১১ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৪২

কার্যকর পলিসি নেই শিল্পোন্নয়নে

সরকারের বেশিরভাগ নীতি শিল্প বিকাশের অন্তরায়, নীতিনির্ধারকদের শিল্পোন্নয়ন শুধু মুখে মুখে, বাস্তবে কিছুই নেই : মন্তব্য বিশ্লেষকদের

দেশে বিনিয়োগে এক ধরনের হাহাকার চলছে। এ দুরবস্থা দীর্ঘদিনের। পদে পদে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে আসছেন না বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। পার্শ^বর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করতে যেসব পলিসি বা নীতি গ্রহণ করে তার অনেক কিছুই নেই বাংলাদেশে। ওইসব দেশ যেভাবে শিল্প খাতকে প্রটেকশন দিয়ে আসছে এখানে চলছে তার উল্টো চিত্র। যেমন- যে পণ্য দেশে উৎপাদিত হয় তা বিদেশ থেকে কম দামে আনতে সরকারের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সমর্থনে সব ব্যবস্থা করা হয়। আবার বিদেশি পণ্য ও বিনিয়োগকে অবাধ সুবিধা ও ছাড় দেয়া অব্যাহত আছে। অনেকটা জামাই আদরের মতো।


বিপরীতে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের বেলায় সব কিছুতেই জটিলতা ও আইনি মারপ্যাঁচ জুড়ে দেয়া হয়। গ্যাসের আবেদন নিয়ে ছুটতে হয় বছরের পর বছর। তবু গ্যাসের দেখা মেলে না। আবার ভাগ্যগুণে কেউ কেউ রাতারাতি সংযোগ পেয়ে যান। দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট এ ধরনের বৈষম্য হচ্ছে অহরহ। প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের সমস্যা এখানও সেই তিমিরে। শিল্পের জন্য জমি পাওয়া নিয়ে তৈরি হয় বড় সংকট। এ নিয়ে সাত ঘাটের পানি খাওয়াতে এক শ্রেণীর আমলারাও যেন সদা প্রস্তুত থাকেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে শিল্পোন্নয়ন তো দূরের কথা দেশের সার্বিক অর্থনীতি কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। দু’পা এগিয়ে চার পা পিছিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ কি পয়েন্টগুলোতে নেগেটিভ মানসিকতার লোকজন বসে থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দেশের শিল্পোন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভাবখানা এমন যে, তারা একটু ছাড় দিলে কিছুলোক আরও ধনী হয়ে যাবে। তাহলে তাদের কী হবে? হিসাব কষতে থাকেন অন্যকে ধনী বানিয়ে তার কী লাভ বা তিনি কী পাবেন ইত্যাদি। অথচ যেসব দেশ আজ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে সেখানকার সরকার ও সরকারি লোকজনের প্রধান কাজই হল ধনী ও শিল্পপতির সংখ্যা বাড়িয়ে দেশকে অর্থ-বিত্তে আরও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করা। যে কারণে আমাদের অনেক পরে যেসব রাষ্ট্র স্বাধীনতা পেয়েছে তাদের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি। সিঙ্গাপুর বাংলাদেশ হওয়ার ৫ বছর আগে স্বাধীন হলেও আজ সেখানে মাথাপিছু আয় প্রায় ৬৫ হাজার মার্কিন ডলার। এককভাবে মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনাম আজ কোথায় চলে গেছে। অথচ বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪০৪ ডলার।

কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক যুগান্তরকে বলেন, এর কারণ তারা দেশকে শিল্পোন্নত করতে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নানামুখী সহায়তা দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে। ৫ থেকে ১০-১৫ বছর মেয়াদি বিভিন্ন প্যাকেজ গ্রহণ করেছে। যেখানে সক্ষম বিনিয়োগকারীদের সরকারিভাবে স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণসহ জমি, গ্যাস, বিদ্যুতের সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয়া হয়। এমনকি একটি শিল্প না দাঁড়ানো পর্যন্ত তাকে সব ধরনের ট্যাক্সের বাইরে রেখে সাহস জোগানো হয়। এছাড়া সরকারিভাবে প্রতিটি শিল্প দাঁড় করাতে ওই সব শিল্পের পণ্য আমদানিতে এন্টি ডাম্পিং ট্যাক্স বসানো ছাড়াও প্রয়োজনীয় ব্যারিয়ার সৃষ্টি করা হয়। উদ্দেশ্য যাতে নিজের দেশের উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে। একই সঙ্গে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের নীতিগত সহায়তা প্রদানসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। তারা বলেন, ওই সব দেশের সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন এভাবে দেশে শত শত সফল শিল্পপতি ও শীর্ষ ধনী সৃষ্টি হবে এবং এর ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। টাকার বহুমুখী ব্যবহার বাড়বে। এতে করে মানুষের মাথাপিছু আয়ে দ্রুত উল্লম্ফন ঘটবে।

