১১ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩৫

দলে দলে গ্রাম ছাড়ছে হাওরপাড়ের মানুষ

সরেজমিন

পরিবারটির সঙ্গে দেখা হলো ডিঙ্গাপোতা হাওরের তীরে। হাওরের মধ্যবর্তী এলাকার বরান্তর গ্রাম থেকে এসেছেন তারা। তাদের সঙ্গে যেখানটায় দেখা হলো সেই জায়গাটার নাম চিয়াখালী। রাস্তাটি এখনও এই চিয়াখালী পর্যন্ত বানের পানি থেকে একটু ওপরে রয়ে গেছে। এখান থেকে বরান্তর পর্যন্ত আরও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা ডুবে গেছে ফসলডুবির সঙ্গে সঙ্গে। ওই পরিবারের প্রধান নূরে আলম চৌধুরী জানালেন, গবাদিপশুগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছেন ময়মনসিংহের গৌরীপুরে আত্মীয় বাড়িতে। তার স্ত্রী হীরামণি বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন বাপের বাড়ি মদনে।

নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা হাওর দেশের সবচেয়ে বড় হাওরগুলোর একটি। মোহনগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম নাফিজের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ডিঙ্গাপোতায় সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমি রয়েছে, যার সবটুকুই ভেসে গেছে বানের পানিতে। শুধু তাই নয়, হাওর-সংলগ্ন আরও অন্তত আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে ঘটেছে ফসলডুবির ঘটনা। ফলে দলে দলে মানুষ গ্রাম ছাড়ছে। পানির দামে বিক্রি করে দিচ্ছে গবাদিপশু।

গত শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশার টগার হাওর, চন্দ্রসোনার থাল ও ধারাম হাওর এবং নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা হাওরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে মানুষের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার এমন অজস্র ঘটনার কথা জানা গেছে। বরান্তরের নূরে আলম চৌধুরীদের পরিবারটি যথেষ্ট অবস্থাপন্ন। তাদের ফসলের জমি ডুবে

গেলেও বেঁচে থাকার মতো সংস্থান রয়েছে। কারণ নূরে আলম ও তার ভাই তাহের আলমের রয়েছে ব্যবসা বাণিজ্যও। তারা গবাদিপশুগুলো স্থানান্তর করেছেন গো খাদ্যের সংকট দেখা দেওয়ায়। নারী ও শিশুদের পাঠানোর কারণ একটু ভালো রাখার চেষ্টা। কিন্তু নিতান্ত বেঁচে থাকার জন্যই অনেক মানুষ গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে বলে জানালেন টগার হাওরের সাড়ারকোনা গ্রামের বাসিন্দা রমারঞ্জন সরকার মলয়। তিনি টগার হাওরের বলরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। গত শুক্রবার তার সঙ্গে যখন আলাপ হয় তিনি বলেন, 'বৃহস্পতিবার হঠাৎ জানতে পারলাম, আমার স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ফার্স্ট গার্ল মুক্তামণিরা চলে যাচ্ছে গ্রাম ছেড়ে। আমি ওর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। মুক্তার মা-বাবা জানালেন, ঢাকায় গেলে গার্মেন্টে একটা চাকরি পাবেন। আমি স্কুল ম্যানেজমেন্টের দুই সদস্যকে অনুরোধ করে এলাম, যেন মেয়েটিকে গ্রামে রাখার ব্যবস্থা করেন তারা।' গতকাল সোমবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে রমারঞ্জন জানালেন, ম্যানেজিং কমিটির চেষ্টায় মুক্তামণিকে রাখা গেলেও ওর মা-বাবা ঢাকায় চলে গেছেন।

হাওর থেকে দলে দলে লোক গ্রাম ছাড়ছে। শনিবার চন্দ্রসোনার থাল হাওর-সংলগ্ন বাঘাউছা গ্রামে এমনই একজন আসমাউল ইসলাম জানালেন, দু-একদিনের মধ্যে তারা ৩৫ জন যাচ্ছেন উজানের দিকে। কী কাজ করবেন জানতে চাইলে বিব্রত হলেন। সেখানে উপস্থিত জয়শ্রী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোখলেছুর রহমান বলেন, উজানে যাওয়া বলতে ফসল কাটতে যাওয়াকেই বোঝানো হয়। তবে সংকোচে তা প্রকাশ করতে চান না কেউ। কাউকে কিছু না বলে গ্রাম ছাড়ছে মানুষ। ডিঙ্গাপোতার বানিহারী-গাগলপুরে গিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে আলাপ করে এমন অন্তত ৫০ জনের নাম পাওয়া গেল, যারা এরই মধ্যে জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ ভোলাগঞ্জে গেছেন পাথর তোলার কাজে।

