১১ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৪০

মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে বেহাল আইসিটি শিক্ষা

শিক্ষক নেই, তার ওপর সিলেবাস কঠিন * পাস করতে শতভাগ শিক্ষার্থী কোচিংনির্ভর

এসএসসি-এইচএসসির শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বইটি। মানবিক, বিজনেস স্টাডিজ থেকে শুরু করে সব বিভাগে এটি বাধ্যতামূলক। শিক্ষার্থীরা ২০১৫ সাল থেকে এ বিষয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে এলেও এসএসসিতে এবারই প্রথম এ বিষয়ে পরীক্ষা দেয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবই তৈরির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বয়স, শ্রেণী, মেধা, ধারণ সক্ষমতা ও বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকার পাশাপাশি বইটিতে কঠিন সব অধ্যায় যুক্ত করায় শিক্ষার্থীদের কাছে বোঝায় পরিণত হয়েছে বিষয়টি। ফলে পরীক্ষায় পাস করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ছুটতে হচ্ছে কোচিং সেন্টারসহ এদিক-সেদিক। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে কিছুটা সহনীয় হলেও মানবিক ও বিজনেস স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে এটি রীতিমতো আতঙ্কের।


এমন কঠিন বিষয় পাঠদানের জন্য কোনো সরকারি হাইস্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ দূরের কথা, পদও সৃষ্টি করা হয়নি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে এমপিও দেয়া হচ্ছে না। ফলে অন্তত ১৫ হাজার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগই বন্ধ আছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী কম্পিউটার অপারেটর বা অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা এ বিষয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন। অনেক সময় ভুল শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। জোড়াতালি দিয়ে পাঠদান করায় বিপাকে পড়েছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। অন্তত এ বিষয়ে শতভাগ শিক্ষার্থীকেই কোচিং ও প্রাইভেটমুখী হতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ যুগান্তরকে বলেন, ‘পাঠ্যবই সহজ করা এবং পাঠ্যক্রম পর্যালোচনার লক্ষ্যে আমরা দুটি কমিটি গঠন করেছি। তারা বিষয়টি দেখবে। এ বিষয়ে পদ সৃষ্টি ও শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে কাজ চলছে। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিও দেয়ার লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যবই ঘেঁটে ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, আইসিটি বইটিতে ছয়টি অধ্যায় আছে। প্রথম অধ্যায়টি কমবেশি সবার কাছেই সহজবোধ্য। দ্বিতীয় অধ্যায় থেকেই শুরু, এটি শিক্ষার্থীদের কাছে আংশিক সহজবোধ্য। কিন্তু পরবর্তী চারটি অধ্যায় বোঝার কোনো উপায় নেই। এমনকি ডিপ্লোমাধারী বা অন্য বিষয়ের শিক্ষকরাও এগুলো বোঝেন না। শিক্ষার্থী-শিক্ষক কিংবা তথ্যপ্রযুক্তিবিদরাও মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কেবল উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের জন্যই সিলেবাসের শেষ চারটি অধ্যায় প্রযোজ্য হতে পারে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ডেটা কমিউনিকেশন ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক’। এ অধ্যায়ে ব্যান্ডইউথ, ডেটা ট্রান্সমিশন মেথড ও ডেটা ট্রান্সমিশন মোড। ডেটা কমিউনিকেশন মাধ্যম-তার মাধ্যম, কো-এক্সিয়াল, টুইস্টেড পেয়ার ও অপটিক্যাল ফাইবার। তারবিহীন মাধ্যম-ইনফ্রায়েড, রেডিও ওয়েব ও মাইক্রোওয়েব। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এসব বিষয়বস্তু উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সক্ষমতার বাইরে, গুরুত্বহীনও বটে। এভাবে তৃতীয় অধ্যায়ে ‘সংখ্যা পদ্ধতি ও ডিজিটাল ডিভাইস’, চতুর্থ অধ্যায়ে ‘ওয়েব ডিজাইন পরিচিতি’ এবং এইচটিএমএল, পঞ্চম অধ্যায়ে ‘প্রোগ্রামিং ভাষা’ এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ে ‘ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নিয়ে পাঠ আছে। এই অধ্যায়গুলো উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য প্রযোজ্য নয় বলে অধিকাংশ শিক্ষক মনে করেন।

বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. সোহেল রহমান যুগান্তরকে বলেন, এসএসসি-এইচএসসির আইসিটি বিষয়ের বইটি তিনি পড়েছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে সরকার এ শিক্ষাকে আবশ্যিক করেছে। কিন্তু যে পাঠ আছে, তা কম্পিউটারবিজ্ঞান বিষয়ে পড়া ব্যক্তি ছাড়া অন্য বিষয়ে দক্ষ শিক্ষকদের শুধু কিছুদিন প্রশিক্ষণ দিয়ে ভালো করে বোঝানো সম্ভব নয়। কেননা, আইসিটি বিষয়ের একটি বড় অংশ নিয়ে আছে প্রোগ্রামিংয়ের ধারণা। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা অঙ্কের ক্লাসে যখন চলক/ধ্র“বক ইত্যাদি শিখবে এবং পাশাপাশি একই সঙ্গে প্রোগ্রামিংয়ের ক্লাসে চলকের ভিন্নরকম ব্যবহার দেখবে, তখন নিশ্চিতভাবেই তারা চমকে উঠবে। কারণ, গণিত ক্লাসে তাকে পড়ানো হয়েছে- সমান চিহ্নের দু’পাশে যা থাকবে তারা আসলে একে অপরের সমান! একই বিষয় তাকে যদি প্রোগ্রামিংয়ের প্রসঙ্গে ভালোমতো বুঝিয়ে দেয়া না যায়, তাহলে তার মূল ধারণাতেই গলদ থেকে যাবে। এ রকম ভূরি ভূরি উদাহরণ দেয়া সম্ভব।

২০১২ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে আইসিটি বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০১৫ সালে নবম শ্রেণীতে বিষয়টি চালু করা হয়। এবারই প্রথম এ বিষয়ে এসএসসি পরীক্ষা হয়। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর ‘আইসিটি’ বই ঘেঁটে দেখা গেছে, বিষয় সহজবোধ্য করতে চিত্রসহ বর্ণনা আছে। তবে তাত্ত্বিকভাবে ঠিক থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। কেননা বেশিরভাগ বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলে কম্পিউটারে সামান্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা ডিপ্লোমাধারীরা পাঠ দিচ্ছেন। কিছু বেসরকারি কলেজে আগে থেকে কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষক থাকলেও কোনো সরকারি স্কুল-কলেজে এ বিষয়ের শিক্ষক নেই।

কোচিং থেকে ফেরার পথে রাজধানীর বকশীবাজারে কথা হয় ঢাকার একটি সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসী সুখীর সঙ্গে। মানবিকের এই ছাত্রী যুগান্তরকে জানান, আইসিটি বিষয়ে তাদের যে পাঠ আছে, তা সহজবোধ্য নয়। এসএসসিতে বিজ্ঞানে পাস করা ছাত্রীদের কেউ কেউ একটু-আধটু বুঝতে পারলেও বাকিদের দিকে তাকালে করুণা হয়।

নাম প্রকাশ না করে একটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জানায়, তাদেরকে এখন পর্যন্ত তিনজন শিক্ষক পড়িয়েছেন। প্রথমে গণিতের শিক্ষক তাদের আইসিটি বিষয়ে ক্লাস নিতেন। ওই শিক্ষকের বদলির পর আরেক শিক্ষক পড়ানো শুরু করে হঠাৎ আসা বন্ধ করে দেন। এখন আরেকজন পড়াচ্ছেন। কিন্তু পাঠ না বোঝায় প্রতিজন আড়াই হাজার টাকা চুক্তিতে ১০ জন বুয়েটের এক ছাত্রের কাছে পড়ছেন। একাডেমিক কোচিং সেন্টার উদ্ভাসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি শিক্ষার্থীকে ৪ হাজার টাকার বিনিময়ে কোর্স শেষ করছে তারা।

এ নিয়ে কথা হয় মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের ব্যবসা ও মানবিক শাখার বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারা বলছেন, বইটির অধিকাংশ অধ্যায় কিছুই বোঝা যায় না।

ঢাকা ও ঢাকার বাইরে স্কুল ও কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করে তারা বলেছেন, কলেজের সিলেবাস শিক্ষার্থীদের সক্ষমতার বাইরে। উদারভাবে খাতা মূল্যায়ন করা না হলে কোনো শিক্ষার্থী এ বিষয়ে পাস করবে না বলেও মন্তব্য কারও কারোর।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেন বলেন, স্কুলে কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়টি আগে থেকেই অপশনাল ছিল। আইসিটি বিষয় চালু হওয়ার পর কম্পিউটার শিক্ষকরাই এটি পড়াচ্ছেন। ফলে শাখার শিক্ষক হিসেবে যারা এমপিও পেতেন তারা এমপিও পাচ্ছেন। ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে শাখায় এমপিওভুক্তি বন্ধ আছে। সে হিসেবে আইসিটি বিষয়ে নিযুক্ত শিক্ষকরাও এমপিও পাচ্ছেন না। তবে সম্প্রতি এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে জানতে চেয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে আইসিটির শিক্ষকরা এমপিও পাবেন।

দেশে সরকারি হাইস্কুল ও কলেজ আছে যথাক্রমে ৩৩৫ ও ৩৩০টি। এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল রয়েছে ১৬ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সাড়ে ৮ হাজার স্কুলে আইসিটির শিক্ষক নেই। মাদ্রাসা ৬ হাজার ৪৭১টি। এর মধ্যে শিক্ষক নেই ৫ হাজার মাদ্রাসায়। আর বেসরকারি অর্ধেকের বেশি কলেজে আইসিটির শিক্ষক নেই।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/04/11/116708/