১১ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৫১

ওরা ‘জল’ দেবে না, গোলাবারুদ দেবে

|| মাসুদ মজুমদার ||

ওরা ‘জল’ দেবে না, গোলাবারুদ দেবে। সাথে দেবে ফেলানিদের মতো লাশ ও ফেনসিডিল। মানুষ মেরে গরু রক্ষা করবে। শেখ হাসিনার প্রশস্তি গেয়ে বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাবে। শেরেবাংলার বিখ্যাত তত্ত্ব¡Ñ ‘যখন দেখবে ওরা আমার গুণগান করছে, তখন নিশ্চিত জানবে আমি তোমাদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছি’। বঙ্গবন্ধুকন্যা দিল্লির দরবারে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতার মতো দৃঢ়তাটুকুও দেখাতে পারলেন না। সাবাস মমতা, আমাদের স্বার্থ ও অধিকার আমলে নিলেন না, পশ্চিমবঙ্গবাসীকে তো আশ্বস্ত করলেন।
ভেবে দেখার বিষয় ছোট দেশ, সক্ষমতা সীমিত, নিরাপত্তা চুক্তির গরজ থাকবে আমাদের, সামরিক সমঝোতার জন্য লালায়িত থাকব আমরা। ভারত কেন এতটা মরিয়া। এ কেমন বন্ধুত্বের যুদ্ধবিলাস!
এ ধরনের পরিস্থিতিতেও প্রধানমন্ত্রী কম করে দু’বার প্রকাশ্যে বলেছেন, বিএনপি কিভাবে পড়শি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে বোঝাপড়া করে ক্ষমতায় এসেছিল। সাবেক একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে ঠেকিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত করে তথ্য দিয়েছেনÑ ‘২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলো। আর সে ক্ষমতায় আসার পেছনে ভালো একটি চুক্তি ছিল, বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ। এই সম্পদ গ্যাস বিক্রি করতে চাইল আমেরিকা, কিনবে ভারত। আমেরিকার কোম্পানি গ্যাস তুলবে, ভারতের কাছে বিক্রি করবে।’
এটি একটি মাত্র উপমা। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যখন জনগণের দালালি করেন, তখন সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ কচ্ছপের মতো মুখ খোলসের ভেতর ঢুকিয়ে রাখে। জনগণ উপেক্ষিত হলে সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদী শক্তি দাপট দেখাতে উপস্থিত হয়। এর প্রমাণ অসংখ্য। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় এরশাদ-রওশন ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের ভূমিকা মঞ্চনাটকের মতোই সরাসরি, প্রত্যক্ষ এবং স্পষ্ট। বাংলাদেশের আমজনতা কিছু জানে না, এটা ধরে নেয়া ঠিক নয়। জনগণ অতশত ধার ধারে না, শুধু কে কার দালাল এটা মোটা দাগে বুঝতে চায়। শেখ হাসিনা নিজেকে ভারতের ‘বন্ধু’ ভাবেন, খালেদা জিয়াকে ভাবেন ভারতের ‘দালাল’। নেতা-নেত্রীদের এমন বোকার স্বর্গে বসবাসকে বুদ্ধিজাত ভাবতে চাই না। কারণ, সাউথ ব্লকের অদৃশ্য হাত সম্পর্কে কমবেশি সবার জানা। র-এর পূর্বাপর ভূমিকাও স্পষ্ট। তাঁবেদারদের আচরণও রাখঢাক করে লাভ নেই। তাই কে ভারতের দালাল কে ননÑ এ বিতর্ক নতুন করে তোলার প্রয়োজন নেই। রাজনীতিতে দালাল শব্দটি সব সময় ছিল, এখনো আছে। রুশ-ভারতের দালাল, মস্কোপন্থী, পিকিংপন্থী চিহ্নিত হতেন অনেকেই। ’৭১ সালে পাকিস্তানি দালাল শব্দটি অধিক মাত্রায় ব্যবহৃত এবং চিহ্নিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সব প্রতিপক্ষ দালাল হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। ’৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময়ও দালাল চিহ্নিত করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যেত। ইংরেজ দালালদের নাম ইতিহাস চিহ্নিত করে রেখেছে। পুরো উপমহাদেশ দেশ বিভাগের সময়টিতে যেকোনো একটি প্রভাব বলয়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনির ভেতর ছিল। কংগ্রেস-মুসলিম লীগ ছিল ইংরেজ শাসনের কমন প্রতিপক্ষ, কিন্তু চিন্তা-চেতনায় পরস্পরের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী। জনগণও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল দুই শিবিরে। কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি করত। বাস্তবে কংগ্রেস নেতৃত্ব ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠীর আস্থাভাজন ও ভরসাস্থল। অপর দিকে মুসলিম লীগ ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। এটা সত্য যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ‘উদার ধর্মপন্থী’ দল হলেও হিন্দু-মুসলিম জনগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদী চেতনা ধারণ করা ছাড়া ধর্মীয় অনুশাসন নিয়ে খুব একটা ভাবেনি।
