়ভাবে জঙ্গিবাদকে দমন করার পাশাপাশি সামাজিকভাবে আমাদের অনেক করণীয় আছে। আজ সময় এসেছে সামাজিকভাবে সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। সরকার যেখানে জঙ্গি ঘটনায় জিরো টলারেন্স দেখাতে বদ্ধপরিকর সেখানে জনগণ, স্থানীয় সংসদ সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের উচিত ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিকভাবে দুর্বার আন্দোলন করা। জঙ্গিবাদের উত্থান অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে হবে। সবচেয়ে বড় ও কার্যকরি পদক্ষেপ হচ্ছে পারিবারিকভাবে এ ক্যান্সারকে প্রতিহত করা। কেননা একটি সন্তানের ওপর তার পরিবারের শিক্ষা সারা জীবন প্রভাব ফেলে। যেকোনো বিষয়েই পরিবারের ভিতরে সমাধান পাওয়া যায় সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সাথে। চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে বাবা-মাকেই বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। প্রত্যেক পরিবার যদি তাদের সদস্যদের ব্যাপারে সচেতন হন তাহলে সন্তানরা জঙ্গিবাদে জড়াবে না।’ এ দেশের মা-বাবাদের কাজ হওয়া উচিত তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় পারদর্শিতা দেখানোর মেশিন না বানিয়ে তাদের এমনভাবে উদ্বুদ্ধ, উৎসাহিত এবং সহযোগিতা করা, যাতে যখন তারা বড় হতে থাকবে তখন তাদের মানস ও মননশীলতা, মানবিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে উঠতে পারে। অবশ্যই পড়াশোনায় তাদের যথাযথ সময় ও মনোযোগ দিতে হবে, যাতে তারা আলোকিত ও দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। মা-বাবাদের তা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হতে হবে। তবে পাশাপাশি খেলাধুলা, শরীরচর্চা, সুকুমারবৃত্তির অনুশীলনের পরিমিত ব্যবস্থা থাকতে হবে তাদের জন্য। এদিকেও মা-বাবাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। সন্তানরা যখন বড় হতে থাকবে তখন মা-বাবা ও অভিভাবকদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে তারা কোথায় যায় এবং কাদের সঙ্গে মিশে সেদিকে নজর রাখা। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এ কাজটি যেন ছেলেমেয়েদের মৌলিক স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা ক্ষুণœ না করে। মাদকাসক্তি বা জঙ্গি মানসিকতার মানুষের সঙ্গে যদি কেউ মেলামেশা করছে বলে জানা যায় তবে তা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং নিজেদের দ্বারা তা সম্ভব না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাকে জানানো জরুরি। আগে ঢালাওভাবে শুধু মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্রদের জঙ্গি তকমাটি দেয়া হতো। কিন্তু এখন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়াদের তাদের থেকেও ভয়াবহ হামলায় দেখা যাচ্ছে। এগুলোদৃষ্টে স্পষ্টই মনে হচ্ছে পারিবারিক উদাসিনতা। আমি যখন মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম আমাদের বাড়িতে একজন জেএমবির দাওয়াত নিয়ে এসেছিল। বড় ভাই একজন আলেম ব্যক্তি। তিনি তাদের সাথে আমাকে কথা বলা তো দূরের কথা সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে দেননি। প্রত্যেকটি পরিবারে যদি উঠতি বয়সের রোমান্সপ্রিয় সন্তানদের প্রতি বন্ধুসুলভ তদারকি থাকে তাহলে এই জঙ্গিবাদের ক্যান্সারের ভাইরাস দ্বারা আক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ফাইজুল্লাহ ফাহিমের মতো একজন নিভৃতচারী কিশোরকে কিভাবে জঙ্গিবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে তা সবাই গণমাধ্যমের কল্যাণে জানি। মূলত এ সবের পিছনে আধুনিকতা ও তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সাথে আমাদের ভিতরে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তার ফল মাত্র। বর্ণচোরা সনেটার নামক একজন কবি বলেছেন: ‘তথ্য প্রযুক্তি দিলো আমাদের, দারুণ এক গতি। বদৌলতে সবার কেড়ে নিলো, হৃদ কোমল মতি।’ গুলশান ট্রাজেডির অন্যতম নায়ক রোহান বিন ইমতিয়াজের বাবার মন্তব্য: '“আমার ছেলে যখন এ লেভেলে সে পর্যন্ত তার দিকে বেশি খেয়াল রাখতাম। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ওঠার পর কি আর ওইভাবে খেয়াল রাখা যায়?” এভাবেই প্রিয় সন্তানদের সাথে তৈরি হচ্ছে দূরত্ব। ফলে তারা হতাশায় ভুগছে ও কুপথে পা বাড়াতে দ্বিধা করছে না। পক্ষান্তরে সাময়িক কিছু ঘটনা আশার সঞ্চার করে মনে। ২৫ মার্চ ’১৭ যমুনা নিউজের বরাত দিয়ে বলতে পারি, ‘রাজধানীর মিরপুরের কাফরুল এলাকায় সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে দুই ছেলেকে থানায় সোপর্দ করেছেন তাদের বাবা। তারা হলো দ্বীন ইসলাম ওরফে দিনু (২৫) ও সালমান সাজীদ (২২)।’ আরো একটি ঘটনার উল্লেখ করতে পারি ২৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে দেশের অনেক গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে, ‘ছেলের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠায় নিজেই ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ করলেন মা আজমিরা খাতুন। বুধবার (২৮ অক্টোবর) পাবনা সদর উপজেলার মজিদপুর গ্রামে রাকিবুলের মায়ের উদ্যোগে তার বাবা, চাচা ও স্থানীয় কয়েকজনের উপস্থিতিতে তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়া হয়।’ উপযুক্ত দু’জন যেমন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন আমাদেরও তেমন দৃষ্টান্ত তৈরি করা দরকার। সুতরাং আসুন সবাই মিলে আমাদের দেশ মাতৃকাকে রক্ষা করি শকুনীদের নখের আঁচড় থেকে। নিজ পরিবারের সবার প্রতি হই বন্ধুুসুলভ। দূরত্ব ভুলে ভালোবাসা ও সম্প্রীতিতে গড়ে তুলি সংসার। এভাবেই একদিন জঙ্গি নামক ক্যান্সারের ভাইরাস মুক্ত হবে এ দেশ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, জঙ্গিরা ইসলামের নাম ব্যবহার করছে। সুতরাং ইসলামের সঠিক শিক্ষা, সঠিক রূপ তুলে ধরেই জঙ্গিবাদের গোড়া কাটা সম্ভব। এটা পারে সচেতন আলেম সমাজ এবং মূল ইসলামী দলগুলো। জেএমবি’র প্রথম উত্থানের সময় তারা তা করিয়েও দেখিয়েছে। শুধু রাজনৈতিক কারণেই তাদেরকে বাঁকা চোখে দেখা হচ্ছে।
-লেখক : এম ফিল গবেষক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, persianmizan@gmail.com

 

http://www.dailysangram.com/post/279576-