১১ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৫২

ভারতের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ও স্মারকসমূহ জনসমক্ষে প্রকাশ করুন

|| ড. মো. নূরুল আমিন || বিরোধী দলগুলোর প্রবল আপত্তি ও বিরোধিতা এবং সুশীল সমাজের বৃহত্তর অংশ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিরূপ মন্তব্যকে উপেক্ষা করে অবশেষে ভারত সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত আট এপ্রিল নয়াদিল্লীতে বৈঠক শেষে প্রতিরক্ষাসহ ৩৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন। সফরের তৃতীয় দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে তিনি দু’দেশের বন্ধুত্বের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। বলা বাহুল্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত যাবার সময় ৩০ কেজি উন্নত মানের পদ্মার ইলিশ মাছ নিয়ে গিয়েছিলেন। তার সাথে ছয়জন বাবুর্চিও ছিল। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরানুযায়ী বাবুর্চিরা গত শনিবার ৮ এপ্রিল ইলিশ দিয়ে তিন পদের তরকারি রান্না করেন এবং রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির জন্য নিজ হাতেই ভাঁপা ইলিশ রান্না করেছিলেন। পাঠকরা হয়ত স্মরণ করতে পারেন যে, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহ-ভালবাসার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। তিনি প্রণব মুখার্জিকে ‘কাকা বাবু’ বলে ডাকেন এবং ২০০৯ সালে ঢাকায় বিডিআর বিদ্রোহের সময় প্রণব বাবু ভারতের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশে ভারতীয় সেনা প্রেরণের প্রস্তাব করেছিলেন। তখন থেকে তাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয় এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার জন্য ভাঁপা ইলিশ রান্না করে তার প্রতি শ্রদ্ধার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ভারতের জাতীয় দৈনিক ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ এবং ‘এই সময়’ গত রোববার পরিবেশিত এই খবর উভয় দেশের মানুষ সানন্দে উপভোগ করেছে। প্রধানমন্ত্রীরা সাধারণত ধনীর দুলাল বা দুলালী হন, রান্নাবান্না ঘরসংসারের ছোটখাট কাজের প্রতি তাদের খেয়াল থাকে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ব্যতিক্রমী কাজটি করে মানুষের ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলেন। তিনি মেহেরবানী করে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলের যে কোনও একটিতে তার ভাঁপা ইলিশ রান্নার অনুপম পদ্ধতিটি প্রদর্শন করলে অনেকেই উপকৃত হতো। এখন আসল কথায় ফিরে আসি।
ভারত-বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা) ঋণ দেবে। এই ঋণের মধ্য থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা) দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশ সামরিক অস্ত্র সরঞ্জাম ক্রয় করবে। চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের সামরিক বাহিনী অন্তরঙ্গ সহযোগিতা ও সমঝোতার মধ্যদিয়ে কাজ করবে এবং শিক্ষা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করা কয়েকটি সামরিক একাডেমি, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং স্থাপনা ব্যবহার করতে পারবে। এ ছাড়াও খুলনা-কলকাতা রুটে যাত্রীবাহী বাস ও ট্রেন সার্ভিস চালু হবে এবং বিরল-রাধিকাপুর রেল রুট পুনরায় মালামাল পরিবহনের জন্য খুলে দেয়া হবে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ চারটি সমঝোতা স্মারকের মধ্যে একটি হচ্ছে দু’দেশের বিচার বিভাগের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে প্রদত্ত তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিট সুবিধার সম্প্রসারণ, উপকূল ও প্রটোকল রুটে যাত্রী ও ক্রুইজ সার্ভিস প্রবর্তন এবং আকাশ পথের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, কানেক্টিভিটি সম্পর্কিত সহযোগিতা ত্বরান্বিতকরণ, জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা খাতের উন্নয়ন প্রভৃতি।
দুই প্রধানমন্ত্রী বহু প্রতিক্ষিত তিস্তাসহ ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত এবং বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে সাগরে পড়েছে এ ধরনের ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে কোন চুক্তি ও সমঝোতায় পৌঁছতে পারেননি। তিস্তার চুক্তির আশায় উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ প্রহর গুনছিলেন। চুক্তি না হওয়ায় এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে সাক্ষী রেখে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পানি বণ্টনের যে কোন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে তাদের এই আশা দুরাশায় পরিণত করেছেন। বলা বাহুল্য, পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সাফ বলে দিয়েছেন যে, তিস্তায় ভারতের ব্যবহারোপযোগী পানিই নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পানি দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। ইতোমধ্যে তিস্তা নদীর বিভিন্ন অংশে প্রায় ১৮টি বাঁধ দিয়ে ভারত তার পানি বিভিন্ন অঞ্চলে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের দিকে তার পানির