১২ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ১০:৩৬

দিল্লির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন মমতা

সহজ কথা

|| আলফাজ আনাম ||

জল দেবো কোত্থেকে! তিস্তার জলে অনেক ঝামেলা আছে। আমরাই তো ব্যবহার করে সারতে পারছি না। বাংলাদেশের জন্য খুব খারাপ লাগে! ওরা বারবার জল চাইতে আসে; কিন্তু দিতে পারি না। কোত্থেকে দোবোÑ তিস্তায় তো জলই নেই!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী
মমতা কী বলেন-না-বলেন সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা স্বাধীন। আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক। সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমরা চুক্তি করব ভারত সরকারের সাথে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সাথে নয়। ফলে মমতার বিষয়টি তাদের অভ্যন্তরীণ, তার সমাধান তারা করবে কি না, কিভাবে করবে সেটা তাদের বিষয়। আমাদের দাবি হচ্ছে, সচিবপর্যায়ের অনুস্বারিত খসড়া তিস্তাচুক্তি দ্রুত অনুমোদন করে ভারত সরকারকে তা এগ্রিমেন্টে রূপ দিতে হবে। তিস্তা ছাড়াও অভিন্ন নদী অববাহিকাসংশ্লিষ্ট সব সমস্যার সমাধান হতে পারে তিস্তাচুক্তির সমাধানের মধ্য দিয়ে। সব কিছু এর সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট।
আইনুন নিশাত, পানিবিশেষজ্ঞ
ভারতের ওপর বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের কোনো সময় আস্থার অভাব ছিল না, এখনো নেই। স্বাধীন দেশ হিসেবে যেকোনো দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমমর্যাদা ও স্বার্থের দিকটি কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব। দুই দেশের সরকারপ্রধান বা সরকারি কর্মকর্তারা যতই বলুক বন্ধুত্বের মাত্রা হিমালয়সম; কিন্তু দেশের মানুষ যদি মনে করে এ সম্পর্ক প্রতারণার তাহলে তা কোনোভাবেই টেকসই হবে না। দেশের সাথে সম্পর্ক আর কোনো বিশেষ দলের সাথে সম্পর্ক এক নয়। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে কতগুলো চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে গণমাধ্যমে এসেছে ১৬ সমঝোতা স্মারক ও ছয়টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কতটা চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে গুনে দেখিনি।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরের আগে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ছিল এবং আছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা এ ধরনের চুক্তি বা সমঝোতা থেকে বিরত থাকার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের সাথে অস্ত্র গোলাবারুদ কেনাসহ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা বা কাঠামোগত চুক্তি হয়েছে। এর বিশদ এখনো প্রকাশ হয়নি। এই চুক্তি বা সমঝোতার ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ ছিল বেশি। ভারতের সেই আকাক্সা পূরণ হয়েছে। অপর দিকে বাংলাদেশের মানুষের আশা বা আকাক্সা ছিল তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে। কিন্তু সেই আকাক্সা পূরণ হয়নি। তবে আশ্বাস পাওয়া গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই আশ্বাস দিয়েছেন, তার ও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তিস্তাচুক্তি হবে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল ভারতের এ আশ্বাসের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন। তখন এমন কথা বলা হয়েছিল দুই দেশ চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছেছে। সচিবপর্যায়ের বৈঠকে খসড়াও চূড়ান্ত করা হয়েছিল। মনমোহন সিংয়ের সাথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাকি ঢাকা আসার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে তিনি আসতে রাজি হননি। শুধু তিনি না আসার কারণে বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজি না হওয়ায় তখন চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। পরে আমরা দেখলাম মোদির সাথে মমতা ঢাকা এলেন। কিন্তু চুক্তি আর হলো না।
এবার প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় দিল্লিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মোদি-হাসিনা-মমতা ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এরপর মমতা তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে তার যে অবস্থান তুলে ধরেছেন, তাতে আগামী দিনে এই নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে চুক্তি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রকৃতপক্ষে তিস্তাচুক্তি নিয়ে বাংলাদেশকে বারবার ব্লাকমেইল বা প্রতারণা করেছে ভারত। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এতে মমতার কোনো রাজনৈতিক ক্ষতি নেই। প্রকৃতপক্ষে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে মমতার এ অবস্থান নিছক তার ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি ভারত রাষ্ট্রের অবস্থান। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য অতীতেও প্রকাশ্যে এ ধরনের পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু গোপনে তাদের অবস্থান থাকে এক ও অভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতের সময় কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী স্পষ্ট করেই বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন। বাংলাদেশের মানুষকে এভাবে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, কেন্দ্র চাচ্ছে কিন্তু রাজ্য না চাওয়ার কারণে তিস্তাচুক্তি হচ্ছে না। যেন তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ এখন কলকাতার দয়ার ওপর নির্ভরশীল। লেখার শুরুতে মমতার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। তিনি এমন ভাষায় কথা বলছেন যেন তিস্তার পানি পাওয়া তার অনুগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর তা দিতে পারছেন না বলে খারাপ লাগছে। কার্যত এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌম অবস্থানকে খাটো করে ফেলা হচ্ছে। কারণ তিস্তার পানি পাওয়ার বিষয়টি মমতা কিংবা মোদির অনুগ্রহের বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের অধিকার। যেমন এই অধিকারের বলে বাংলাদেশের সাথে ১৯৯৬ সালে গঙ্গাচুক্তি হয়েছিল। এর