১১ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৪৬

ভোগ্যপণ্যের মজুদ বাড়াচ্ছে সিন্ডিকেট ॥ টার্গেট রমযান

পবিত্র রমযান মাস শুরু হতে এখনো দেড় মাসের বেশি বাকী। কিন্তু এখনই ভোগ্যপণ্য মজুদে কাজ শুরু করেছে সিন্ডিকেট। রমযান ঘিরে এরই মধ্যে ১৭ ধরনের ভোগ্যপণ্যের আমদানি ও মজুদ বাড়াচ্ছে তারা। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সহনীয় দাম ও রোজার আগমুহূর্তে প্রশাসনের নজরদারি এড়াতে বাজার সিন্ডিকেট এ কৌশল নিয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। 

সূত্র বলছে, প্রতিবছরই রমযানের আগে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের দুর্ভোগে ফেলে দেয় সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে ভোগ্যপণ্যে দাম বাড়ায় তারা। এতে করে রমযানের আগে নিত্যপণ্য কেনাকাটা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে ভোক্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর রমযানে বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। বিশেষ কয়েকটি পণ্য নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজি শুরু হয়। কখনও চিনি নিয়ে, কখনও ছোলা নিয়ে কেলেঙ্কারি চলে। কখনও পেঁয়াজ ও রসুন চলে যায় সিন্ডিকেটের কবলে। সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট রমযান মাসের বাড়তি চাহিদা পুঁজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। রমযান শুরুর আগ থেকে সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা শুরু হয়।
সূত্র বলছে, চলতি বছরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। তবে এবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে এ সিন্ডিকেট যাতে কোনো কারসাজি করতে না পারে সেজন্য টিসিবিকে আগেই মাঠে নামানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে রমযানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যৌক্তিক ও স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে সরকার এখন থেকেই পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। তবে বাজারে সক্রিয় হয়ে ওঠা সিন্ডিকেটের অপতৎপরতার মুখে শেষ পর্যন্ত সরকারি সদিচ্ছা কতটুকু কার্যকর থাকে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তবে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ, বিপণœ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রমযানের চাহিদাকে পুঁজি করে কেউ যাতে অস্বাভাবিকভাবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সে লক্ষ্যে বাজারের দিকে গোয়েন্দা সংস্থার তীক্ষ্ম নজরদারি শুরু করেছে। এছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা টিসিবির (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) মাধ্যমে ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে চিনি, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, ছোলা ও খেজুর বিক্রি করা হবে বলে জানায় মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব শুভাশীষ বসু বলেন, রমযান উপলক্ষে অন্যান্য বারের মতো এবারও আমাদের প্রস্তুতি চলছে। রমযানে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে সেগুলোর মজুদ বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া টিসিবিতে প্রয়োজন মতো পণ্য মজুদ রাখা হচ্ছে। কোনো রকম সঙ্কটের সম্ভাবনা নেই।
ভোক্তা অধিকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও সিন্ডিকেশনের কারণে আমদানি বেশি হওয়ার পরও ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে দাম বাড়বে না বলে ব্যবসায়ীরা সরকারকে যে প্রতিশ্রুতি দেন, পরবর্তীতে তা আর রক্ষা করা হয় না। এজন্য দুর্বল বাজার তদারকি এবং যথাযথ আইন প্রয়োগের অভাবকে দায়ী করেন তারা।
সার্বিক বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং ভোক্তাদের স্বার্থ বিবেচনায় ১৭টি পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। পণ্যগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং গত এক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে ডজনখানেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে- সয়াবিন তেল, পামতেল, রসুন, মসুর ডাল, ছোলা, চিনি, ধনিয়া, জিরা, আদা, হলুদ, তেজপাতা ও খাবার লবণ।
রাজধানীর পাইকারি বাজার রহমতগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, কারওয়ানবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রতি কেজি ছোলা ৭৪-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগে ছিল ৬৮-৭০ টাকা। খেসারি ৬৫-৬৬ টাকা, ডাবলি ৩২ টাকা, মুগ ডাল ৯২-৯৫ টাকা এবং মসুর ডাল মানভেদে ৯৮ থেকে ১০৩ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে একই বাজারে তিন থেকে ছয় টাকা বেশি দরে খুচরা বিক্রি করছেন ক্রেতারা।
এদিকে রমযান সামনে রেখে এখন থেকেই ডাল আমদানির জন্য এলসি করছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারিতে মোট ডাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ১৩ হাজার মেট্রিক টন। যার মূল্য সাত লাখ ৪২ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে মসুর ডাল এলসি করা হয়েছে ৬ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। যার মূল্য চার লাখ ৪৭ হাজার ৭০০ ডলার। ছোলার এলসি হয়েছে দুই হাজার ১০০ মেট্রিক টন। যার মূল্য এক লাখ ১৭ হাজার ৫০০ ডলার। আর অন্যান্য ডালের এলসি হয়েছে চার হাজার ৩০০ মেট্রিক টন।