বিশ্লেষকরা বলেন, দেশকে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত শক্তিশালী করার এ সহজ পথ বাস্তবায়ন করার বিষয়টি হয় আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারক ও আমলারা জানেন না, না হয় জানেন। আর যদি জানেন বলে দাবি করা হয়, তাহলে প্রশ্ন হল- বাস্তবায়ন করছেন না কেন? তাহলে কী আপনারা জ্ঞানপাপী না ভিন্ন কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নে মহল বিশেষ সক্রিয় রয়েছে। যাদের বাধার কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সরকার তা কার্যকর করতে পারছে না।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি কম। কিন্তু শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব পলিসির অভাবে পণ্যের উৎপাদন খরচ প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বেশি। জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল সমস্যা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম। আর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে যেসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল তা এখনও বহাল আছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগসহ পেতে এখনও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের ঘাটতি তো আছেই। তার মতে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের অন্যতম সমস্যা হল ভূমি সংকট। এছাড়া কর পরিশোধ, জমির রেজিস্ট্রেশন এবং অন্যান্য কর্মসূচিতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। এ দীর্ঘসূত্রতা কাটাতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার।

ড. জাহিদ বলেন, বিনিয়োগ ঘাটতিতে অবকাঠামো দুর্বলতা আরেকটি চ্যালেঞ্জ, যা বাংলাদেশে এখনও প্রকট। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের এ সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের। এগুলো একেবারে চিহ্নিত সমস্যা। কিন্তু এগুলো সমাধানে কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা বিবেচ্য বিষয়। অর্থাৎ বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। এসব দিক থেকে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্যরা অনেক এগিয়ে রয়েছে। এ কারণে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে সব সময়েই পিছিয়ে বাংলাদেশ। তিনি আরও বলেন, আর্থিক খাতে ওয়ান স্টপ সেবা চালু করতে হবে। এছাড়াও শক্তিশালী সুশাসন প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকে দেশে গ্যাস সংযোগে দুর্নীতি হয়। টিআইবির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও গ্যাসে দুর্নীতির কথা উঠে এসেছে। কাউকে সংযোগ দেয়া হয়, আবার কাউকে দেয়া হয় না। এর ফলে গ্যাস সংযোগ পেতে সরকারি দলের নেতা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। অন্যদিকে বড় শিল্পের জন্য বয়লার লাগে। কিন্তু গ্যাস ছাড়া বয়লার চলে না। আর কয়লা দিয়ে বয়লার চালাতে হলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন না বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।

এছাড়া ফার্নেস অয়েল দিয়ে বয়লার চালানো সম্ভব নয়। কারণ এর দাম অত্যন্ত বেশি। ফলে ফার্নেস অয়েল দিয়ে বয়লার চালু করলে পণ্যের উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। অর্থাৎ গ্যাস সমস্যার এখনও কোনো সমাধান হয়নি। দেশে পর্যাপ্ত গ্যাস থাকলে তা উত্তোলনে সেভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয় না। আবার বিদেশিরা এখানে আমাদের মাটির নিচের গ্যাস উত্তোলন করে আমাদের কাছে চড়ামূল্যে বিক্রি করছে। অথচ স্থানীয়ভাবে আমরা গ্যাস উত্তোলন করছি কম। এখন আবার বিদেশ থেকে এলএনজি বা তরল প্রাকৃতিক গ্যাস কিনে এনে শিল্পে গ্যাস দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হল, এটা যারা বলেন, তারা কী জানেন চড়ামূল্যে এলএনজি কিনে শিল্প দাঁড়াবে কিভাবে?

অন্যদিকে চাহিদামাফিক শিল্প গড়ার জন্য বিদ্যুৎ সংযোগে অনেক সমস্যা রয়েছে। নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগে বড় ধরনের জটিলতা রয়েছে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নিজে আন্তরিক থাকলেও অনেক সময় সব কিছু পারেন না। তিনি কোথাও এক মাসের মধ্যে সংযোগ দেয়ার কথা বললে তাও বিলম্বিত হওয়ার নজির আছে। অর্থাৎ মাঠপর্যায়ে যারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন তাদের বেশি আন্তরিক হতে হবে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিনিয়োগের জন্য অন্যতম সমস্যা হল পুঁজি। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে এর সুদের হার অত্যন্ত বেশি। ঋণের সুদের হার এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভারত ও ভিয়েতনামে সুদের হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশে আমানত ও ঋণের সুদের ব্যবধান (স্প্রেড) অনেক বেশি। এ ব্যবধান কমিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আশ্বাস দেয়া হলেও তা কার্যকর করছে না ব্যাংকগুলো। দেশে বিনিয়োগের অন্যতম একটি মৌলিক সমস্যা হল জমির অভাব। বতর্মানে এটি সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। শিল্পের জন্য জমি একেবারেই নেই। ফসলের জমি ব্যবহার করতে হলে ভূমি প্রশাসনের অনুমতি লাগে। আবার শুধু ডিসি অফিস বা মাঠপর্যায় থেকে সম্মতি দিলে হয় না, চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে ভূমি বরাদ্দ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় কমিটিতে যেতে হয়। এরকম দীর্ঘ প্রক্রিয়া ফেস করতে গিয়ে অনেক উদ্যোক্তাকে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। অথচ প্রায় সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকরা যখন বক্তৃতা দেন তখন মনে হয়, কোথাও কোনো সমস্যা নেই। দেশে বিনিয়োগ ও শিল্পোন্নয়ন দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে (!)

