১১ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৪৮

অবশেষে প্লট না পাওয়া ৪৫ ট্যানারি মালিক পুঁজি হারিয়ে রাস্তায়

রাজধানীর হাজারীগের ট্যানারি পল্লীতে নেমে এসেছে হতাশা। পুঁজি হারিয়ে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে হাজারিবাগের এসব ট্যানারি মালিকরা। একইভাবে হাজার হাজার শ্রমিক তাদের বন্ধ হওয়া কারখানার সামনে বসে রয়েছে। তাদের আর কর্মসংস্থান হবে কিনা তা জানেনা ট্যানারি শ্রমিকরা। বিশেষ করে যে ৪৫টি ট্যানারি মালিক সাভারে কোন প্লট বরাদ্দ পায়নি তাদের অবস্থা কি হবে তা জানেনা কেউ। এতে প্রায় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক। এসব ব্যবসায়ীদের দাবি এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সাভারে তাদের নামে প্লট বরাদ্দ দেয়া।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে রাজধানীর হাজারীবাগের সব ট্যানারিতে (কারখানা) বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন শেষ হয় গতকাল। অবশেষে আদালতের রায়েই ইতি টানতে যাচ্ছে রাজধানীর হাজারীবাগে গড়ে ওঠা ৬৭ বছরের চামড়া কারখানার। এ সব ইউটিলিটি লাইন ছিন্ন সমাপ্ত করেছে পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃপক্ষ। এতে করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন এই পল্লীর চামড়া ব্যবসায়ীরা।
যে ৪৫টি ট্যানারি মালিক কোন প্লট পায়নি এতে বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। তারা যদি কোন প্লট বরাদ্দ না পায় তাদের এ বিনিয়োগের অবস্থা কি হবে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক তাদের কর্মসংস্থান হবে কোথায়। তাদের সংসার চলবে কিভাবে। তারা বলেন, আমরা তো সরকারের কোনো আদেশ আমান্য করিনি। প্লট পেয়ে যদি আমরা কারখানা স্থনান্তর না করতাম তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নিতে পারতো। আমাদের কোন অপরাধে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো আমরা তা জানিনা। আমাদের হাজার কোটি টাকার উপরে ব্যাংক ঋণ রয়েছে। রয়েছে প্লট বরাদ্দের কাগজপত্র। তাহলে এসব ঋণ আমরা কিভাবে পরিশোধ করবো। আমাদের দেউলিয়া হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে হাজারিবাগের নিজ নিজ কারখানার সামনে অবস্থান নেয়া চাকুরি হারা এসব ট্যানারি শ্রমিকরা। এসব শ্রমিকদের অধিকাংশই হলো নারী। এসব নারীদের সংসার রয়েছে হাজারিবাগ এলাকায়। তাদের ছেলে মেয়েরা হাজারিবাগ এলাকায় লেখা পড়া করেন। এসব পরিবারের কি হবে তা কেউ বলতে পারছে না।
অসহায় এসব নারী শ্রমিকরা মিডিয়ার কোনো প্রতিনিধি দেখলেই কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকার আর মালিক পক্ষের রশি টানাটানিতে তারা আজ বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের কি অপরাধ তা তারা জানেনা।
অনেক শ্রমিকের বেতনও পাওনা রয়েছে। এসব পাওনা তারা কবে পাবে তারা তা জানেনা। কারণ ট্যানরি মালিকের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে মালিক তাকে কিভাবে বেতন পরিশোধ করবে।
শাহীন আহমেদ বলেন, হাজারীবাগের চামড়াশিল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে প্রায় ৫০ লাখ লোক বেকার হবে। আমরা আদালতের রায় মেনে নিয়ে সরকারের কাছে চার মাস সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার সে সময় না দিয়ে সব ধরনের লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এতে করে ট্যানারি মালিকদের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। একইভাবে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সব শ্রমিকরাই বেকার হয়ে পড়বে। সরকার যদি এতে কর্মসংস্থান এবং চামড়াশিল্পের ভবিষতের কথা বিবেচনায় না নেয় তাহলে এই ক্ষতির জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা যারা প্লট পেয়েও সাভারে কারখানা স্থানান্তর করিনি তারা না হয় অপরাধ করেছি। কিন্তু যারা কোনো প্লট বরাদ্দই পায়নি তাদের কী অপরাধ। কোন অজুহাতে তাদের লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তাদের বিনিয়োগের কি হবে। তাদের সব অর্ডার বাতিল হয়েছে। তাদের শ্রমিকরা চিরতরে বেকার হয়ে পড়ছে। সরকার তাদের কথা চিন্তা না করে এভাবে রায় দেয়া কতটা মানবিক তা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, এখনও পর্যন্ত সাভারের হেমায়েতপুরের হরিনবান্দা এলাকায় অবস্থিত ট্যানারি পল্লীতে ৫৫টি কারখানা চালু হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আরও প্রায় ২০টি কারখানা চালু হওয়ার কথা রয়েছে। হাজারীবাগের ১৫৪টি ট্যানারি কারখানাকে সাভার চামড়াশিল্প নগরীতে প্লট বরাদ্দ দিলেও বেশিরভাগ কারখানার অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। এখনও ফাঁকা পড়ে আছে বেশ কয়েকটি প্লট। কিছু প্লটে নির্মাণকাজ শুরু করেও বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। যেসব কারখানা ভবন নির্মাণ শুরু করা হয়েছে, তার মধ্যে ৩০টির মতো ট্যানারির এক তলার কাজও শেষ হয়নি। কেউ কেউ এক তলার ছাদ ঢালাইয়ের প্রস্তুুতি নিচ্ছেন। কেউ করছেন পাইলিংয়ের কাজ। নির্মাণাধীন ভবনে ৫৪টি কারখানায় কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ শুরু করেছে।