সেই দিনের প্রেক্ষাপটে হিন্দুরা কংগ্রেসের, মুসলিমরা মুসলিম লীগের ব্যানারে থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। তা ছাড়া ’৪৭-এ দেশ বিভাগ ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। সে সময়ও কিছু মুসলমান কংগ্রেসের প্রভাববলয়ে ছিল। কিছু হিন্দুও ছিল মুসলিম লীগ বলয়ে। তা ছাড়া দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ হলেও বাংলা-পাঞ্জাব বিভক্তির কারণে প্রবল রক্তক্ষরণ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরও অনেক মুসলমান ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে আসেনি। অনেক হিন্দুও পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারত যায়নি। পাঞ্জাবের চিত্র ছিল আলাদা।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের জোয়ারে ভেসে যায়নি এমন ব্যতিক্রমও ছিল। ওলামায়ে হিন্দের একটা অংশ কংগ্রেসের সাথে সহাবস্থানের চেষ্টা করেছেনÑ এদের পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ অসম্মান করত না, কিন্তু ‘কংগ্রেসি মাওলানা’ হিসেবে চিনত। কিছু কমরেড ও ওলামায়ে হিন্দের এই অংশ মনে করত ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ কোনো ধার্মিককে বাড়তি সুবিধা দেবে না, বরং সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘু হয়ে অরক্ষিত হয়ে পড়বে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে নতুন যাতনায় ফেলবে। ২৪ বছরের অভিজ্ঞতা কম-বেশি সবার আছে। তাই ইতিহাসের স্মৃতিরোমন্থন ছাড়া দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপট নতুন করে লালন করে কোনো লাভ নেই।
’৭১ থেকে আমরা নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। পাকিস্তান এখন কমপক্ষে দেড় হাজার মাইল দূরে। মনস্তাত্ত্বিক দালালি ছাড়া বাস্তবে পাকিস্তানের দালাল সন্ধান করা রাজনৈতিক বাতিক হতে পারে, এতে অন্য কোনো লাভ নেই। যে ভৌগোলিক কারণে পাকিস্তান থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছি, সে একই কারণেই ফোবিয়াও অর্থহীন। লাভালাভের জায়গায় আঞ্চলিক রাজনীতি ও উপমহাদেশের নতুন মেরুকরণের প্রশ্ন জড়িত। তাই দালালির পরিসরও বিস্তৃত অবস্থায় নেই। তাই দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক চুক্তির সমঝোতা স্মারক দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়া ও লাভ-লোকসানের বিষয়। এই বৈষম্যের মঞ্চে পাকিস্তান অপ্রাসঙ্গিক।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভারতের স্বীয় স্বার্থ রক্ষার নেপথ্য ভূমিকা কম পীড়াদায়ক নয়। ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতিকে আগ্রাসন চিহ্নিত করে ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে চাননি অনেক বামপন্থী। অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সুখকর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেননি। মওলানা ভাসানীসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই ভারতের চোখে বিশ্বস্ত ছিলেন না। নকশাল ও মাওবাদী ভীতি ভারতকে তখন তাড়িয়ে ফিরছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর দিনগুলোতে দেখলাম সবাই বলাবলি করছে, আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল, জাসদ বি টিম। অনেকেই মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা তুলেছেন। পিকিংপন্থীরাও দালালের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। ভারত নিজের স্বার্থে যা যা করেছে সেই তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু সব কিছু চাপিয়ে ভারত-আমাদের ‘বন্ধু’, পড়শি এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক শক্তি। সব কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের পরও জাতীয় স্বার্থের বোঝাপড়ায় ভারতের সাথে আমাদের টানাপড়েন থাকা সম্ভব। আছেও। যেমনি এবারো তিস্তাচুক্তি হলো না। অর্থহীন আশাবাদের গল্প শোনানো হলো। এর বাইরেও যেসব চুক্তি আমাদের স্বার্থে হওয়া দরকার ছিলÑ তা হয়নি। ভারত যা চেয়েছে তা হয়েছে। তার পরও ভারত বিদ্বেষ লালন করার কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না।