আগে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে সমঝোতা হয়েছিল। দিল্লি বারবার পরিকল্পিতভাবে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনায় মমতাকে সামনে টেনে আনছে। ভারতের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বী মমতা। কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের মানুষকে বোঝাতে চায় তিস্তাচুক্তি করতে হলে মমতার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশের প্রধান সব রাজনৈতিক দল ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা সমঝোতার ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করেছে। এর পরও প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের সমঝোতা বা চুক্তি করেছেন। কিসের বলে তিনি এ ধরনের সমঝোতা করতে পারেন? এ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের দেউলিয়াত্বের কারণে এখন ভারতের একটি প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এমন কথা বলতে পারছেন। ভারত সরকার যদি সত্যিই মমতা রাজি না হওয়ায় তিস্তাচুক্তি করতে না পারে তাহলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরোধী রাজনৈতিক দলের আপত্তি উপেক্ষা করে এমন চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করা যে উচিত হয়নি তার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে। ক্ষমতাসীনদের আগামী দিনে এসব প্রশ্নের জবাবই শুধু দিতে হবে না, এর জন্য অনেক বেশি রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে।
বাংলাদেশের সরকার সমর্থক গণমাধ্যমে তিস্তাচুক্তি না হওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দোষারোপ করার চেষ্টা করা হয়। যেন মমতা চাইছে না বলে চুক্তি হচ্ছে না। আর মোদি বাংলাদেশ অন্তঃপ্রাণ, দয়ার সাগর। যত নষ্টের গোড়া মমতা। আসলে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে মোদি-মমতা সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি চলছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত এমন কোনো রেকর্ড নেই যে, পশ্চিম বাংলা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তা ফারাক্কা বাঁধ চালু করা কিংবা গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি, ছিটমহল বিনিময় যা-ই হোক না কেন। ভারতের কূটনীতিতে পশ্চিম বাংলাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের এ বাস্তবতা বুঝতে হবে ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হবে সরাসরি দিল্লির সাথে। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো প্রদেশকে টেনে আনা বাংলাদেশের মর্যাদার জন্য হানিকর। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও তা নিরসনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের। ড. আইননু নিশাত যথার্থই এই দিকটি সামনে এনেছেন। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। তিস্তা নদীর পানি সেচকাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিশাল সেচ প্রকল্প রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক আইন ও নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। উজানের দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক কোনো নদীর পানি কোনো দেশ এককভাবে ব্যবহার করতে পারে না। আজকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, তিস্তার পানিতে তাদের হয় না বাংলাদেশকে কিভাবে দেবেন। একই বক্তব্য আগামী দিনে চীনের কাছ থেকেও আসতে পারে। ভারত সফরের আগে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনায় চীনকে সম্পৃক্ত করা উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। তার এ মন্তব্যে দিল্লি ভীষণ নাখোশ হয়েছিল।
ভারতের গণমাধ্যমে মাতম শুরু হয়েছিলÑ বাংলাদেশ কেন নদী ব্যবস্থাপনায় চীনকে সম্পৃক্ত করতে চায়। এ জন্য হতাশা প্রকাশ করা হয়েছিল। মমতাকে দিয়ে ভারত তিস্তার ওপর একক কর্তৃত্ব দাবি করছে। বাংলাদেশকে অনুগ্রহ করতে পারছে না বলে দুঃখ প্রকাশ করছে। একই বক্তব্য ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে চীনও দিতে পারে। চীন ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বিশাল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে বলে ভারতের উদ্বেগের শেষ নেই। এখন চীন বলতে পারে এই নদের পানি তাদের ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট নয় অথবা নদের পানি প্রত্যাহারে যেকোনো স্থাপনা তারা নির্মাণ করতে পারে। তাহলে কী বলার থাকবে ভারত বা বাংলাদেশের?
বাস্তবতা হচ্ছে ভারতের সাথে দেনদরবারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার সব কার্ড হারিয়ে ফেলেছে। ফলে ভারত এ ধরনের সুযোগ নিচ্ছে। যেহেতু দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তিস্তার পানিবণ্টনের পথ রুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে এ কারণে বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলা উচিত। আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সহযোগিতা চাওয়া উচিত। এখন থেকে যেকোনো নদীর পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা শুরু করা দরকার। এ ক্ষেত্রে চীন ও নেপালকে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট ভারত এ দেশের সাথে বৈরী আচরণের নীতি থেকে সরে আসেনি। সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের যেসব কথা বলা হচ্ছে তা একান্তই ভারতের স্বার্থজনিত। ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারতকে খুশি করার নতজানু নীতি বাংলাদেশকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে। অপর দিকে হাত মুচড়িয়ে বা চাপ দিয়ে ভারত প্রতিবেশী সব দেশের সাথে এমন আচরণ করেছে। কিন্তু নেপাল, শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপ কোনো দেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আমলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনভীতি এখন প্রকটভাবে কাজ করছে। এ ভীতির কার্যকারণ ও পরিবেশ ভারত নিজেই সৃষ্টি করেছে। চাপ প্রয়োগ ও প্রতিবেশী দেশের মানুষের চেয়ে বিশেষ কোনো দলের সাথে সম্পর্কের নীতি ভারতের ওপর এ অঞ্চলের দেশগুলোর আস্থাহীনতার প্রধান কারণ।
alfazanambd@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/211451