চট্টগ্রাম কাস্টমস ও বন্দরের তথ্যমতে, বন্দরে এখন ২১টি বড় জাহাজ থেকে ভোগ্যপণ্য খালাস হয়েছে। এসব জাহাজে প্রায় ১০ লাখ টন মটর, মসুর ডাল, অপরিশোধিত চিনি, ভোজ্যতেল ও লবণ রয়েছে। এসব পণ্য খালাস গত মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে শেষসপ্তাহ পর্যন্ত লাগছে। এছাড়া কনটেইনারে করেও ছোলাসহ ডালজাতীয় পণ্য আমদানি বেড়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রোজার সময় কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে, যে কারণে ওই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কারণ চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। দাম নিয়ন্ত্রণের কথা বলে কোনো লাভ হয় না। ‘তবে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নিলে ভোক্তাদের কম দামে রোজার প্রয়োজনীয় পণ্য দেয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা মুনাফা করবেনই। তবে সরকার যদি ভালোমানের পণ্য সংগ্রহে রাখতে পারে, তবে ব্যবসায়ীরা ভয়ে থাকবেন। কারণ তখন তারা ভাববেন, সরকার তো কমদামে ভোক্তাদের পণ্য দিচ্ছে সুতরাং বেশি মুনাফা করা যাবে না। মোট কথা, দুর্নীতি বন্ধ করে সরকারের পক্ষ থেকে যদি ন্যায্যমূল্যে ভোক্তাদের পণ্য দেয়া যায়, তাহলে দাম বাড়ানোর কারসাজি বন্ধ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রোজার আগে বড় ব্যবসায়ীরা পণ্য স্টক (মজুদ) করেন। যে কারণে দাম বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা যাতে পণ্য স্টক করতে না পারেন সেজন্য সরকারকে মনিটরিং করতে হবে। প্রয়োজনে যে গুদামে তারা পণ্য রাখেন সেখানে মনিটরিং টিম পাঠাতে হবে। কেন তারা গুদামে পণ্য মজুদ করছেন তার জবাবদিহি করতে হবে।
‘আবার পণ্য পরিবহনের সময় চাঁদাবাজি হয়- এমন অভিযোগ তুলেও ব্যবসায়ীরা রোজার সময় দাম বাড়িয়ে দেন। দেখা গেল, যে চাঁদাবাজি হয় ব্যবসায়ীরা তার চেয়ে বাড়িয়ে চাঁদাবাজি হওয়ার কথা তুলে ধরেন। এটা দাম বাড়ানোর একটি কৌশল। তবে চাঁদাবাজি যাই হোক পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে চাঁদাবাজির পথ বন্ধ করতে হবে’- বলেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।
এফবিসিসিআই’র সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘রোজার সময় পণ্যের দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তারাও দায়ী। ক্রেতারা (ভোক্তা) একবারে পণ্য কিনে রাখেন, তখন বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। আমরা বারবার বলি, পণ্য একবারে কিনবেন না। সবাই চান কারও ঘাড়ে দোষ চাপাতে। এখন ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা অনেকবার দেখিয়েছি, শুধু ব্যবসায়ীদের দোষ নয়, ক্রেতারাও এজন্য দায়ী।’
বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সফি মাহমুদ বলেন, ‘ছোলা, ডাবলি ও খেসারি- এ তিন পণ্যের ৬০-৭০ শতাংশ চাহিদা থাকে রমযান মাসে। তাই রমযান মাসে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম হলে দাম বেড়ে যায়। এসব পণ্য দেশে যে পরিমাণ পাওয়া যায় এর ৯০ শতাংশের বেশি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমরা যখন অধিক পণ্য আমদানির আগ্রহ দেখাই তখন বিদেশের ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে আমাদের খরচ বেড়ে যায়। যে কারণে দাম কিছুটা বাড়ে। দাম বাড়ার পেছনে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কোনো কারসাজি নেই।
তিনি বলেন, রোজার সময় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে পর্যাপ্ত পণ্য বজারে সরবরাহ করতে হবে। সেই পণ্য অবশ্যই মানসম্পন্ন হতে হবে। পচা গমের মতো হলে হবে না। আর মানসম্পন্ন পণ্য রোজার আগেই আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখি, বাজারে যখন চাহিদা বাড়ে তখন সরকার পণ্য আমদানির পরিকল্পনা করে। সরকারের আমদানি করা পণ্য দেশে আসতে আসতেই রোজা শেষ হয়ে যায়। ফলে সরকারের সেই উদ্যোগের সুফল ভোগ করতে পারেন না সাধারণ ক্রেতারা।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে জোর দিতে হবে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির ওপর। সারা দেশে ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষার বার্তা পৌঁছে দেয়া জরুরি। সেটি কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের একক প্রচেষ্টা কিংবা সক্ষমতা দিয়ে সম্ভব হবে না।
টিসিবির প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আক্তার হোসেন বলেন, রমযানে বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে তিনটি পণ্যের আমদানি নিশ্চিত করতে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। টেন্ডারের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে দুই হাজার টন ছোলা এবং দুই হাজার টন মসুর ডাল আমদানি করা হবে। তবে টেন্ডার দিলেও খেঁজুরের বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ হিসেবে ভোজ্যতেল, চিনিও আমদানি করা হবে। এর টেন্ডার প্রক্রিয়াও চলছে।

http://www.dailysangram.com/post/279422-