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিল্পের কাঁচামালের জন্য পরনির্ভরশীলতা বড় একটি সমস্যা। টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট থেকে শুরু করে প্রায় সব শিল্পের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। অথচ সরকার স্থানীয়ভাবে কাঁচামালের স্বনির্ভরতা বাড়াতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথাও নেই। যেমন গার্মেন্টের ক্ষেত্রে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর স্থানীয়ভাবে গার্মেন্টের জন্য যেসব কাঁচামাল (সুতা ও কাপড়) তৈরি হয় তা গার্মেন্টগুলোতে ব্যবহারের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পলিসি নেই। এছাড়া বিনিয়োগের আরেক সমস্যা হল দেশে সব ধরনের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট (কারিগরিভাবে দক্ষ লোক) নেই। যে কারণে বিদেশ থেকে বেশি মজুরি দিয়ে টেকনিক্যাল এক্সপার্ট আনতে হয়। এতে খরচ অনেক বেশি। যা পণ্যের উৎপাদন খরচে যোগ হয়। ফলে ভারত একটি পণ্য যে খরচে উৎপাদন করতে পারে, ওই পণ্যই বাংলাদেশে উৎপাদনে খরচ হয় তার দেড়গুণ।

এমতাবস্থায় ইদানীং সরকারের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক বলছেন, উন্নয়নের জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ জরুরি। কিন্তু করণীয় কি তা বলছেন না। এজন্য সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পলিসিও গ্রহণ করা হচ্ছে না।

বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন থেকে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুর কথা বলে আসছেন। কিন্তু সেই সেবা দেয়া হচ্ছে না। জানতে চাইলে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগের এই সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের। তবে আমরা তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কিন্তু একদিনে সব কিছু সম্ভব নয়।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের বতর্মান পরিবেশ বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে নয়। ফলে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। তার মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য নিয়মিত কিছু সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ স্বল্পতা অন্যতম। এছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং ঋণের উচ্চ সুদও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। তিনি বলেন, এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। এরপর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশংকাও রয়েছে। অর্থাৎ পুরো পরিবেশই এখন বিনিয়োগের প্রতিকূলে। তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়তা দিতে হবে, পণ্য উৎপাদনের পর তা বিপণনে সরকার সর্বোচ্চ নীতি সহায়তা দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে ওই পরিবেশ নেই। বিশেষ করে গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হবে। এতে ব্যবসার ব্যয়সহ পণ্যের উৎপাদন খরচও কমবে।

প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে আরেক বড় প্রতিবন্ধকতার কথা বলছেন দেশের শীর্ষ স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তারা। তাদের মতে, বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের তুলনায় অনেক সুবিধা পান। ইপিজেডে বিদেশিদের ব্যাপক সুবিধা দেয়া হয়েছে। এতে দেশের মানুষের পরনির্ভরশীলতা বাড়ছে। অন্যদিকে যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসছেন তাদের সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। এ কারণে তারা নিজ দেশ থেকে কম সুদে পুঁজি সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়া কাঁচামাল আমদানিতেও সুবিধা পান। ভ্যাট, ট্যাক্স ও শুল্ক কমিয়ে অথবা শূন্য করে দেয় ওই দেশের সরকার।

এ কারণে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন না।

জানতে চাইলে রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অংশীদারিত্ব ধরে রাখতে হলে শিল্পের স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। কারণ ব্যবসায়ীরা এখন দেশে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতা করছেন। তাই হুটহাট নীতি পরিবর্তন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। প্রতিযোগী দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের উঠা-নামার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জ্বালানি তেলের দাম একাধিকবার সমন্বয় করে, সেখানে বাংলাদেশে মাত্র একবার সমন্বয় করা হয়েছে। উল্টো গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।

দ্বিতীয়ত ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী অবস্থানে আছে। অন্যদিকে প্রতিযোগী দেশ ভারত ডলারের বিপরীতে রুপির ৪০ শতাংশ এবং তুরস্ক লিরার ৬৮ শতাংশ ডলার অবমূল্যায়ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও টাকার মান সমন্বয় করা হয়নি। তিনি বলেন, অবকাঠামো খাতে বড় ঘাটতি আছে। সামগ্রিক দিক বিবেচনায় শিল্পের নীতিমালা প্রণয়নের আগে সরকারের আরও ভাবা উচিত। অবকাঠামো, গ্যাস, বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলসহ সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। যার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের সাহস দেখাবেন।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুসারে ২০১৬ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৭২টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৯ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। এ সময়ে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার ৪০ শতাংশও পূরণ হয়নি। এরপর বিনিয়োগের তথ্য শুধু নিবন্ধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। অর্থাৎ বিনিয়োগে যে সাফল্যের কথা বলা হয়, তা কাগুজে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/11/116700/