প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এই অবস্থায় মমতা ব্যানার্জি তিস্তার আশা ছেড়ে দিয়ে ছোট ছোট কয়েকটি অখ্যাত ও স্থানীয় নদীর পানি নেয়ার চিন্তা করার পরামর্শ দিয়েছেন। তার এই পরামর্শ ছেলে ভুলানো ঘুম পাড়ানি গানের মতো মনে হয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা, দু’দেশের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস, সার্ক চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ক্রয়, চুক্তি অনুযায়ী গঙ্গার পানি নির্ধারিত পরিমাণে না দেয়া, কাঁটাতারের বেড়া, সাড়ে ছয় কিলোমিটার এলাকার সীমানা নির্ধারণ প্রভৃতিসহ দু’দেশের মধ্যে অমীংমাংসিত যে সমস্ত সমস্যা রয়েছে সেগুলোর সমাধান সদ্য সম্পাদিত চুক্তিসমূহে স্থান না পাওয়ায় মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে।
২০০৯ সালে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে এর আগেও ডজন দুয়েক চুক্তি হয়েছে। তারা বাংলাদেশকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ঋণও দিয়েছে। এই ঋণ অধিকাংশই ছিল Suppliers Credit থেকেও চড়া মূল্যের। অন্যান্য আন্তর্জাতিক এজেন্সি ও দেশ এমনকি Sovereign loan এর তুলনায় এ ঋণের সুবিধা-অসুবিধাগুলো আমরা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করতে পারিনি। তথ্যের অভাব এখানে যেমন প্রকট তেমনি সরকারের জবাবদিহিতার অভাবও বিরাট। আবার এই টাকা নিয়ে আমাদের যা করতে হচ্ছে তা ভারতের সুবিধার জন্যই, তাদের চলাচলের ও মালামাল এবং অন্যান্য সামগ্রী পরিবহনের সুবিধা সৃষ্টির জন্যই করতে হচ্ছে। বিনিময়ে আমরা আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী ট্রানজিট/করিডোর বাবদ যে অর্থ পাবার কথা ছিল তাও পাচ্ছি না। এবার যে লাইন অব ক্রেডিট সম্প্রসারণের জন্য চুক্তি হয়েছে তাতে আমরা ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাচ্ছি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শ্রী জয়শংকর এ অর্থ কোথায় ব্যয় হবে তা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, মংলা, চট্টগ্রাম এবং পায়রা বন্দরসহ ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে এই ঋণ ব্যবহৃত হবে। বন্দরসমূহ ব্যবহারের সুবিধা তারা আগেই নিয়েছেন। বাংলাদেশকে চড়া সুদে ঋণ দিয়ে বন্দরের উন্নয়ন আমাদের স্বার্থে কতটুকু কাজে লাগবে তা ব্যাখ্যা করা বাংলাদেশ সরকারের উচিত। বাংলাদেশের সাড়ে তিন দিকেই ভারত; বাকি আধা দিক ঘিরে আছে মায়ানমার ও বঙ্গোপসাগর। সীমান্ত ও ভূখ- রক্ষার জন্যই সমরাস্ত্রের প্রয়োজন হয়। এই অস্ত্র ঘরের পাশের প্রতিবেশীর নির্দেশনায় ও অর্থে ক্রয় করতে হলে তার কার্যকারিতা কতটুকু থাকবে তা সামরিক বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারেন। তবে সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেন না। দুই প্রতিবেশী দেশের সামরিক বাহিনীর শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও সামরিক কৌশল এবং কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা যদি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী ও ভিন দেশের রক্ষীবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ, সীমান্ত রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে ও সামর্থ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করতে পারে তাহলে তা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু অনেকের প্রশ্ন- সে সম্ভাবনা কি আছে?
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদের অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান একক ক্ষমতায় কিছু করতে পারে না; সংসদের অনুমোদনক্রমেই তা করতে হয়। ভারতের সাথে সম্পাদিত অতীতের চুক্তিগুলো এবং বর্তমানের ৩৬টি চুক্তি এবং সমাঝোতা স্মারক অথবা তাদের খসড়া সংসদে যায়নি। ফলে চুক্তির সামগ্রিক দিক সম্পর্কে দেশের মালিক জনগণ অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। এই চুক্তি ও স্মারকসমূহের বিস্তারিত বিবরণ জনসমক্ষে প্রকাশ করা যেমন জরুরি তেমনি সংসদে আলোচনা করাও বাঞ্ছনীয়।
মানুষের কাছে যাওয়া ও জনমত গঠন ও যাচাই গণতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ। স্বাধীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত না হওয়ায় সংসদ এখানে অকার্যকর ও বিরোধীদল গৃহপালিত। সরকারের দৃষ্টিতে সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলোর দেশপ্রেম নেই এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারও নেই। পাবলিক মিটিং মিছিল এমনকি ঘরোয়া বৈঠক করে জনমত গঠন ও দেশবাসীকে সংগঠিত করার তাদের কোন অধিকার নেই। এই অধিকার আছে শুধু সরকারি দল ও তার জোটভুক্ত জনসমর্থনহীন হাতে গোনা কয়েকটি দলের। এই অবস্থায় চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলোর মূল্যায়ন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন যে এই চুক্তিগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বড় প্রতিবেশীর সাথে সম্পাদিত অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি। সরকারকে মানুষের এ ধারণা পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে আসা উচিত।

http://www.dailysangram.com/post/279420-