১৯৫০ সালে ট্যানারি কারখানা নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাশ থেকে সরিয়ে রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর পাশে হাজারীবাগে নেয়া হয়। এখন তা সরিয়ে আবারও সাভারের হেমায়েতপুরের হরিনবান্দা গ্রামের ধলেশ্বরী নদীর পাশে নেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হাজারীবাগের ট্যানারিতে ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করে। এসব ট্যানারির ওপর নির্ভর করছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা।
সালেহা বেগম। বগুড়া থেকে আসা এই নারী গত ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন রাজধানীর হাজারীবাগে অবস্থিত এপেক্স ট্যানারিতে। ৯০০ টাকা দিয়ে কাজ শুরু করা সালেহার এখন মাসিক বেতন ছয় হাজার টাকা। রিকশাচালক স্বামীর উপার্জন ও নিজের এ স্বল্পআয়ে কোনোমতে চালিয়ে নেন সংসার।
স্বামীর পাশাপাশি নিজের আয়ের কারণে দীর্ঘদিন ধরে পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সালেহা এখন বেকার। কারণ আদালতের নির্দেশে হাজরীবাগে থাকা ট্যানারির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর।
সালেহা জানান, মাসিক ৯০০ টাকা বেতনে ১৫ বছর আগে এখানে কাজ শুরু করেন তিনি। এখন মাসে ছয় হাজার টাকা বেতন পান। পাশেই ঘরভাড়া নিয়ে পরিবার নিয়ে থাকেন তিনি। স্বামী রিকশা চালায়। দু’জনে মিলে যে আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে।
এই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সময় বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বিক্ষুব্ধ সালেহা বলে ওঠেন, ‘স্যার আমরা কই যামু, কী খামু। মালিকগো তো অনেক টাকা আছে, তাগো সমস্যা হইবো না।
তিনি জানান, হাজারীবাগ থেকে কারখানা সাভারে সরিয়ে নিচ্ছে। ওখানে (সাভারে) তাদের থাকার জায়গা নেই। তাদের পক্ষে এখান থেকে ওখানে গিয়েও কাজ করা সম্ভব নয়। ফলে এখন বেকার হয়ে যেতে হবে তাদের। বেকার হলে কী করবেন, কী খাবেন। তাদের কথা কেউ ভাবে না।
এপেক্স ট্যানারির আরেক শ্রমিক বরিশালের সাহিদা বলেন, স্যার আমাদের কথা কে শুনবো। গরিবের কথা কেউ শুনে না। দুইডা মাস পাইলে আমরা বেতন ও ঈদের বোনাসটা পাইতাম। এখন কাজ বন্ধ হইয়া গেলে ঈদের বোনাস তো পামু না। বেতনও আটকে যাইতে পারে।
তিনি জানান, চার বছর ধরে ট্যানারি কারখানায় কাজ করছেন। সামনের ঈদ নিয়ে অনেক পরিকল্পনা ছিল। ছেলে-মেয়ে আছে তাদের নতুন পোশাক, ভালো খাবার দেয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এখন সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভালো খাবার তো দূরের কথা, ছেলে-মেয়ের মুখে ঠিকমতো খাবারও তুলে দিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
রুমা ট্যানারির দুই শ্রমিক বাদল ও তরুণ বলেন, আমাদের দুই মাসের (ফেব্রুয়ারি ও মার্চ) টাকা একসঙ্গে দেয়ার কথা। সেইসঙ্গে সামনে ঈদের বোনাস পাওয়ার কথা। কিন্তু এখন ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেলে বকেয়া টাকা তো আর পাব না। ঈদের বোনাসও হবে না।
হাজারিবাগে ট্যানারি বন্ধ হওয়াতে সালেহার মতো হাজারো নারী বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের কর্ম সংস্থনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তারা সংসার নিয়ে কোথায় যাবে তা তাদের জানা নেই। সরকার কারখানা বন্ধে নির্দেশ দিলেও শ্রমিকদের পাওনা এবং কর্মসংস্থান নিয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। এতে করে হতাশ শ্রমিকরা।
যারা প্লট পায়নি সেসব কারখানার শ্রমিকরা আর চাকরি ফিরে পাবে না। আর যারা প্লট পেয়েছেন তাদের কাজ শেষ করে উৎপাদনে যেতে সময় লাগবে আরও দুই বছরের মতো। এ দুই বছর এসব শ্রমিক কি কাজ করবে। তাদের সংসার চলবে কিভাবে। এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পায় না চাকরিহারা এসব শ্রমিক।
সরকার তো অনেক সময় দিয়েছে। আমাদের আর দুইটা মাস দিলে কি সমস্যা ছিল। আমরা বেতন-বোনাসটা পাইতাম। কিন্তু এখন আর কিছুই পাব না। তবে সরকারের কাছে দাবি, আমাদের বকেয়া টাকা আদায়ের যেনো ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং আমাদের কাজের ব্যবস্থা করে দেন।

http://www.dailysangram.com/post/279371-