পূর্বাপর বলে আসছি, পড়শি পাল্টানো যায় না। ইচ্ছে করলে বাংলাদেশের মানচিত্র তুলে নিয়ে কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় বা আরবদের সাথে সেঁটে দেয়া সম্ভব নয়। ভারতও জোর করে আমাদের মানচিত্র খামছে ধরতে পারবে না। তাতে ভারতের মানচিত্রে টান পড়বে নাÑ সেটা সাত বোন কিংবা আসাম-বাংলাও নিশ্চিত করে জানে না। আবার বাংলাদেশের মানচিত্র উপড়ে ফেলে অন্যত্র সরিয়ে দিতেও পারবে না। ১৬ কোটি মানুষকে কষ্ট দেয়া সম্ভব। হজম করার কিংবা পদানত করে রাখার সাধ্য কারো নেই। তাই সহাবস্থান, সমঝোতা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে চলার কোনো বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্য, আমাদের ক্ষমতার পালাবদলে ভারত নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভেতর ভারতবিদ্বেষ জন্ম নেয়। তার ওপর আমাদের ন্যায়সঙ্গত পাওনা নিয়ে ভারত যখন টালবাহানা করে, তখন অনেকেই ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে নয়, সরকারকে প্রতিপক্ষে রেখে ভারতবিরোধী অবস্থান নেয়। ভারতবিদ্বেষ বা বিরোধিতা মানে ভারত রাষ্ট্রের বিরোধিতা নয়, ভারতের সার্বভৌমত্ব ও জনগণকে বাংলার মানুষ সম্মান করে। ভারত সরকার ভারত ও জনগণ এক বিষয় নয়। শিবসেনা ও নরেন্দ্র মোদির গো-রক্ষা আন্দোলন ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সমর্থন দিচ্ছে না। বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও গুজরাটের দাঙ্গা ভারতীয়দের অল্প কিছু ধর্মান্ধ ছাড়া অন্যরা সমর্থন জোগায়নি। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে না ভারতের সব মানুষ বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতিপক্ষ। কিন্তু ভারত সরকারের আগ্রাসী ভূমিকা এবং নেতিবাচক অবস্থান, বাংলাদেশের স্বার্থের ব্যাপারে ঔদাসীন্য জনগণ হজম করবে কেন? বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বসমাজের সদস্য। মুসলিম উম্মাহর অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের বাইরে আমাদের শুধু প্রতিপক্ষ নেই, বন্ধুও আছে। তাই বাংলাদেশের মানুষ কখনো ভীরু কাপুরুষের মতো আচরণ করবে না। কারো বিগব্র্রাদার ধরনের আচরণকে একটা সীমার বাইরে সমীহ করবে না। চুক্তির বেড়াজালে বাংলাদেশকে কাবু করা সহজ নয়। যদি সহজ হতো তাজউদ্দীনের চুক্তি ছুড়ে ফেলার প্রশ্ন উঠত না। ২৫ সালা চুক্তির মাজেজা ভিন্ন হতো। শেখ হাসিনার চুক্তি ও সমঝোতায় যতটুকু বাড়াবাড়ি আছে ততটুকুই তাকে ডুবাবে, জনগণের দেয়ালে মাথা ঠুকে মরার কোনো কারণ নেই। জনগণ যখন ফুঁসে ওঠার গরজ বোধ করবে, তখন কাউকে বাঁশি বাজাতে হবে না, তাই দালালির মূল্য জনগণের কাছে নেই, বন্ধুত্বের গভীরতাও জনগণ মাপতে জানে।
ভারত সরকার যখন বাংলাদেশীদের জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে ১৬ কোটি মানুষের ম্যান্ডেটের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করে, রাজনৈতিক পালাবদলে খেলোয়াড় সেজে যায়, তখন ভারতবিদ্বেষ ও বিরোধিতা রাজনৈতিক মর্যাদা পায়, অর্থবহ হয়ে ওঠে। সে সময় যারা জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের ভূমিকাকে সমর্থন দিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বক্তব্য দেয়, ভূমিকা পালন করে তখন তারা ভারতের দালাল হবে না কেন! জাতীয় স্বার্থে প্রতিবাদী কণ্ঠকে উচ্চকিত করে যারা সরকারের অন্যায্য ভূমিকার প্রতিবাদ করে তখন তারা দেশপ্রেমিক হবে না কেন? হ্যাঁ, ক্ষমতাপাগলরা প্রায় দ্বিমুখী আচরণ করে। ক্ষমতায় থাকলে ভারতের পা চাটে। অবস্থান পরিবর্তন হলে বিদ্বেষের রাজনীতি করে। এরা দালাল নয়, মানসিক গোলাম। এরা জনগণের সমর্থনের তোয়াক্কা করে না, দেশ-জাতির স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ক্ষমতা উপভোগ করে।
masud2151@gmail.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/211185