হাওর তো বিচ্ছিন্ন, তার মধ্যে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন এই বানিহারী গ্রাম। গ্রামের একমাত্র আড্ডাস্থল রাকিব হাসানের চায়ের দোকান। দোকানে অবশ্য চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবই পাওয়া যায়। কয়েক সারি বেঞ্চ পাতা আছে দোকানে। এক কোনায় আছে একটি টেলিভিশন। ওই দোকানেই গ্রামের হাবুল মিয়া, মোহাম্মদ সেলিম, আকিক মিয়া, আবদুস সাত্তার, মোবারক হোসেন ও হারিকুল ইসলামসহ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হলো। তারাই একে একে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া জনা পঞ্চাশেকের নাম জানালেন। হাবুল মিয়া বলেন, তিনিও যাবেন। বড় মেয়েটার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। হাবুলের বড় মেয়ে সীমা আক্তার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন মোহনগঞ্জ থেকে। ছোট দুই মেয়ের মধ্যে শারমিন পঞ্চম শ্রেণিতে এবং জোপা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। হাবুলের ভায়রা ভাই ঢাকায় একটি গার্মেন্টে চাকরি করেন। যদি তিনি, তার স্ত্রী ও বড় মেয়ে চাকরি পায়, তাহলে কোনো রকমে বাঁচতে পারবেন। হাবুল এবার সাড়ে পাঁচ একর জমি চাষ করেছিলেন। সব ভেসে গেছে। পরীক্ষার সময় মেয়েকে পাঁচ হাজার টাকা দেবেন বলেছিলেন, দিতে পারেননি। পরে দু'দিন আগে মোহনগঞ্জের পরিচিত এক লোকের কাছে মেয়ের জন্য পাঁচ হাজার টাকা ধার চেয়েছেন। ওই লোক ধার দিতে রাজিও হয়েছেন। কিন্তু মেয়ে টাকা আনতে তার কাছে যায়নি। যাবে কেন? ও তো জানে টাকা শোধ করার ক্ষমতা নেই তার বাপের। কথাবার্তার এ পর্যায়ে হাবুল অঝোরে কাঁদলেন। তারপর বললেন, 'মাইয়া আমার ম্যাট্রিকে জিপিএ ফোর পয়েন্ট আট না কী যেন পাইছিল। আমি তো মূর্খ মানুষ, এইতা (এসব) বুঝি না। তবে ওর মাস্টাররা কইছিলেন, মাইয়া আমার অনেক ভালো ছাত্রী। আমার স্বপ্ন আছিল তারে অনেক পড়াশোনা করাইবাম। অহন তারে নিয়া গার্মেন্টসে যাইতাছি।'

গার্মেন্টে চাকরি করতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে বলে জানালেন ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদার। তিনি বলেন, 'আমাকে আমাদের ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা আব্দুল কুদ্দুছ তালুকদার জানিয়েছেন গার্মেন্টসহ অন্যান্য কাজের সন্ধানে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ জন নাগরিকত্ব ও জন্মসনদ নিতে আসছেন। বিশেষ করে গার্মেন্টগুলোতে নাকি আজকাল নাগরিকত্ব ও জন্মসনদ ছাড়া চাকরি-বাকরি হচ্ছে না।' চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় ৬ এপ্রিলের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ওই দিন বৈঠাখালী গ্রামের রতিলাল তালুকদার তার মেয়ে সপ্তম শ্রেণি পড়ূয়া অলি তালুকদারের জন্ম ও নাগরিকত্বের সনদ নিতে এলে তিনি জানতে চেয়েছিলেন এত ছোট মেয়ে নিয়ে কোথায় যাবেন। উত্তরে রতিলাল তাকে বলেছেন, পাঁচ কেয়ার জমির সবটাই বানে ভেসে গেছে। এখন বাড়িতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। প্রবীর বিজয় তালুকদার জানান, মধ্যনগরকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার আবেদন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর যে আবেদন করেছেন, সেখানে দলে দলে মানুষের গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ করেছেন রতিলালের চলে যাওয়া ব্যক্তিগতভাবে তাকে কতটা বিচলিত করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব বলেন, পরিবেশ বিপর্যয় এবং আকস্মিক দুর্যোগের কারণে হাওরাঞ্চলের মানুষের গ্রাম ছাড়ার ঘটনা নতুন নয়। হাওরের নিম্নবিত্তের মানুষ সব সময়ই বর্ষাকালে হাওর ডুবে যাওয়ার পর কাজের খোঁজে বাইরে যায়। তবে এবার অকাল বন্যার কারণে নিঃস্ব হয়ে গেছে ধনি-গরিব সবাই। তাই গ্রামছাড়া মানুষের সংখ্যা অনেক বাড়বে। বেশির ভাগই আসবে ঢাকার দিকে, কারণ এখানে গার্মেন্টে চাকরি পাওয়াটা অধিকতর সহজ। গত ১০ বছরের জনসংখ্যা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকার উপকণ্ঠ কালিয়াকৈর এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। এখানে বছরে ২১ দশমিক ২৯ শতাংশ হারে মানুষ বাড়ছে। এই এলাকায় গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা রয়েছে। তবে হাওরের মানুষ শুধু ঢাকায় নয়, যাবে অন্যান্য কৃষিপ্রধান এলাকায়ও। তাদের হাওরে রাখতে হলে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, বিকল্প কর্মসংস্থান হাওরের মানুষ নিজেরাই অনেকখানি করে নিতে পারবেন, যদি জলমহালগুলো 'জাল যার জলমহাল তার' এই নীতি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে হাওরের পানিতে মাছ পেতে অপেক্ষা করতে হবে আষাঢ় পর্যন্ত। এই ক'মাস মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে ভিজিডি, ভিজিএফ ও ন্যায্যমূল্যের মাধ্যমে দুর্গত এলাকার প্রত্যেক পরিবারের জন্য চাল বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। খোলাবাজার থেকে দুর্গত অঞ্চলের সবাই যাতে ১০ টাকা কেজি চাল কিনতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি ঋণ মওকুফ, আগামী অর্থবছরে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করা, সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি সবার আগে হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে বিশেষ খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে।

http://bangla.samakal.net/2017/04/11/284429#sthash.0H8mqigI.dpuf